Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গর্তে আবদ্ধ তিন ব্যক্তির প্রার্থনার কাহিনী

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

প্রাচীনকালে গর্তে আটকা পড়া তিন ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে খাছ নিয়তে দোয়া করে কীভাবে উদ্ধার পেয়েছিল, সে চমৎকার কাহিনী বোখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। সে কাহিনী বর্ণনার পূর্বে নিয়ত বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা দরকার। কেননা, দোয়া কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত বা উদ্দেশ্য খাঁটি হওয়া আবশ্যক। তা নাহলে আল্লাহর দরবারে দোয়া-প্রার্থনা করার গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই সঠিকভাবে দোয়া করা প্রয়োজন।
নিয়ত বা উদ্দেশ্য বলতে অন্তরের সংকল্পকেই বোঝায়। কোন বিষয় নিয়ত করার সময় অন্তরে সংকল্প না করে মুখে উচ্চারণ করলে চলবে না, বরং অন্তরে সংকল্প করে মুখে উচ্চারণ না করলেও চলবে। পবিত্র কোরআনে সকল কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে সম্পাদনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতাআলা বলেন, ‘কুল ইন্না ছালাতি, ওয়া নুছুকি ওয়া মাহয়ায়া, ওয়া মামাতি, লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকালাহু, ওয়া বিজালিকা ওয়া আনা আউয়ালুল মোছলেমীন।’ অর্থাৎ (হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামাজ এবং আমার কোরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ সমস্তই রাব্বুল আলামীনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি তাঁরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি, আর আমি আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারীদের (মুসলমানদের) প্রথম। (সূরা আনআম: ১৬২)
ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা শুধু এর জন্য আদিষ্ট হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর এবাদত বন্দেগী করবে, দ্বীনকে নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম করে, একনিষ্ঠভাবে এবং নামাজ কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে, আর এটাই হচ্চে সুদৃঢ় পথ।’ (সূরা বায়্যিনাত: ৫)
অপর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মোনাফেকরা দোজখের সর্বনি¤œ স্তরে (নিক্ষিপ্ত) হবে এবং তাদের জন্য আপনি (হে রাসূল!) কোন সাহায্যকারী পাবেন না। কিন্তু যারা অনুতাপ করে (আল্লাহর দিকে) ফিরে এসেছে এবং নিজেদের জীবনকে সংশোধন করেছে। আর আল্লাহকে আকড়ে ধরেছে এবং তাদের দ্বীনকে নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম করেছে।’ (সূরা নেছা: ১৪৫)
কোরআনের এসকল আয়াতে আল্লাহতাআলা মুসলমানদেরকে তাদের নিয়তের গুরুত্ব উপলব্ধি করার প্রতি জোর দিয়েছেন। নিয়ত বা উদ্দেশ্য অনুযায়ীই কাজের পুরস্কার পাওয়া যায়। মানুষ যেরূপ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে সেরূপ পুরস্কার পায়। আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাজ করলেই আল্লাহর নিকট পুরস্কার পাওয়া যায়। দুনিয়ার স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজ করে আল্লাহর দরবারে তার পুরস্কার পাওয়া যেতে পারে না। এর উদাহরণ একটি হাদীস হতে পাওয়া যায়। হাদীসটি হলো এই: হজরত উমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হুজুর (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নিয়তের উপরই সমস্ত কাজ নির্ভর করে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়ত করেছে। সুতরাং যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিয়তে (উদ্দেশ্যে) হিজরত করে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিয়তেই পরিগণিত হয় এবং যে দুনিয়া লাভ অথবা কোন নারীকে বিবাহ করার নিয়তে হিজরত করে, তার হিজরত তারই নিয়তে গণ্য হয়, যার নিয়তে সে হিজরত করেছে।’ (বোখারী-মুসলিম)
নিয়তের গুরুত্ব ব্যাখ্যার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ যথেষ্ট হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্য হতে তিন ব্যক্তি এক সফরে যাচ্ছিল। রাতে তারা একটি পর্বতগুহায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘটনাচক্রে পর্বত হতে পাথরের একটি প্রকাÐ টুকরা পতিত হলে গর্তের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তারা পরস্পর পরামর্শ করতে লাগল। তারা এই বিপদ হতে উদ্ধারের পথ কী থাকতে পারে তা ভাবতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, এই আকস্মিক বিপদ হতে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা এবং নিজ নিজ সৎকর্মের অছিলায় তাঁর নিকট দোয়া করা।’
তাই তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ! তুমি জ্ঞাত আছো যে, আমার পিতা-মাতা বৃদ্ধ ছিলেন, সন্ধ্যাবেলা আমি যখন কৃষি-খামার হতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতাম তখন প্রথমে আমার মাতা-পিতাকে দুধ পান করাতাম। অতঃপর আমার সন্তানদেরকে দুধ পান করাতাম। একদিন ক্ষেতে আমার বিলম্ব হয়ে যায়। আমি গৃহে ফিরে এসে দেখতে পাই যে, আমার পিতা-মাতা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি দুধের গøাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম এবং তাদের আদব বজায় রেখে তাদের ঘুম থেকে উঠাবার পরিবর্তে তাদের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমার সন্তানরা ক্ষুধায় অস্থির এবং আমার কাছে খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। এই অবস্থায় আমার মাতা-পিতা কতক্ষণে জেগে উঠবেন এই প্রতীক্ষায় ভোর হয়ে যায়।
তারা সজাগ হলে তাদেরকে আমি দুধ পান করাই। তারপর আমার পরিবার ও সন্তানরা পান করে। ‘হে আল্লাহ, আমার এই কাজ নিছক তোমার সন্তুষ্টির জন্য ছিল, তুমি এই কাজের পুরস্কার স্বরূপ আমাদের প্রতিবন্ধক এই পাথরটি সরিয়ে দাও।’ এই ব্যক্তির দোয়ার বদৌলতে পাথরটি কিঞ্চিত সরে যায় এবং পর্বতগুহায় পতিত পাথরের ফাঁকে কিছুটা আলো দেখা দেয়।
অতঃপর দ্বিতীয় ব্যক্তি বলতে লাগল, হে আল্লাহ! তুমি জান যে, আমার চাচাত বোনকে আমি অত্যন্ত ভালবাসতাম এবং তাকে আমার মনোভাব ব্যক্ত করি। কিন্তু সে আমার আশা পূরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। দৈবচক্রে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং সে দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়ে আমার নিকট উপস্থিত হয়। আমি তাকে একশত বিশ দিনার এই শর্তে প্রদান করি যে, সে তার সত্ত¡াকে আমার কাছে অর্পণ করবে। সে তাই করল এবং বলল, তোমার পক্ষে এমন কোন বস্তুকে ভোগ করা কি ঠিক হবে, যা তোমার জন্য হালাল নয়? মেয়েটির কথা শুনে আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাই এবং প্রদত্ত একশত বিশটি দিনার তাকে দান করে দেই এবং অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ইচ্ছাও পরিত্যাগ করি। হে আল্লাহ! আমার এই কর্ম সম্পূর্ণ তোমার রেজামন্দীর জন্য ছিল। তুমি এ কাজের বরকতে পাথরটি সরিয়ে দাও। এই দোয়ার পর পাথরাট আরও একটু সরে যায়।
অতঃপর তৃতীয় ব্যক্তি এই মর্মে দোয়া করতে শুরু করে, হে আল্লাহ! তুমি অবগত আছ যে, একদিন আমি কিছু সংখ্যক শ্রমিককে আমার কাজের জন্য নিয়োগ করেছিলাম এবং তাদের পারিশ্রমিক হিসাবে কিছু পরিমাণ শস্য দেয়ার কথা স্থির হয়। আমি যখন তাদের পারিশ্রমিক বণ্টন করছিলাম, তখন একজন মজদুর তার নির্ধারিত পারিশ্রমিক ফেলে চলে যায়। আমি তার শস্যগুলি বপন করি, সেগুলো পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বিপুল অর্থে পরিণত হয়। পরে উক্ত মজদুর আমার কাছে এসে তার বেতনের শস্যগুলি দাবি করে। আমি তাকে জানালাম এ সকল উট, গরু, ছাগল ইত্যাদি তোমারই মজদুরী, তুমি এগুলো নিয়ে যাও। মজদুর বলল, আমাকে কেন উপহাস করছেন, আমার মজদুরীর শস্যগুলি আমাকে ফেরত দিন। আমি বললাম, এটা উপহাসের কথা নয়, তোমারই মজদুরীর শস্য বর্ধিত হয়ে এত বিপুল অর্থে পরিণত হয়েছে। কেননা আমি তোমার শস্যগুলি ক্ষেতে বুনেছিলাম। তা হতে যা উৎপন্ন হয়েছিল, তা আমি বৃদ্ধি করতে থাকি। মজদুর একথা শোনার পর তার সমুদয় অর্থ সম্পদ নিয়ে যায়। হে আল্লাহ! আমি এই কাজ তোমারই সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, আমার এ কাজের অছিলায় তুমি আমাদের গর্ত হতে পাথরটি সরিয়ে দাও। তার এই দোয়ার পর পাথরটি সর্ম্পূণরূপে সরে যায় এবং তারা তিনজনই গর্তের ভিতর হতে নিরাপদে বের হয়ে আসে। (বোখারী-মুসলিম) খাঁটি নিয়তের কী চমৎকার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত!



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দোয়া


আরও
আরও পড়ুন