Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্যোগ প্রশমনে ত্রাতা উপকূলীয় বনভূমি

সৃজনে ১০৪ কোটি টাকার প্রকল্প

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে উপক‚লের জানমাল রক্ষায় ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন’ নামে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে নতুন বনায়নসহ এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ৪টি জেলাসহ উপক‚লের মোট ১০টি জেলায় আগামী চার বছরে এ বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। তবে পরিবেশবিদরা দেশের সব বনজ সম্পদসহ উপকূলীয় বনভূমি রক্ষায় সরকারকে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন।

সরকার বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁসে ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘উপক‚লীয় এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে। এসব এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীসহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে সীমিত বনায়ন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দাতাদের সহায়তায় একাধিক প্রকল্পের আওতায় উপক‚লভাগে এ পর্যন্ত দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে ‘লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব তহবিল ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, বিভিন্ন দাতা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পর্যায়ক্রমে উপক‚লীয় বনায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বন অধিদফতরের কোস্টাল সার্কেলের হিসেব অনুযায়ী দেশের উপক‚লভাগে এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ হেক্টরে লবনাম্বুজ বন, সাড়ে ৮ হাজার হেক্টরে মূল ভূমির নন-ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বন, প্রায় ৩ হাজার হেক্টরে গোলপাতা, ২শ’ হেক্টরে বাঁশ, একশ’ হেক্টরের মত নারকেলসহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার উপক‚লীয় বাঁধসহ রাস্তার ধারে ১ লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। তবে গত এক দশকে দেশের পূর্ব-দক্ষিণ উপক‚লের বেশ কয়েকটি এলাকার উপক‚লীয় বনভ‚মি নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আবাসন সুবিধা সৃষ্টিসহ দখলের কারণেও এসব বনভ‚মি বিনষ্ট হচ্ছে।
অথচ এসব বনভ‚মির কারণে দেশের বিশাল উপক‚লীয় এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক ভ‚মি উদ্ধারও সম্ভব হয়েছে। অনেক চরাঞ্চল মূল ভ‚খন্ডের সাথেও যুক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে পরিবেশবিদদের মতে ভূখন্ড উদ্ধারের চেয়েও এসব সৃজিত বনভ‚মি সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলভাগকে রক্ষায়।

তবে এ যাবৎকাল উপকূলীয় এলাকায় যে বনায়ন করা হয়েছে, তার ৯৪%-ই ছিল কেওড়া গাছ। কিন্তু এসব গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হলেও দশ বছর বয়স থেকে কান্ড ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনে কেওড়া বাগান মরে যাচ্ছে। পাশাপাশি উপক‚লীয় বাগানে ক্রমাগত পলি পড়ে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধিসহ অবাধে গবাদিপশুর বিচরণে বনভ‚মির মাটি শক্ত হয়ে বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণে উপক‚লীয় এলাকায় কেওড়া’র বিকল্প হিসেবে ছইলা, বাইন, সাদা বাইন, মরিচা বাইন, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, সিংড়া, খলসী, কিরপা, গোলপাতা, হেতাল, কাকড়া, গড়ান ও গর্জন গাছের চারা উত্তোলন ও আবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়াও উপক‚লীয় এলাকায় তাল গাছের চারা উত্তোলন ও রোপনের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে ইনস্টিটিউট। তালগাছ যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে যেমন কার্যকর, তেমন তা অন্য যেকোন গাছের তুলনায় যথেষ্ট টেকসই এবং ঝড়-ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ নিয়ে টিকে থাকতেও সক্ষম। এমনকি বজ্রপাতের হাত থেকে জানমাল রক্ষায়ও তালগাছ যথেষ্ট কার্যকরী।
এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবগুলো ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপক‚লভাগ রক্ষায় উপক‚লীয় বনভ‚মি যথেষ্ট ইতিবাচক ভ‚মিকা রেখেছে। আমাদের লবনাম্বুজ সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় সিডরসহ বারবারই বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় প্রতিহত করেছে। সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সোয়া ২শ’ কিলোমিটারেরও বেশি।
সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর ‘বুলবুল’র হাত থেকে দেশের উপক‚লীয় এলাকার বিশাল জনপদ রক্ষায় উপক‚লীয় বনভ‚মি আবারো প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। অতীতে সিডর, আইলা ও মহাসেন’র মত ঘূর্ণিঝড় প্রতিহত করতে উপক‚লীয় বনভ‚মি বারবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবেশবিদরা যেকোন ঝড়-ঝঞ্ঝার পরে ক্ষতিগ্রস্ত বনভ‚মিকে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে বনভ‚মি ও বনজ সম্পদসহ প্রাণিক‚লের নিবিড় পরিচর্যার কথা বলেছেন। সিডরের আঘাতে পূর্ব সুন্দরবনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে সময়ও পরিবেশবিদরা এ ধরনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সময়ের পরিবর্তনে সুন্দরবন পুনরায় স্বমহিমায় ফিরেছে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন এলাকায় প্রথম আঘাত হানার সময় এর তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারের মত। কিন্তু সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে ক্রমে অগ্রসর হয়ে বরিশাল পর্যন্ত পৌঁছতে ঝড়টির তীব্রতা ৭৯ কিলোমিটারে হ্রাস পায়। সুন্দরবন ছাড়াও একের পর এক উপক‚লীয় বনভ‚মির ওপর আঘাত হানতে গিয়ে বুলবুল ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। ফলে আরো একবার বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে উপক‚লীয় বন। এবারের বুলবুল’র আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলাসহ উপক‚লীয় বনের প্রায় সহস্রাধিক হেক্টরের বনজ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসসহ এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কিন্তু আগাম সতর্কতা যেমনি এসব দুর্যোগের হাত থেকে জানমাল রক্ষায় সহায়ক হয়, তেমনি উপক‚লীয় বনভ‚মিই যেকোন মাত্রার ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের তীব্রতা হ্রাসে ইতোপূর্বেও কার্যকর ভ‚মিকা রেখেছে।



 

Show all comments
  • ** হতদরিদ্র দীনমজুর কহে ** ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ৯:৫০ এএম says : 0
    লেখক নাছিম উল আলম আপনার অনেকগুলো লেখা পড়েছি।আরো একজন লেখক,লিয়াকত হোসেন খোকন তার ও অনেক লেখা পড়েছি।পত্র পত্রিকা পড়া আমার অভ্যাস।যদিও আমি দীন মজুরী করিয়া জীবিকা অর্জন করি।আমি ইনকিলাবের একজন নিয়মিত পাঠক।
    Total Reply(0) Reply
  • ** হতদরিদ্র দীনমজুর কহে ** ১৯ জানুয়ারি, ২০২০, ১০:০২ এএম says : 0
    নাছিম উল আলম সাহেব,ভক্তিপুর্ন ছালাম নিন।আপনি জেলেদের জীবন জীবিকা অবস্থা অবস্থানসহ অনেক বিষয় নিয়ে লিখেছেন।কিছুটা হলেও আপনার লেখা সফল হয়েছে।দখ্খিনান্ঞালবাসির নদী ভাঙ্গন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বনভূমি

৩০ নভেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ