পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাসে মোদি সরকারের কাশ্মীরের স্বাধীনতা হরণকারি ৩৭০ এবং ৩৫/এ ধারা বিলোপ এবং নাগািরকত্ব সংশোধনী আইন সম্ভবত সবচেয়ে আত্মঘাতী ও মুসলমান বিদ্বেষী, নিবর্তনমূলক কালাকানুন হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থা রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সংহতি, ঐক্য ও টিকে থাকার মূল স্তম্ভ। এসব মূল্যবোধকে ধারণ করেই শত শত বছরে বৃহত্তর ভারতের যে অবয়ব লাভ করেছে তাই আধুনিক ভারতের ভিত্তি। এই ভিত্তিকে ধসিয়ে দিতে পারলে যে ভারতকে পাওয়া যাবে তা অত্যন্ত দুর্বল, ভঙ্গুর এবং অনিশ্চিত-অস্থিতিশীল। মুসলমান ভারতের সেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যারা শত শত বছর শান্তিপূর্ণভাবে ভারত শাসন করেছে। যারা বহুধাবিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন ভারতকে বিশাল একক সা¤্রাজ্যে পরিনত করে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতের সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করেছিল। এদেশে বৃটিশ বেনিয়ারা পা রাখার আগে হিন্দু-মুসলমানের হিংসাত্মক অনৈক্য ও দাঙ্গার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া বিরল। বিশাল ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ চালিয়ে যেতে হলে এ দেশের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সহবস্থানের ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করার ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির কারণেই আধুনিক ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল কিংবা ঘটানো হয়েছিল। অহিংসার বানী প্রচারক, জটাধারি হিন্দু সেবায়েত বা গেরুয়া বসনধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ত্রিশুল-তলোয়ার নিয়ে মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, মুসলমানের রক্তে হোলিখেলায় মেতে উঠেছে, এমন দৃশ্য ভারতের শত শত বছরের ইতিহাসে নেই। অনৈক্য সৃষ্টি করে দুই সম্প্রদায়কে প্রয়োজন মতো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে ইংরেজদের দাবার গুটি হয়েছিল ভারতের হিন্দু ও মুসলমানরা। বৃটিশদের ভারত ত্যাগ অনিবার্য হয়ে উঠলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কৃত্রিম সহিংসতা উস্কে দিয়ে দাঙ্গার আগুনে রক্তাক্ত ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে কয়েকটি দুর্বল রাষ্ট্রের বীজ বপন করা হয়। সাম্প্রদায়িকস দাঙ্গার সেই সহিংস আগুন এখনো বিশ্বে ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আত্মমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ভারতীয় মুসলমানরা যখন হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা নির্যাতিত নিপীড়িত এবং জাতিগত সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তখন ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রবলভাবে হুমকির সম্মুখীন হওয়ার প্রেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলমানের জাতীয় ঐক্য বেশি প্রয়োজনীয় ছিল, ঠিক তখন বড় ধরনের বিভক্তির শিকার হয়েছে ভারতীয়রা। এটি শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিভাজনের প্রশ্ন নয়, ভারতীয় জাতিসত্ত¡ার গভীরে এক চরম হিংসা ও দ্বন্দ¦ সংঘাতের দুষ্টক্ষত সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষত ভারতকে বিভাজিত করে দুর্বল করে দিচ্ছে, যা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের মর্যাদা, অবস্থান ও শক্তিকে নড়বড়ে করে দিতে শুরু করেছে। সিএএ বা মুসলিম বিদ্বেষী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতের সংবিধান, বহুত্ববাদী সমাজ, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে ভারত তার প্রতিবেশিদের সাথে অনাস্থা ও বৈরীতার মুখোমুখী হচ্ছে। একদিকে পাকিস্তানের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ চীনের সাথে সরাসরি দ্ব›েদ্ব জড়ানোর প্রেক্ষাপট, অন্যদিকে নেপাল-ভুটানের মত ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশ যখন ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তখন সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সামর্থ্য ও মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই আঁচ করা যায়। এহেন বাস্তবতার মধ্যেও ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের সহিংস আচরণ যেন বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের শুরুতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু এবং লকডাউনের কড়াকড়ি ও ভীতি সৃষ্টি না হলে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম নিধনের সহিংসতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ফেব্রæয়ারীর শেষ সপ্তাহে দিল্লীর দাঙ্গার গতিপ্রকৃতি থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষী সহিংস দাঙ্গায় রাষ্ট্রশক্তি যেন মুসলমানের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আক্রান্ত ও বিপন্ন হাজার হাজার মানুষ পুলিশের হটলাইনে সহায়তা চেয়েও সহায়তা না পাওয়ার পেছনে হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতাসীনদের পক্ষে পুলিশের মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট। দিল্লিতে তিনদিনের দাঙ্গায় মুসলমানদের শত শত বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস করা হয়। অসহায় সাধারণ মুসলমানরা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পায়নি, উপরন্তু হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের তান্ডব-লীলায় পুলিশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পরিস্থিতিকে মারাত্মক অবনতির দিকে নিয়ে যায়। গুজরাট, অযোধ্যাসহ ইতিপূর্বেকার প্রতিটি বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, রক্তক্ষয়ী ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিটি সহিংস দাঙ্গায় পুলিশ ও রাষ্ট্রশক্তির বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে।
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গত ৫০ বছরে ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়। এদের মধ্যে আশি ভাগই মুসলমান। করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু না হলে গত ফেব্রæয়ারীতে শুরু হওয়া দিল্লী দাঙ্গার ধ্বংসযজ্ঞ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা ভাবা যায় না। সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা পর্যন্ত প্রকাশ্যে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য দিচ্ছেন। কোটি কোটি মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার জন্য নতুন নাগরিকত্ব আইন পাস করছেন। সেসব অসাংবিধানিক ও অনৈতিক আইনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ যখন মুসলমানদের পক্ষে তথা ভারতের গণতান্ত্রিক সংবিধানের পক্ষে রাজপথে প্রতিবাদে সামিল হতে শুরু করে, তখন হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের সাথে একাত্ম হয়ে দাঙ্গায় পুলিশের মুসলিমবিদ্বেষী ভূমিকা থেকেই বুঝা যায়, ভারতে মুসলমানদের অবস্থান কোথায়। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, ‘হাউ দিল্লি’স পুলিশ টার্নড এগেইন্সট মুসলিমস’Ñকিভাবে দিল্লির পুলিশ মসুলমানদের বিপক্ষে গেল। সচিত্র প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার জেফ্রি গেট্লম্যান, সামির ইয়াসির, সুহানি রাজ ও হরি কুমার। প্রতিবেদনের শুরুতেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা দিল্লির বাসিন্দা ৪৯ বছর বয়সী কায়সার আলির অভিজ্ঞতা বর্ননা করা হয়েছে। প্রতিবেদক বলেছেন, দাঙ্গার মাঝখানে পড়ে আক্রান্ত কায়সার আলি পুলিশের সহায়তা চেয়েছিল, এটাই ছিল তার বড় ভুল, পুলিশ অফিসার তাকে টেনে হিঁচড়ে উন্মত্ত জনতার সামনে ফেলে দিলে হিন্দুত্ববাদীরা তাকে নির্মমভাবে পিটাতে থাকে। তার সাথে আরো বেশ কয়েকজনকে একইভাবে পিটিয়ে মাথা ও হাড়গোড় ভেঙ্গে দিতে দেখেছে কায়সার আলি। উন্মত্ত দাঙ্গাকারীদের হাতে মুসলমানদের মরতে দেখে পুলিশ কর্মকর্তাদের উল্লাস প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। অসহায় মুসলমানদের সাথে পুলিশ বন্য পশুবৎ বা পুতুলের মত আচরণ করছিল। মুসলমানের দেহে লাথি মারতে মারতে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সাথে পুলিশ সদস্যরা কায়সার আলিকে উদ্দেশ্য করে নাকি বলেছিল, আমরা তোকে মেরে ফেল্লেও আমাদের কিচ্ছু হবে না। দিল্লির সংখ্যালঘু মুসলমানরা যখন সশস্ত্র হিন্দু এক্সট্রিমিস্টদের দ্বারা আক্রান্ত ও নিহত হচ্ছিল, শত শত বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছিল, তখন পুলিশের অস্ত্র থানার অস্ত্রাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। যখন পুলিশের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে অস্ত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়ার কথা, তখন পুলিশকে নিরস্ত্র করে ব্যারাকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, হয়তো অলিখিতভাবে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাকারীদের সহায়তার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
করোনাভাইরাস মহামারীর লকডাউন ও অর্থনৈতিক কর্মকাÐের স্থবিরতায় ভারতের অর্থনীতির অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। সম্ভবত ভারতের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চলছে এখন। এ সময়ে ভারতে জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ছিল সবচেয়ে জরুরী বিষয়। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। প্রায় ৬ মাসের করোনা লকডাউন শিথিল হওয়ার পর ভারতে আবারো পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ মুসলিম বিদ্বেষী সন্ত্রাসী কর্মকাÐ বেড়ে গেছে। এমনকি এসব উগ্রবাদীরা করোনাভাইরাসের জন্যও মুসলমানদের দায়ী করে সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনাজিহাদ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ভারতীয় হিন্দুরা সারাবিশ্বে মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারযুুদ্ধ ও উস্কানি অব্যাহত রাখে। করোনা মহামারীতে ভারতীয় অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থায় একশ্রেণীর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদে উজ্জীবিত হয়ে দেশে মুসলিম বিদ্বেষী সহিংসতার উস্কানি ছড়াচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের এই মুসলিম বিদ্বেষ যখন ভারতকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে, একইভাবে মোদি সরকারের বিদেশ নীতিতে নাখোশ সব প্রতিবেশিরা ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন লাদাখ-গালওয়ান সীমান্তে ভারতীয় সেনারা চীনাদের চরম হুমকির সম্মুখীন। ইতিমধ্যে গালওয়ান উপত্যকার বিশাল এলাকায় চীনা সেনারা আধিপত্য কায়েম করেছে বলে জানা যায়। চীন-ভারত যুদ্ধাবস্থায় ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটানের কাছ থেকেও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে ভারত। ইতিমধ্যে চীন, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তানের মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। সেসব পরিবর্তনে ভারতের সাথে অমিমাংসিত ও বিতর্কিত কিছু এলাকাকে নিজ নিজ দেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিন এশিয়ার সাম্প্রতিক আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় দুই পারমানবিক শক্তি চীন-পাকিস্তানের কৌশলগত ঐক্য একটি বড় নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। এহেন বাস্তবতায় ভারত তার আভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও আধিপত্যবাদী আঞ্চলিক বিদেশনীতির মধ্য দিয়ে প্রতিবেশিদেরকেও বৈরীভাবাপন্ন করে তুলেছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা হুমকি-ধামকির সম্মুখীন হলেও বাংলাদেশ এখনো চীন-পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের পথে হাটেনি। এমনকি হিন্দুপ্রধান ল্যান্ডলক্ড দেশ নেপাল এবং ছোট্ট দেশ ভুটানও ভারতের বিরুদ্ধে এক প্রকার বিদ্রোহ করে বসেছে। চীনের সাথে সীমান্ত এবং অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে কিল খেয়ে কিল হজম করে এখন এসব দেশকেও ঘাঁটাতে চায় না ভারত। এখন শোনা যাচ্ছে, চীনের হাতে মার খেয়ে, গালওয়ানে নিজেদের দাবিকৃত ভূমি হারিয়ে অবশেষে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় চীনের সাথে সমঝোতায় যাচ্ছে ভারত। ইতিমধ্যে ৫ দফা সমঝোতার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
চীন-ভারতের সমঝোতায় হয়তো আপাতত সীমান্ত উত্তেজনা ও সম্মুখযুদ্ধ এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু ভারতের অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেতে হলে প্রথমেই বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী নীতি থেকে সরে আসতে হবে। বিভক্তি, বিদ্বেষ ও প্রতিবেশী দেশ ও প্রতিবেশী সম্প্রদায়কে দাবিয়ে রাখার নীতি নিয়ে ভারত কখনোই আত্মমর্যাদাশীল শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। এটা ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের না বোঝার কথা নয়। ভারতীয় শাসকদের ভুল রাজনীতি ও ভ্রান্ত, চানক্যবাদী, দাবিয়ে রাখার পররাষ্ট্রনীতির কারণে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি। একইভাবে রোহিঙ্গা সংকট, কোভিড-১৯ মহামারীসহ কোনো আঞ্চলিক বা আন্তজার্তিক সংকটেই ভারত তার প্রতিবেশিদের জন্য সহায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। উপরন্তু এই ঘোর দুর্দিনেও ভারতীয় ক্ষমতাসীনরা জাতিকে বিভক্ত করে মুসলিম বিদ্বেষী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার বছর ধরে ভারতে এবং বিশ্বে মুসলমান ও খৃষ্টানরা গরুর গোশত খেয়ে আসছে। বিশ্বের শীর্ষ গোমাংস রফতানীকারক দেশ ভারতের হিন্দুরা হঠাৎ করে গো-রক্ষার নামে, গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের যেন নির্বিচারে হত্যার রাজনীতিতে নেমেছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লী থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরের বিসারা নামক গ্রামে মুহাম্মদ আখলাক নামের এক মধ্য বয়েসী লোককে নিজ বাড়ি থেকে টেনে বের করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তার অপরাধ সে গরুর গোশত খেয়েছিল এবং বাসার ফ্রিজে গুরুর গোশত রেখেছিল। যদিও পুলিশি তদন্তে এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমানীত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে আখলাক হত্যার ঘটনা ভারতে এবং সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। এরপরও গত ৫ বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে গো-রক্ষার নামে, হিন্দু সংস্কৃতি প্রসারের নামে অসংখ্য নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। করোনার লকডাউন শিথিল হওয়ার পর এই সেপ্টেম্বরে হিন্দুত্ববাদীরা নতুন করে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছে। জয় শ্রীরাম ধ্বনিটি একান্তই হিন্দুদের। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের এই ধ্বনি দিতে বাধ্য করছে। জয় শ্রীরাম না বলায় কয়েক দিন আগে উত্তর প্রদেশে একজন মুসলমান টেক্সি ড্রাইভারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এরপর চলতি সপ্তাহে এক মুসলমান যুবকের হাত কেটে নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। তার অপরাধ হচ্ছে, সে হাতের উল্কিতে আল্লাহর নাম ধারণ করেছিল। এভাবেই হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের গণতন্ত্র, সহাবস্থান ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভারতের স্বপ্ন দেখছে, তা এখন ভারতকে নানাবিধ সংকটের আবর্তে ফেলে দিয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক নীতি অব্যাহত রেখে ভারতের পক্ষে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ঘুরে দাঁড়ানো এক প্রকার অসম্ভব।
গত ১২ সেপ্টেম্বর দ্য প্রিন্ট অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, হোয়াই ইন্ডিয়া’স ট্রিপল ক্রাইসিস নিড্স মোদি টু ডি-এস্কেলেইট অ্যান্ড ডিজএঙ্গেইজ ফ্রম ডিসাইসিভ পলিটিক্স এট হোম’- ভারতকে ত্রিমুখী সংকট থেকে রক্ষা করতে হলে মোদিকে তার আভ্যরন্তরীণ রাজনীতির উত্তেজনা প্রশমন করতে হবে এবং অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। হিন্দুত্ববাদের নামে, গোরক্ষার নামে, রামের জয়ধ্বনির নামে, মহাভারতের নামে বিজেপি শাসনে ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের পরিবেশ ও সম্ভাবনাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫ বছরে মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা আমেরিকার গৌরব ফিরিয়ে আনার নামে বর্ণবাদী, একদেশদর্শী রাজনৈতিক মেরুকরণ করতে গিয়ে আমেরিকার আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও আত্মমর্যাদাকে বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেই আমেরিকার সাথে কৌশলগক সম্পর্কের গাঁটছড়া বেঁধে নানা ধর্ম-বর্ণ ও ঐতিহ্যের শতকোটি মানুষের ভারত রাষ্ট্র এখন তার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিপরীত মেরুতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শত শত বছরে মুসলমান শাসকরা ভারত নামক রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মান ও পরিচর্যা করে একটি সা¤্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তারা যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে ভারতে একজনও হিন্দু থাকতো না। এটা কোনো ভারতীয় মুসলমানের কথা নয়। প্রথিতযশা ভারতীয় সংস্কৃতির পন্ডিত যিনি নিজেকে ইহুদী ব্রাহ্মন বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন, সেই শেলডন পোলকের কথা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতের হিন্দুদের স্বরাজের ইতিহাস মাত্র ৭০ বছরের। গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থায় একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনাই ভারতের ছিল। হিন্দুত্ববাদী ভারত এখন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, গণগত্যা ও নির্বতনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ২৫ কোটি মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করার পাশাপাশি সব প্রতিবেশী দেশকে নিজেদের বশংবদ করতে গিয়ে ভারতকে বন্ধুহীন, দুর্বল ও অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিচ্ছে। এটি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যই একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।