পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
লক্ষ-কোটি মানুষের প্রিয় মুখপত্র, ইসলামী মূল্যবোধ, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের পতাকাবাহী দৈনিক ইনকিলাব অত্যন্ত সফলভাবে ৩৪ বছর পথ পরিক্রমা শেষে আজ ৩৫তম বছরে পদার্পণ করেছে। এজন্য আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহান দরবারে আদায় করছি লাখো শোকরিয়া। দেশের ও বিদেশের অগণিত পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন থেকে ২০২০ সালের ৪ জুন প্রায় তিন যুগ। আমাদের মতো দেশে তিন যুগ ধরে প্রতি প্রভাতে নিয়মিত পাঠকদের দরবারে হাজির হওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয় মোটেই। অনেক চড়াই-উতড়াই আছে, বাধা-বিঘ্ন আছে, হুমকি-ধমকি আছে, চোখ রাঙানি আছে, বাধা-নিষেধের খড়গ আছে, আর্থিক সঙ্কট আছে; এসব কিছু অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে এই যে সমুখযাত্রা অব্যাহত রাখা, এ তো আল্লাহরই অনুগ্রহ। সেই সাথে আদর্শে অবিচলতা, একান্ত নিষ্ঠা, দৃঢ়প্রত্যয় ও পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি দেয়া অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি পালনও অপিহার্য। ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য ইসলামী চিন্তাবিদ, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, রাজনীতিবিদ ও জাতীয় বোধ-বিবেকের কণ্ঠস্বর আলহাজ মাওলানা এম.এ মান্নান রহ. এর কিছু দুর্লভ গুণাবলী ছিল। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের মধ্যেও এসব দুর্লভ গুণাবলী বিদ্যমান। সৌভাগ্যের বিষয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের এই অভিযাত্রায় ইনকিলাব পেয়েছে আদর্শনিষ্ঠ, নিবেদিত প্রাণ একদল সাংবাদিক। চাকরি যাদের কাছে মুখ্য না, মুখ্য- আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে নিজেদের মেধা, প্রতিভা ও যোগ্যতা উজাড় করে দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা। দার্শনিক কবি ইকবালের ভাষায়: ‘দৃঢ় ঈমান, অধ্যবসায়, জগজ্জয়ী প্রেম দিলের/ অমোঘ অস্ত্র এ তিন হলো জীবন রণে সাফল্যের’।
ইনকিলাব প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে শুধু বাংলা দেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয় জয় করাটা সত্যই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। ইসলামী সভা-সম্মেলন ও সেমিনারে যোগদান উপলক্ষে, আরব জাহানের বিভিন্ন দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেট, গ্রেট ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর-নগর, মিসর-সুদানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন এলাকা সফর করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সেসব দেশে বাংলাভাষী লোকদের মাঝে ইনকিলাবের জনপ্রিয়তা দেখে আমি মুগ্ধ ও মোহিত হয়েছি। আমার অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে ইনকিলাবের সাথে সংশ্লিষ্টতাই যেন তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে। মুসলিম জাহানের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইনকিলাবের অভিমত কী, ভূমিকা কী, পরামর্শ কী- প্রায় সকল জায়গায় আমাকে এসব জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি লক্ষ্য করেছি, ইনকিলাবের কাছে তাদের প্রত্যাশা অনেক। ইনকিলাব যেন শুধুমাত্র একটি পত্রিকা নয়, একটি আন্দোলন, যেন ইসলামী উম্মাহর মুখপত্র। তখন আমার মনে হয়েছে, ইনকিলাবের জন্ম স্বার্থক হয়েছে।
বিশ্বকবি বলেছেন :
‘না পারে বুঝাতে আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে
কোকিল যেমন পঞ্চমে কুজে
মাগিছে তেমনি সুর
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা
বিদায়ের আগে দু’চারটি কথা
রেখে যাব সুমধুর।’
অবশ্য বিশ্বকবির মতো সুমধুর কথা নয়, তবে কিছু ব্যাকুলতা ঘুচানো ও প্রকাশের ব্যথা মিটানোর প্রচেষ্টা ও সাধনা ইনকিলাব তো অবশ্যই করেছে এবং করে যাচ্ছে।
ইনকিলাব তার পরিকল্পনা কাল থেকেই সেই ব্যথা আর ব্যাকুলতা অনুধাবন করে আসছিল। হাজার বছর হয় এ অঞ্চলে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে। ক্রমে হয়েছে ইসলামের প্রসার। সুফী-দরবেশদের উদারনৈতিক আচরণ, দাওয়াত, তাঁদের চারিত্রিক মাধুর্য ও মানবসেবায় মুগ্ধ হয়ে আচারপীড়িত-নির্যাতীত জনগোষ্ঠি দলে দলে আশ্রয় নিয়েছে সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও ইনসাফের ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে এসে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে তারা। শতকরা ৯০% ভাগের অধিক হয়েছে মুসলমান। তাদের ধর্মচ্যুত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, চেষ্টা চলেছে নানাভাবে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি ধ্বংস করার। কিন্তু তাদের ঈমানহারা কিংবা স্বকীয় তাহ্জীব-তমদ্দুন বিমুখ করা যায়নি কোনোভাবেই। স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তারা টিকে রয়েছে হাজার বছর ধরে। বিশাল হিন্দু ভারতের বুকে লীন করে দেয়া যায়নি। এই স্বাতন্ত্র্যের জোরেই, এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বদৌলতেই ব্রিটিশ শাসনের অবসানে লাভ করেছে ভৌগোলিক সীমারেখা। ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই সীমার মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাস্তবরূপ লাভ করেছে হাজার বছরের স্বপ্ন। আমরা আজ এক স্বাধীন-সার্বভৌম গর্বিত জাতি। এই ঈমান আকিদা, বোধ-বিশ্বাস, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার ধ্বংস করার জন্য হামলা চলেছে বার বার এবং এখনো চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অবিরাম তৎপরতা। এক শ্রেণির পরগাছা আতেল, ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী, যাদের এখানকার মাটি ও মানুষের সাথে, তাদের বোধ-বিশ্বাসের সাথে, তাদের চিন্তা-চেতনার সাথে, আশা-আকাক্সক্ষার সাথে কোনোই সম্পর্ক নেই, তাদেরই প্রাধান্য বিরাজ করছিল বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। মানুষ খুঁজছিল এথেকে মুক্তির পথ। সেই ব্যথা ও ব্যাকুলতার ভাষা প্রকাশের, সেই আশা-আকাক্সক্ষা তুলে ধরার, সেই স্বপ্নসাধ পূরণের পথ দেখাবার অঙ্গীকার নিয়েই আত্মপ্রকাশ ঘটল দৈনিক ইনকিলাবের। সেই চিরবাঞ্ছিত, চিরকাক্সিক্ষত, আরাধ্য বস্তু সামনে পেয়েই মানুষ তা লুফে নিল। সবকে ডিঙ্গিয়ে প্রকাশনা ক্ষেত্রে পৌঁছে গেল শীর্ষে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠল অসংখ্য পাঠক ফোরাম।
তা হলে ইনকিলাব কি একটি বিশেষ গোষ্ঠির পত্রিকা? না। ইনকিলাব সবার পত্রিকা। নির্মোহ, নিরপেক্ষভাবে যা সত্য তাই তুলে ধরে ইনকিলাব। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌত্ব, অখন্ডতা ও স্বার্থের ক্ষেত্রে সে আপোসহীন। চরম প্রান্তিকতা, উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের সে চরমবিরোধী। সে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতার বিরোধী, মজলুমের পক্ষে, জালিমের বিপক্ষে। সাম্য-মৈত্রী, ইনসাফ ও ন্যায়ের পক্ষে সে সর্বদা সোচ্চার। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমার চারটি বৃত্ত আছে। আমি মিসরী, আমি আরব, আমি মুসলিম, আমি পৃথিবীর একজন বাসিন্দা। কোনটা আগে কোনটা পরে এনিয়ে কথা থাকলেও আমাদেরও মোটামুটি চারটি বৃত্ত আছে। আমরা মুসলমান, আমরা বাংলাদেশি-বাঙালি, আমরা ইসলামী উম্মাহর সদস্য, আমরা এই পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা। এ চার বৃত্তের মাঝেই ইনকিলাবের পথ পরিক্রমা। এই পরিচয়ের মধ্যে পরস্পরে কোনো সংঘাত নেই, সংঘর্ষ নেই। আমি একজন মুসলিম হিসেবে আমার ঈমান আকিদা, বোধ-বিশ্বাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে জীবনযাপন করব। জীবন গেলেও আমার ঈমান, আমার ধর্ম বিসর্জন দেব না। আমার ভাষা বাঙলা, আমি বাঙালি, আমার দেশ বাংলাদেশ। এদেশের যারা বাসিন্দা, তারা যে ধর্মেরই হোক, যে গোত্রের হোক, সকলেরই নাগরিক অধিকার সমান। এক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে কোনো প্রার্থক্য নেই। সবাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার লালন করবে, এর বিকাশ ঘটাবে, তাতে কেউ বাধা দেবে না, বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। তেমনি ৬০টি স্বাধীন মুসলিম দেশ নিয়ে যে ইসলামী রাষ্ট্রসংঘ বাংলাদেশ তার অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র, দেড়শ’ কোটি মুসলিম নিয়ে যে ইসলামী উম্মাহ আমি তারই একজন সদস্য। তেমনি এই গ্রহের একজন বাসিন্দা। আমার ঈমান-আকিদার ব্যাপারে যেমন আমি আপোসহীন, তেমনি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা ও স্বার্থ ও অধিকারের ব্যাপারেও আমি আপোসহীন। আয়তনের দিক দিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি অনেক দেশের চেয়ে আমার দেশ ক্ষুদ্র হতে পারে কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে কোনো দেশের চেয়ে ছোট নয়। আমার সাথে সম্পর্ক হবে সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে, সমমর্যাদায়। এখানের সম্পদের প্রতি কেউ লোভাতুর দৃষ্টি দিলে, অন্যায়ভাবে আমার প্রাপ্য অধিকার হরণ করলে, পানি থেকে বঞ্চিত করলে আমি তা মেনে নেব না। ন্যায্য অধিকার আদায় করে নেবার জন্য সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাব। এরপর আসে ইসলামী রাষ্ট্রসংঘের কথা বা ওআইসি প্রসঙ্গ। দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অবিরাম বলে এসেছে একে জোরদার করার কথা। বার বার বলে এসেছে, আল্লাহ আমাদের ৬০টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ দিয়েছেন, তেলসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক বানিয়েছেন, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বাণিজ্যিক জল-স্থলের জায়গার অধিকারী করেছেন তবু কেন আমরা পশ্চাৎপদ, তবু কেন আমরা বিজাতির হাতে মার খাচ্ছি? আমাদের সমস্যাবলী ফয়সালা আমরা কি নিজেরা করতে পারি না? ইনকিলাব কেবলমাত্র আহবানই জানায়নি সরেজমিনে কাজও করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এ ব্যাপারে ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন মাওলানা এম.এ মান্নানের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। তিনি ইরান, ইরাক যুদ্ধ বন্ধের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। এ ব্যাপারে গঠিত শান্তি কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের বিশেষ করে আরব জাহানের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তৎকালীন লিবীয় প্রেসিডেন্ট মুআম্মার গাদ্দাফী, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লা সালেহ, জর্ডানের বাদশা হোসেন, ফিলিস্তিনের নেতা ইয়াসির আরাফাতসহ আরো অনেক রাজপুরুষের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করেছেন। তাঁকে বলা হতো মুসলিম জাহানের অঘোষিত রাষ্ট্রদূত। তাঁর সাথে সফরকালে আমি একবার মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মুবারককে বলতে শুনেছি ‘আনতা জেসর বায়না বাংলাদেশ ওয়া দুআলিল আরব’ অর্থাৎ আপনি হলেন বাংলাদেশ ও আরব জাহানের মধ্যকার মৈত্রীসেতু। ইনকিলাবে প্রকাশিত কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখা আরবীতে অনূদিত হয়ে একাধিক আরবী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সঙ্গে ইসলামী উম্মাহর সমস্যা সঙ্কট নিয়ে তথা- বসনিয়া, চেচনিয়া, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়ার সংঘর্ষ নিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে প্রায় তিন যুগ ধরে। অব্যাহত রয়েছে এই উম্মাহর প্রতি ঐক্যের আহবান। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের মতো বলেছে:
‘লাভ-লোকসান এক তোমাদের লক্ষ সবার এক মকাম
এক তোমাদের নবী এবং এক তোমাদের দ্বীন ইসলাম।
এক তোমাদের আল্লা’ এবং এক তোমাদের আল-কোরআন
আফসোস হায় তবু তোমরা এক নহ সব মুসলমান।’
ঐক্যের অভাব যে কেবল মুসলিম দেশে দেশে, তা নয়, বরং প্রতিটিই মুসলিম দেশেই বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে, বিভিন্ন ফেরকার মধ্যে, বিভিন্ন মতবাদের অনুসারীদের মধ্যে আত্মঘাতী সংঘর্ষ বিদ্যমান। হামলা হয়েছে মাজারে, দরগায়, মসজিদে, নামাজরত মুসল্লিদের উপরেও। এর মধ্যে স্বার্থান্বেষী, ধান্ধাবাজ, মতলববাজ লোকদের রয়েছে হীনস্বার্থ, সহজ-সরল আম মুসলমানরা হচ্ছে তাদের স্বার্থের শিকার। ইনকিলাব এমন ফেৎনাবাজ লোকদের যেমন নিবৃত্ত করে যাচ্ছে, তেমনি সরলপ্রাণ মুক্তিকামী মুসলমানদের করছে সতর্ক, নিরুৎসাহিত করছে খুঁটিনাটি ইখতিলাফী মাসআলা, মাসায়িল নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে। ইখতিলাফ বা মতপ্রার্থক্য আগেও ছিল কিন্তু এনিয়ে মারামারি, হানাহানি ইসলামের গৌরবময় যুগে ছিল না। ছিল একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সৌজন্য বোধ। এটা পন্ডিত, গবেষকদের ব্যাপার, তাঁরা একাডেমিক আলোচনা করবেন, নিজ নিজ মতের সমর্থনে দলিল প্রমাণ পেশ করবেন, ইখতিলাফকে কখনো মুখালিফাত বা শত্রুতায় পরিণত করবেন না। আমজনতাকে উত্তেজিত করে দাঙ্গা বাঁধাবেন না, মাদরাসা, মসজিদ, মাজারে অগ্নিসংযোগ করতে যাবেন না। ইনকিলাব সর্বদা এ ফিৎনা নিরসনের চেষ্টা করেছে। ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম.এ মান্নান রহ. যেমন ছিলেন একজন মুহাক্কিক আলেম, তেমনি ছিলেন এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ঘরানার লোক। তিনি ইখতিলাফী মাসায়েলের ব্যাপারে কোনো একমতকে প্রাধ্যান্যও দিতেন, নিজে আমলও করতেন। কিন্তু অপরের মতকে অবজ্ঞা করতেন না, সম্মান দিতেন। সব মতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। তাদের দরবারে, খানকায়, মাদরাসায় যেতেন। দাওয়াত দিয়ে একত্রিত করতেন, খাওয়াতেন তাদের কোনো সমস্যা হলে তা সামাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতেন। উদ্ভূত জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মিলিত কর্মপন্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা করতেন।
মাওলানা এম.এ মান্নান রহ. এর জ্যেষ্ঠপুত্র ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনও তেমনি তাঁর পিতার অনুসরণে বিভিন্ন মতের উলামা-মাশায়েখদের মাঝে সুসস্পর্ক কায়েমের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সব ঘরানার বিশিষ্ট পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামাদের নিয়ে মহাসম্মেলন করেছেন, সবার বক্তব্য শুনেছেন, তাদের নিজ নিজ মসলাক বহাল রেখেও ইসলামের, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত-আহবান জানিয়েছেন। ইনকিলাবের বিভিন্ন লেখায় ও সংবাদ পরিবেশনে সর্বদা তা প্রতিফলিত হয়েছে।
ইনকিলাবের চলা পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবু তার অগ্রগমন কখনও থেমে যায়নি। থেমে যাবে না ইনশাআল্লাহ।
কবির ভাষায় :
‘সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম
সে কখনো করে না বঞ্চনা’।
আজ ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রভাতে দাঁড়িয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম.এ মান্নান রহ. এর সেই কথাগুলো স্মরণ করছি, যা তিনি সংবাদকর্মীদের ডেকে প্রায়ই বলতেন: ‘আমরা ইসলামের ব্যাপারে, দেশের স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বের ব্যাপারে, স্বার্থের ব্যাপারে সর্বদা আপোসহীন থাকব, আমরা কারো কাছে দায়বদ্ধ নই। আমরা জনগণের সমস্যা-সঙ্কটের কথা, অভাব অভিযোগের কথা, দুঃখ-বেদনার কথা, আশা-আকাক্সক্ষার কথা, কল্যাণের কথা, অকপটে বলে যাবো। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত হব না। কোনো কথা লিখব না। আমরা চরমপন্থী হব না, সতত মধ্যপন্থা অবলম্বন করব। দেশের প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকবে, দরদ থাকবে। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য থাকবে। এই নীতি ও আদর্শে অবিচল থাকলে আল্লাহর সাহায্য আসবে। ইনকিলাব সত্যিকার ইনকিলাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।