পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীতে ইতিমধ্যে এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখের বেশি। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর এক চতুর্থাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ হার বেড়েই চলেছে। মূলত: বিশ্বের কোনো দেশ বা অঞ্চলই এই মহামারীর বাইরে নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ আগ্রাসী জায়নবাদী ইসরালেও ইতিমধ্যে শত শত মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছে। বছরের শুরুতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন, গৃহবন্দী ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। সব দেশের সব মানুষ আগামী দিনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার তথা অস্তিত্বের প্রশ্নে যখন উদ্বিগ্ন, তখন বিশ্বের কয়েকটি প্রান্তে এক শ্রেণীর মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ-জাত্যাভিমান ও ঘৃণ্য কর্মকান্ডে লিপ্ত। জাপানে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব অলিম্পিকসহ অনেক আন্তর্জাতিক ক্রিড়া ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ইভেন্ট স্থগিত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও বিশ্বজনমত এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসগুলোর প্রতিবাদ, উদ্বেগ ও সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করে অধিকৃত ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকাকে ইসরাইলের সরাসরি কর্তৃত্বে নেয়ার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে যাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া আর কোনো দেশ ইসরাইলের এই নতুন দখলদারিত্বের স্বীকৃতি দেয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা ইসরাইলের এই দখলদারিত্বের পরিকল্পনা এগিয়ে না নিতে বলেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, হামাস, হেজবুল্লাহসহ ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ গ্রæপগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইসরাইলের এই দখলদারিত্ব মেনে নিচ্ছে না। পূর্ব ঘোষিত পরিকল্পনা অনুসারে, আজ ১ জুলাই থেকে পশ্চিম তীর ও গাজার অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল।
করোনাভাইরাস মহামারীতে জনজীবন ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার আগে অনেক পরিকল্পনাই ছিল। সেসব পরিকল্পনার বেশিরভাগই শিকেয় উঠে গেছে। অনেক গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক বিরোধ থেমে গেছে। পক্ষান্তরে এই করোনা মহামারীতে বিশ্বের কিছু কিছু অঞ্চলে পুরনো বিরোধ-বিভক্তি, বর্ণবৈষম্য উস্কে দিয়ে নতুন নতুন হিংসা বিরোধের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমন সব স্থানে ঘটছে, যেখানে সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনগণের নিরাপত্তা ও প্রত্যাশা পূরণে কার্যত ব্যর্থ। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ট্রাম্প প্রশাসনের লেজে গোবরে অবস্থা নতুন করে বলার কিছু নেই। সেখানে করোনা মহামারী মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায় এড়াতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নানাবিধ বিষয় অবতারনা করতে দেখা যাচ্ছে। তিনি বরাবরই করোনাভাইরাসের জন্য চীনের উপর বেøইম চাপানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও এতে তেমন কোন সাড়া জাগাতে পারেননি। এদিকে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার সমর্থন ও জয়লাভের সম্ভাবনার পারদ ক্রমশ: নি¤œগামী হওয়ায় তার পুরনো বর্ণবাদী কৌশলকে কাজে লাগাতে চাইছেন। পুলিশের নির্যাতনে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় যে অভাবনীয়, অভূতপূর্ব গণআন্দোলন ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, সেই উত্তাল বিক্ষোভের মধ্যেও তিনি হোয়াইট সুপারম্যাসিস্টের ভূমিকা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বেতাঙ্গ আমেরিকানের সমর্থন নিশ্চিত করতে চাইছেন। তবে তার প্রতিটি পদক্ষেপই এখন মার্কিন জনগণের বিবেকের কাঠগড়ায় বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘বø্যাক লাইভস ম্যাটারস’ আন্দোলনে দিশাহারা ট্রাম্প সর্বশেষ একটি সমাবেশে একজন শ্বেতাঙ্গর বর্ণবাদী শ্লোগান ‘হোয়াইট পাওয়ার ম্যাটার্স’ নিয়ে টুইট ও রিটুইট করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন।
মার্কিন সমাজে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের বাড়াবাড়ি কোনো নতুন বিষয় নয়। সেই দাস ব্যবসার যুগে শুরু হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতন ও হোয়াইট সুপারম্যাসিস্টদের বেপরোয়া মনোভাব কখনো থেমে যায়নি। বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ম্যালকম-এক্স এবং লুই ফারাহ খানদের আন্দোলনের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকারের স্বপক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা মার্কিন স্টাবলিশমেন্টকে সাংবিধানিক আইনগত পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। এভাবে কনফেডারেট আইনে শত বছরের অপূর্ণতা কিছুটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঐক্য রক্ষিত হলেও মার্কিন সমাজের ভেতরকার বর্ণবাদী চেহারার তেমন কোনো পরির্বতন ঘটেনি। বর্ণবাদী এজেন্ডায় ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ শ্লোগান নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর এতদিন কিছুটা চুপসে থাকা পুরনো হোয়াইট সুপারম্যাসিস্টরা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এদের নিয়েই তার বর্ণবাদী রাজনৈতিক খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ খেলায় তার যে শেষরক্ষা হচ্ছে না, অনেক দেরিতে হলেও তিনি বুঝতে পেরেছেন। আগামী নির্বাচনে নিজের সম্ভাব্য পরাজয়ের ব্যাপারে ট্রাম্প বুঝতে পেরেছেন বলে এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, শেষতক ট্রাম্পের রাজনৈতিক পরিণতি যাই হোক, তিনি যে বিভক্তি, বৈষম্য ও অশান্তির আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেলেন তা সহজে নিভছে না। ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তির বরখেলাফ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি, ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তিচুক্তি থেকে সরে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি এবং চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পর্যন্ত তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই অশান্তি, জটিলতা ও ব্যর্থতা সমভাবে দেখা দিয়েছে। তিনি যাদের সাথে সখ্য করেছেন তারাই বিপদে পড়েছে। ইয়েমেনে সউদি জোটের পরাজয়, ভারতের হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী সিএএ, কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার হরণ এবং লাদাখে ও নেপাল-ভুটান সীমান্তে আধিপত্যবাদী আচরণে ভারত এখন রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে সর্বত্র ধরাশায়ি।
আমেরিকার গৌরব ফিরিয়ে আনতে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য খর্ব করতে দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য কায়েমের পাশাপাশি চীনের বড় প্রতিবেশী ভারতকে হাতে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার সাথে ভারতের নতুন প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর ইসরাইলের সাথে ভারতের পুরনো গোপণ সখ্য প্রকাশ্যে চলে আসে। ভারতের ২০ কোটি মুসলমান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নাখোশ হওয়ার কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি সত্তে¡ও নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় ইসরাইল সফর করার সময় ভারতের সাথে জায়নবাদী ইসরাইলের স্বর্গীয় পরিণয়ের তথ্য প্রকাশ করেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। ইসরাইলের সাথে শত শত কোটি ডলারের সামরিক চুক্তির পর থেকেই ভারতের মুসলমানদের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের মনোভাব অনেকটা ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরাইলি আইডিএফ’র আচরণের মত হয়ে ওঠে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ক ধারা এবং ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বিলোপ এবং অনির্দিষ্টকালের কার্ফিউ জারি করে সেখানে যে ধরপাকড়, টার্গেট কিলিং ও নিপীড়নের পন্থা গ্রহণ করা হয়েছে তাকে কাশ্মীরের ফিলিস্তিনীকরণ বলা চলে।
প্রায় আটশ’ বছর ধরে ভারতে হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে এসেছে। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলমানরাই ভারত শাসন করেছে। এরপর প্রায় ২০০ বছর বৃটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে যে ভারতীয় ইউনিয়ন গঠণ করা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তা বিকাশের পথ তৈরী করে এগিয়ে যাচ্ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার পারমানবিক শক্তিধর অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠা ভারত এখন কোন পথে? গত দুই বছরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে আগের হাজার বছরের ভারতের কোনো মিল খুঁেজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমেরিকায় আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বেতাঙ্গদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছেন, ঠিক একইভাবে ভারতেও অনেকটা হিটলারের নাৎসী দলের মত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তুলে ভারতে এক চরম অনিরাপদ ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতœতাত্তি¡ক মূল্য ও সুদীর্ঘ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দিয়ে মুসলমানদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সে ক্ষত সারিয়ে তুলে ভারতে হিন্দু-মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার বদলে পরস্পরকে দাঙ্গা-সংঘাতে ঠেলে দেয়ার যে বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে, যে কোনো সাধারণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারে এটা ভারতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এভাবে কোনো রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ সংহতি ও আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে না। দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং আঞ্চলিক প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে আধিপত্যবাদী আচরণ এবং সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী ভেদবুদ্ধির রাজনীতির খেসারত এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দিতে শুরু করেছে।
ভারত এবং আমেরিকা ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের মানুষের কাছে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম শাসকদের অধীনে এসব জাতির গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর কালিমা লেপিত হচ্ছে এখন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বৈষম্যহীনভাবে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে যে কোনো বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি ও ভাবমর্যাদা তার কাক্সিক্ষত অবস্থান লাভ করতে পারে। অতীতে মুসলমান খলিফা, সুলতান, সম্রাট শাসকরা আন্দালুসিয়ায়, অটোমান সাম্রাজ্যে এবং ভারতে শত শত বছর ধরে কিভাবে শান্তি-সৌহার্দ্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা থেকে আজকের সভ্য দেশের নেতাদের শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। গত তিন হাজার বছরের মধ্যে শুধুমাত্র আন্দালুসিয়ার মুসলিম শাসনামলকেই জুইস সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি ছিল খ্রিষ্টীয় দশম শতকে তৃতীয় আব্দুর রহমানের শাসনামলে ইহুদীরা নির্বিঘে স্বাধীনভাবে নতুন নতুন সিনাগগ নির্মান করার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। আর সম্রাট আকবর তার শাসনামলে একের পর এক রাজ্যকে ভারতের অধীনে নিয়ে আসা এবং হিন্দু মুসলমানের মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। সম্প্রতি ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি (মার্কান্ডেয় কাটজু) মন্তব্য করেন, ভারতীয় জাতিরপিতা হিসেবে কাউকে নির্বাচন করতে হলে সম্রাট আকবরকেই করতে হবে। সম্রাট শাহজাহানের জেষ্ঠ্যপুত্র, আকবরের প্রপৌত্র দারাশিকো মুসলিম সুফিবাদ ও হিন্দু বেদান্তের মধ্যে সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক যোগসূত্র স্থাপনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। দুই ধর্মের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বকে উপজীব্য করে লেখা ধারাশিকোর বই ‘মাজমা-উল-বাহরাইন’ (কনফ্লুয়েন্স অব টু সিজ বা দুই সাগরের সম্মিলন) এখনো আমাদের পথ দেখায় মুসলমান শাসকরা কিভাবে শত শত বছর ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বশে রেখে শান্তি ও সহাবস্থানের মাধ্যমে শাসন করেছিলেন। যাদের কাছে আনুগত্য প্রত্যাশা করা হয় তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি নিষ্ঠতা সুগভীর জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। মোঘলরা সে পথ অনুসরণ করেই শত শত বছর ভারত শাসন করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে নিজেদের স্বশাসনে ভারত এখন তার জাতীয় সংহতি ধরে রাখতে পারছে না।
জন্ম যেভাবেই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে পশ্চিমা সাম্প্রাজ্যবাদের লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে গত ৭০ বছরেও ইসরাইল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে সামাজিক-রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। আঙ্কেল স্যামের সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি ও বছরে শত শত কোটি ডলারের অর্থ সহায়তা নিয়ে প্রতিবেশীদের উপর বারবার আগ্রাসন চালিয়ে শত শত বর্গ কিলোমিটার ভূমি দখল করে পরিকল্পিত নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা হলেও জেরুজালেম নগরী ও মসজিদুল আকসার উপর ইহুদী দখলদারিত্ব কায়েম রেখে ইসরাইলের সাথে মুসলমানদের সহাবস্থান যে কখনো সম্ভব নয়, এতদিনেও পশ্চিমাদের এটা না বুঝার কথা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিভেদ, অবিশ্বাস, অনাস্থা এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে মার্সেনারি বাহিনীর তৎপরতার পেছনের শক্তি সম্পর্কেও কারো অজানা নয়। শুধুমাত্র নিজেদের সা¤্র্জ্যাবাদী পরাশক্তির ভাবমর্যাদা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রক্ষার খাতিরে এতদিন আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনায় তথাকথিত মধ্যস্থতাকারির ভণিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই মর্যাদা রক্ষার জন্যই তারা বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোভাব ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জেরুজালেমের উপর জায়নবাদী দাবীর প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দেয়নি। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর এবং ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির নামে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতে করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে দিয়ে আরব-ইসরাইল সংঘাত নিরসনে দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। এটি স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বশান্তির পরিপন্থী ভূমিকা।
জায়নবাদ প্রভাবিত মার্কিন শাসকদের মুসলিম বিদ্বেষ, মানবতা বিরোধী ভূমিকা ও উস্কানিতে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্র মুসলমানরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চরম বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকায় তার কৌশলগত দুই সহযোগী নরেন্দ্র মোদি ও নেতানিয়াহু নতুন উদ্যমে মুসলমানদের ভূমি দখলের পুরনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে নব উদ্যমে মুসলমান হত্যায় মেতে উঠেছে। ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর কখনোই ভারতের অংশ ছিল না। ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করার পর এখন সেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে হিন্দুদের নাগরিকত্বসহ জমিজমার মালিকানা দেয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। সম্প্রতি ২৫ হাজার মানুষকে কাশ্মীরে নিয়ে আবাসনের সুযোগ দিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। অন্যদিকে কোনো পূর্বাপর বিবেচনা না করেই ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত আরব ভূমির উপর ইসরাইলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মদত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনা মহামারীতে পরিবর্তিত বিশ্বঅর্থনীতি ও রাজনীতিতে যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হোন বা না হোন, ব্যাপক দখলবাজি ও মানবাধিকার হরণের আধিপত্যবাদী রাজনীতি আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার্স’ ব্যানারে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন মূলত ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এই ব্যানারের পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে বিশ্বব্যাপী আরেকটি অব্যক্ত শ্লোগানের ব্যানার বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আছে, তা হচ্ছে- ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার্স’। পাঁচ বছর আগে নর্থ ক্যারোলিনার চ্যাপেল হিলে এক মুসলমান পরিবারের ৩ জন নিজ বাড়িতে বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর মুসলিম লাইভস ম্যাটার্স আন্দোলন হলেও পশ্চিমা মিডিয়া ব্ল্যাক-আউটের কারণে তা হয়নি। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ভারতে বর্ণবাদী হিটলারের প্রেতাত্মারা মার খেতে শুরু করেছে। পশ্চিমা শক্তির বø্যাঙ্কচেক নিয়েও জায়নবাদী সম্প্রসারণবাদিরা ফিলিস্তিনের প্রতিরোধশক্তি ধ্বংস করতে পারেনি। এখন নতুন করে আরব ভূমি দখলের আত্মঘাতী পরিকল্পনায় ইসরাইল তার চূড়ান্ত পতনকেই ত্বরান্বিত করে চলেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।