পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বে করোনার প্রার্দুভাব এবং ভয়াবহ সংক্রমণে মানবজাতি যখন দিশেহারা, তখন এর থেকে পরিত্রাণের জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দ্রুত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে না পারলে মানবসভ্যতা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কায় বিজ্ঞানীরা দিন-রাত গবেষণা শুরু করেন। একটি অজানা-অচেনা মরণঘাতী ভাইরাস যেভাবে দ্রুত গতিতে মানুষের জীবন বিপন্ন করা শুরু করে, তাতে যেকোনো উপায়ে কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। করোনা এমনই এক ব্যাধি যার প্রতিষেধক এর শুরুতে বিশ্বে ছিল না। ফলে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতেই হতো। এ লক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে উঠেপড়ে লাগেন। যেকোনো রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীদের একযুগ বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। বিভিন্ন পর্যায়ে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযোগিতা নিশ্চিত হয়ে তারপর তা ব্যবহার করা হয়। অথচ করোনা এমনই এক মরণঘাতী ভাইরাস যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বল্প সময়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা ছাড়া বিকল্প ছিল না। বিজ্ঞানীরা দিন-রাত গবেষণা করে এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সমর্থ হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীরাও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেন। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। তবে তা এখনও স্বীকৃতি পায়নি। বিশ্বের প্রথাটিই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে উন্নত বিশ্বের প্রভাব এবং খবরদারিই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি, সেখানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষ যতই সাফল্য দেখাক না কেন, তার জন্য ক্ষমতাধর দেশ ও সংস্থার স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে। দেশগুলোর সরকারও নিজ দেশের সাফল্যের স্বীকৃতির জন্য উন্নত বিশ্বের সম্মতির অপেক্ষোয় থাকে। তাদের এই তাকিয়ে থাকার কারণ হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের উপর নির্ভরশীলতা। রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি-সবক্ষেত্রেই ক্ষমতাধর দেশগুলোর সন্তোষ-অসন্তোষের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। ক্ষমতাধর দেশগুলো যেভাবে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি পরিচালনা করে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তা নাহলে, নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়। এই আচরণের কারণ, ক্ষমতাধর দেশগুলো চায় না তাদের চেয়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এগিয়ে যাক। যদি তাই হয় তবে, তাদের খবরদারির বিষয়টি খর্ব হয়ে যায়। করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়েও ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মহামারি এখন যেন তাদেরকে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আরও ক্ষমতাবান করে তুলেছে। তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন এবং বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের নতুন শক্তি হয়ে উঠেছে ‘সফট উইপেন’ বা ‘কোমল অস্ত্র’ হয়ে উঠা করোনা ভ্যাকসিন। এ নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি এখন নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
দুই.
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে যে ক্ষমতাধর দেশগুলো নতুন রাজনীতিতে আবির্ভূত হবে তা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সময়কালেই ধারনা করা হয়েছিল। বিশ্বের তাবৎ বিশেষজ্ঞ ‘ভ্যাকসিন পলিটিক্সে’র আশঙ্কা ব্যক্ত করে ক্ষমতাধর দেশগুলোকে রাজনীতি না করার আহবান জানিয়েছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই এ নিয়ে সতর্ক করে আসছিল। সংস্থাটি ভ্যাকসিনকে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদে’ যাতে পরিণত না করা হয় এ ব্যাপারে উন্নত বিশ্বগুলোকে পরামর্শ দিয়েছিল। সংস্থাটি বলেছিল, করোনা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে হবে। সকল মানুষের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে বৈষম্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সতর্কবার্তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। করোনা এবং এর ভ্যাকসিন নিয়ে যে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ‘ভ্যাকসিন পলিটিক্স’ শুরু হয়েছে। অবশ্য করোনা নিয়ে রাজনীতির বিষয়টি এর শুরুতেই দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনার উৎপত্তি চীনে এবং সেখান থেকে তা ছড়িয়েছে দাবী করে চীনে বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়ে তদন্ত করতে চেয়েছিলেন। ট্রাম্পের এ দাবী চীন প্রত্যাখ্যান করে। ট্রাম্প তার দাবীর পক্ষে অটল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে বলেছিলেন। চীন করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে ট্রাম্পের এ দাবীর পক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমর্থন করেনি। এতেই ট্রাম্প চটে যান এবং সংস্থাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান না দেয়ার ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের পুতুলে পরিণত হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, চীন সংস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাম্প এ যুক্তিও উত্থাপন করেন, চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বছরে মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার দেয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র দেয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। কাজেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেবল চীনের কথা মতোই চলবে কেন? ট্রাম্প সংস্থাটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। যদিও জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে প্রথম দিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করার ঘোষণা দেন। তবে এ বছরের জানুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি শক্তিশালী বিশেষজ্ঞ দল চীনের উহানে পরিদর্শন করে। উহান থেকে করোনার ছড়িয়েছে এমন প্রমানাদি সংগ্রহ করতে পরিদর্শক দল ব্যর্থ হয়েছে। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আবারও নতুন করে তদন্ত করতে চীন যাওয়ার কথা বলে। চীন গত শুক্রবার সংস্থাটির এ তদন্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। চীন এ তদন্তকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের চেয়ে রাজনৈতিক অভিসন্ধি আখ্যায়িত করে তদন্তের অনুমতি দেয়নি। চীন মনে করছে, প্রাথমিক যে তদন্ত করা হয়েছে তাই যথেষ্ট। নতুন করে তদন্তের প্রয়োজন নেই। দেখা যাচ্ছে, করোনার উৎপত্তি এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এক ধরনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। এ নিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর মধ্যে যে নতুন করে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের রাজনীতি রয়েছে, তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। করোনার ভ্যাকসিন নিয়েও যে ‘ভ্যাকসিন পলিটিক্স’ শুরু হবে, তা এক প্রকার অনুমিতই ছিল। হয়েছেও তাই। ভ্যাকসিন আবিষ্কার চলাকালীনই ক্ষমতাধর দেশগুলো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সিংহভাগ টিকা আগাম বুকিং দিয়ে দেয়। আবিষ্কারের সাথে সাথেই দেশগুলো মজুদ করা শুরু করে। কোনো কোনো দেশ জনংখ্যার চার থেকে পাঁচ গুণ টিকা মজুদ করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ উন্নত দেশগুলোর কাছেই বেশিরভাগ ভ্যাকসিন মজুদ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উৎপাদনকারি দেশগুলো থেকে টিকা সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে বিতরণ করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বর্তমানে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। এই টিকা নিয়ে দেশটি ভ্যাকসিন কূটনীতিতে এগিয়ে গিয়েছে। চীন বন্ধুত্ব এবং বিনয় দেখিয়ে টিকা উপহার এবং রফতানির মাধ্যমে কূটনীতির গতি বাড়িয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১০৪টি দেশে টিকা বিতরণ এবং রফতানি করেছে। দেশগুলোতে ৬০২.৫ মিলিয়ন টিকা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টিকা পেয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩৮টি দেশ। তারা পেয়েছে ৩২২ মিলিয়ন টিকা। এরপর রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার ১৯টি দেশ। তারা পেয়েছে ১৮৪.৫ মিলিয়ন টিকা। আফ্রিকার ৩৭টি দেশ পেয়েছে ৫০.৮ মিলিয়ন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পেয়েছে ৪৫.২ মিলিয়ন টিকা। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ অন্যান্য ক্ষমতাধর রাষ্ট্র টিকা রাজনীতিতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশে টিকা পাঠালেও চীনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
তিন.
শুরু হওয়া ভ্যাকসিন পলিটিক্সের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে টিকাকে বর্ণবাদে রূপান্তর করা। ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদী’র সাথে শুরু হয়েছে ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ’। নতুন এই নীতি এখন বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। উন্নত বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের জনগণকে টিকা দেয়া সম্পন্ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করে অর্থনীতির চাকা সচল করেছে। অথচ আফ্রিকার দেশগুলোতে টিকা কার্যক্রম তলানিতে পড়ে রয়েছে। দেশগুলোর ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ২ শতাংশেরও কম মানুষ টিকা পেয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে কম টিকা সেখানে দেয়া হচ্ছে। দেশগুলোতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির মুখপাত্র বলেছেন, দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা আটকে দেয়ার ফলাফল বিশ্বের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না। তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলো আফ্রিকা ও দরিদ্র দেশগুলোকে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করছে। তাদের এই নীতির মধ্যে বর্ণবাদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ থেকে বোঝা যায়, তারা বিশ্বকে নতুন করে বিভক্ত করে দিতে চাইছে। শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গের বৈষম্যমূলক বিষয়টি নতুন করে জাগিয়ে তুলছে। নিজেদের সুরক্ষিত করে আলাদা এক বিশ্ব সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হয়েছে। বিশ্ব যে গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে কিংবা গ্লোবালাইজেশনের যে ধারণা, তা তারা মানতে নারাজ। তাদের মন মানসিকতায় সেই মধ্যযুগীয় দাসপ্রথা বা কালো ও অশ্বেতাঙ্গদের নিচু চোখে দেখা নতুন করে জেগে উঠেছে। আধুনিক যুগে এসেও বর্ণবাদের সেই পুরণো চিত্র করোনা সংকটের উছিলায় সামনে নিয়ে এসেছে। কালো বা অশ্বেতাঙ্গরা মরলে তাদের যেন কিছু যায় আসে না। ক্ষমতাধর দেশগুলোর বর্ণবাদী এই আচরণ বিশ্বকে যে নতুন করে বিভক্ত করে দেবে তা বোঝা যাচ্ছে। এ এক ভয়ংকর বিশ্বনীতি। ইতোমধ্যে ক্ষমতাধর দেশগুলো দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে আলাদা করে দিতে চাইছে। অথচ তারা দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোকে করোনামুক্ত করতে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। চীন আফ্রিকার দেশগুলোতে টিকা সরবরাহে এগিয়ে থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়ায় সম্প্রতি ১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে। অথচ দেশ দুটির জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫ কোটি ৮০ লাখ এবং ২০ কোটি। ইউরোপের দেশগুলো আফ্রিকা এবং দরিদ্র দেশগুলোর দিকে যেন ফিরেও তাকাচ্ছে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর এই উদাসীনতা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, অশ্বেতাঙ্গরা বাঁচলো কি মরল, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। অথচ তারা মানবাধিকার প্রশ্নে খুবই উচ্চকণ্ঠ। দরিদ্র দেশগুলোতে পান থেকে চুন খসলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে তুলকালাম কান্ড শুরু করে দেয়। এখন যে প্রাকৃতিক ভাইরাসের কারণে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে এবং মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন, এ নিয়ে তারা কোনো কথা বলছে না। বিপর্যয় রোধে সহায়তা করার সক্ষমতা থাকলেও এগিয়ে আসছে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে ক্ষমতাধর দেশগুলো কোন মানবিকারের কথা বলে? মানবাধিকার কি শ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গভেদে আলাদা? এ কথা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়, উন্নত দেশগুলো নিজেদের করোনা থেকে রক্ষা করতে সক্ষমতা অর্জন করলেও তারা চায় না, দরিদ্র দেশগুলো দ্রুত করোনামুক্ত হোক। বরং তারা চায় করোনায় দেশগুলোর অর্থনীতি দুর্বল হয়ে তাদের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়–ক এবং তাদের কথামতো চলুক। উন্নত দেশগুলোর এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বাইরে বাংলাদেশ রয়েছে, তা বলা যায় না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশও যে ভ্যাকসিন পলিটিক্সের মধ্যে পড়ে গেছে তার আভাস পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি চলছে। তিনি খোলাসা করে না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, টিকা পেতে কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপহার হিসেবে যা পাওয়ার, তা তো পাচ্ছেই, তবে কিনতে গিয়েও সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, আমরা সাধ্যমতো কেনার চেষ্টা করছি। এ কথাও বলেছেন, বিশ্বের বড় দেশগুলো টিকা উৎপাদন করছে এবং তারা তাদের জনসংখ্যার চার-পাঁচ গুণ বেশি মজুদ করে রাখছে। এ থেকে বোঝা যায়, উন্নত দেশগুলোতে টিকার যেমন অভাব নেই, তেমনি বিশাল মজুদও রয়েছে। অথচ তারা টিকা সংকটে থাকা দেশগুলোতে চাহিদামতো সরবরাহ করছে না। বরং ভ্যাকসিন পলিটিক্সের মধ্যে থেকে একটু একটু করে দিয়ে তাদের আধিপত্য সুদৃঢ় করে তুলছে। এ কথা না বললেই চলে যে, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও বাংলাদেশ ভারতের টিকা রাজনীতির শিকার হয়েছে। ভারত এখন জনগণকে টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকলেও বাংলাদেশের কেনা টিকা দিচ্ছে না। এটা যে তার ভ্যাকসিন পলিটিক্স তা বোঝা যায়। অথচ যখন টিকা রাজনীতি জোরালো হয়ে উঠেনি তখন বাংলাদেশের সামনে চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে সহজে টিকা পাওয়ার সুযোগ ছিল। সে সুযোগ নষ্ট হয়েছে। এখন চীন বিশ্বব্যাপী তার টিকা রাজনীতি সম্প্রসারিত করায় তার পক্ষে বাংলাদেশকে চাহিদামতো দ্রুত টিকা সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেনার সাথে সাথে টিকা দিতে পারছে না। সময় নিয়ে পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করছে। এটাও যে টিকা রাজনীতির একটা অংশ তা বুঝতে বাকি থাকে না।
চার.
বাংলাদেশকে এখন বিশ্ব ভ্যাকসিন পলিটিক্স এবং ভ্যাকসিন বর্ণবাদ-এই দুই সমস্যা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ কূটনীতি। যেখান থেকে টিকা সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে, কালবিলম্ব না করে সেখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। বিলম্ব হলে ভ্যাকসিন পলিটিক্স আরও জটিল হয়ে উঠবে। সবচেয়ে ভাল হয় নিজেরা টিকা উৎপাদন শুরু করলে। ইতোমধ্যে চীন বাংলাদেশ সরকার ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে যৌথ টিকা উৎপাদনের চুক্তি করেছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ও সুসংবাদ। এর ফলে বাংলাদেশে যেমন টিকা সংকট কেটে যাবে, সবাইকে টিকা দিতে পারবে, তেমনি বিদেশেও রফতানি করতে পারবে। তবে চুক্তি করলেই হবে না, দ্রæত টিকা উৎপাদন শুরু করতে হবে। আবার টিকা উৎপাদন নিয়ে যাতে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পলিটিক্সে শিকার না হয়, সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।