শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
প্রচন্ড রোদ মা একাই রন্ধনশালায় কাঠ, গাছের শুকনো-পাতা, মাচায় তুলে রাখছেন।যেন বর্ষা মৌসুমে রান্না করতে অসুবিধা না হয়। আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম আজ। আমার বড়ভাই আমার ক্লাসমেট যদিও আমার এক বছরের বড়। নায়ক আলমগীর ওর খুব প্রিয়। আমাকে বলেছে,সিনেমা দেখে বাড়ি আসবে বন্ধুদের সঙ্গে। মা আমাকে একা দেখেই প্রশ্ন করল,
‘রেজা কোথায় ?’
মা রেজা পরে আসবে, আমি একাই চলে এসেছি; কাঁথা-কাপড় নিয়ে।
মা, শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছে দিয়ে বলল, পড়ের বাড়িতে লজিং থেকে তো একেবারে শুকাইয়া গেছিস,শিগগীর হাত-পা ধুয়ে ঘরে আয়। ‘ভাত খাবি।’
মায়ের হাতের খাবার খাওয়ার পর, মনে হচ্ছে অমৃত কিছু খেলাম। তবুও পরাণ আনচান করছে লিখিকে দেখার জন্য। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রইলাম, জানালার একপাশ খুলে। নিবিড় হৃদয়ঙ্গম হয়তো সে আসবে, ধৈর্য আমার অস্তিত্বহীন। তাকে দেখতে না পারায় হৃদয়ে অনল রক্তক্ষরণ প্রবাহিত হতে লাগল। পরের দিন দেখা হয়ে ছিল, ঠিক-ই তবে অস্বচ্ছ বাঁশ ঝাড়, বেত ঝোপঝাড় তার ভেতর দিয়ে। আমার দৃষ্টি ছিল, শুধু এক নজর তাঁকে দেখা। নীল রঙের পোষাকে ওকে দারুণ লাগছিল। আমি বেশিক্ষণ লিখিকে দেখতে পেলাম না। আবডালে চলে গেল হয়তো বিশেষ কোন কাজের জন্য।
গ্রামের মানুষ বলে আমরা ভূতের সন্তান, কারো কথা কর্ণপাত করবার মতো সময় ছিল না। নিজের জীবনের দৃঢ় প্রত্যায় নিয়ে এগিয়েছি, পরীক্ষার ফলাফল দিবে তিনমাস পরে, রেজা আমাকে বলল,
-ঝন্টু চল আমরা ঢাকা যাই।
‘এ তিনমাস কী করবো, চল কোথাও গিয়ে কোন কাজ করি। বাবা তো একা পারে না সংসারের খরচ বহন করতে।
বাবা প্রায় সময় রাগান্বিত হয়ে থাকত। ভয়ে আমরা বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলতাম না। অনেক সময় ইচ্ছে হত কিন্তু বাবার চেহারা চোখের সামনে যখন ভেসে উঠত আর বলা হত না। যা বলার মাকে বলতাম, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য কোচিং করবার অবস্থা আমাদের দু’ভাইয়ের ছিলনা। মাকে রাজি করিয়ে আমরা ঢাকা চলে আসি। তার কয়েক মাস পর রেজাল্ট দিল। আমরা দু’জন-ই রাজশাহী বিভাগের ১০ম ১১ তম স্থান। চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে এলাম।
ভর্তি পরীক্ষা দিলাম ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে,ঢাকাতে ভর্তি হলাম না। রাজশাহীতে ভর্তির বন্দোবস্ত করলাম তার বিশেষ কারণ ছিল!
হঠাৎ করেই ঝন্টুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবনতির দিকে। আমি প্রাইভেট পড়িয়ে যা পাই এবং বাড়ি থেকে যা আসে। তার স্বচ্ছ বিবরণ আমাকে দিতে পারত না ! এ নিয়ে দু’ভাইয়ের দিনের পর দিন অভিমান ঝগড়া লেগেই থাকত, এমন কি প্রতিশোধ এর নেশায় মগ্ন হয়ে উঠল এক সময়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত অবস্থায় জড়িয়ে পরে রাজনৈতিক ও নেশার সঙ্গে। এ নিয়ে বেশ কয়েক দফা, তর্কবিতর্ক হয়েছে, আমাদের মাঝে।বাড়ি থেকে চল্লিশ দিনের জন্য তাবলীগ জামায়াত ও পাঠানো হয়েছে ; কিন্তু সপ্তাহ খানিক ধর্মীয় লেবাস থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ঠিকে থাকেনি। মাকে দেখতাম, এ বাড়ির পানি পড়া, ও বাড়ির গুড় পড়া,তাবিজ দিয়েও ওকে সুপথে ফিরিয়ে আনা দ্বায় হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে আমার সঙ্গে বাবা,মা কথা বলা বন্ধ করে দিল।
লিখির সঙ্গে ঝন্টুর প্রণয়ের পাঁচ বছর অতিক্রম হতে চলছে,সুখে-দুখে কাছে পেয়েছিল। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা কখনো ওদের মধ্যে আসেনি, ওর কাছ থেকে যা পেয়েছিল, এই নিখাদ ভালবাসা টুক না পেলে হয়তো,ভালবাসা কি জিনিস অনুভব করতে পারত না। লিখি ঝন্টুকে আলোর জগৎ দেখিয়েছিল ; তবে তার জন্য শত আঘাত নীরবে নিভৃতে সহ্য করেছে। হয়তো ওর প্রতিদান কোনদিন দেওয়া সম্ভব ছিল না। যদিও দেয় ভালবাসার প্রতিদানেই দিতে হবে। অন্ধকার জীবন থেকে ঝন্টু কোনদিন ফিরে আসতে পারতো না ৃ! তা কখনো কল্পনা করতেও পারিনি সে। সেটাকে সম্ভব করেছিল লিখি। সে ছিল ঝন্টুর কাছে স্বর্গীয় এক মানবী,
‘তোমার এ আকাশের দাম-ই বা কত .. ?’
তার চেয়ে দ্বিগুণ একটা আকাশ দিব তোমায় মেঘ মুক্ত!
কত উপকথা যে, ঝন্টুকে শোনাত লিখি। কোন এক ভুলে। গভীর নিশিতে তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল বেমালুম। একটি ঘোর অন্ধকার নিশিতে নিজেকে চেনা বড় দ্বায়, দুর চিন্তায় ছিল দু’জন অপ্রত্যাশিত কোন অতিথি যেন এ পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে না আসে। বাবা, মায়ের সম্মানের দিকে তাকিয়ে লিখির নিকট হতে প্রণয় সংক্ষিপ্ত করতে থাকে ঝন্টু। আর নিজেকে স্বেচ্ছায় অপরাধীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করায় একটা সময়, আমি মেসে দেখতাম ঝন্টু মন মরা হয়ে থাকত প্রায় সময়।
-‘ঝন্টু সত্যিকার অর্থেই নিরুপায় ছিল।’
লিখির বাবার ছিল অঢেল অর্থ, তবে ঝন্টুর স্বপ্নছিল আকাশসম, বড় মানুষ হবার। অপারগতার কারণে-ই লিখিকে সেদিন আপন করে নিতে পারেনি। পরিবারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে, নিজের প্রণয়ের আত্মপ্রকাশ করাতে ব্যর্থ ছিল সেদিন ঝন্টু। বুকের পাঁজরে দাবানল অবিরত বহমান তবুও নিজের কষ্টকে আড়াল করে সবার সম্মুখে নিজেকে-এ পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ দাবী করে চলেছিল, ঝন্টু। নিজের প্রতি ঝন্টুর প্রচন্ড ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়। তবুও প্রস্তাব দিয়েছিল, পারিবারিক ভাবে। লিখির পরিবার প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এগার বছর পর ৃ.!
-ঝন্টু বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত এক মেয়ে ওর। মেয়েটি তাঁর খালার কাছে থাকে। ঝন্টুর স্ত্রীও ব্যাংকে কর্মরত আজ ৪ বছর হল। সংসারের দু’জন-ই কর্মজীবী হলে যা হয়। মেয়েকে সময় দেওয়া হয়ে উঠেনি একদম। সময় সুযোগ হলে ছুটে যায় মেয়েকে এক নজর দেখতে। অফিসে ফেসবুক ব্যবহার করত চাকরির প্রথম থেকেই। মাস তিনেক হল লিখির ফেসবুক আইডি এর সঙ্গে বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ঝন্টুকে ফেসবুকে পেয়ে লিখি ভীষণ খুশি। ঝন্টু নিজেও পুলকিত হয়েছিল। বেশ ভাল লাগছে এতদিন পর ওকে পেলাম। ক্ষুদে একটি বার্তা ঝন্টুকে দিয়েছিল।
তাতে অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিল ঝন্টুর সম্পর্কে কিন্তু ঝন্টু সহজসরল মানুষ হয়তো সে বুঝতে পারেনি প্রথম থেকেই লিখির চালাকি। লিখি সম্পর্কে জানলাম অনেক কিছু এখন কানাডা থাকে, স্বপরিবারে। পেশায় ডাক্তার, ঝন্টুকে বলেছিল, দেশে আসবে। লিখির বিশেষ অনুরোধ ছিল ঝন্টুর সঙ্গে দেখা করবে সে। ঝন্টু দেখা করতে চাইনি হয়তো প্রথম দিকে ফেসবুকের ইনবক্সে এমন লিখিত নেই। লিখি তাকে বলেছিল-অস্বচ্ছ বাঁশ ঝাড়, বেত ঝোপঝোড় তার ভেতর দিয়ে আমায় এক নজর দেখতে আর আজ ৃ.! ‘ ওর অভিমানী কথা গুলোকে ঝন্টু এড়িয়ে যেতে পারেনি, কোন ক্রমেই।’ লিখি ঝন্টুকে যে ভাবে কাছে পেতে চেয়েছিল। হয়তো ঝন্টুর পক্ষে তা অসম্ভবৃ! এর ভেতরে অনেকদিন কোন খোঁজ- খবর নেই, হঠাৎ করে ঝন্টুর অফিসের ল্যান্ড ফোনে কল করে বলে। আমি লিখি বলছি,
-আমার সঙ্গে দেখা করো প্লিজ ! ওর বাসার ঠিকানা দিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল।
তিনদিন পরে,ঝন্টু দেখা করতে গিয়েছিল।বিদঘুটে অন্ধকার কামরাটি, ঝন্টুর সমস্ত শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। লিখিকে প্রশ্ন করছিল ; হয়তো এমন।
-‘তুমি এত টাকার মানুষ বাড়িটা এত অন্ধকার কেন?’ কোন জবাব দিয়েছিল না। ঝন্টুর হাত ধরে সোজা রুমে ঢুকে গেল লিখি, রুমের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে পিস্তল দিয়ে গুলি করল। ঝন্টু চিৎকার করে বলল,
‘লিখি তুমি ?’
লিখি তার ফেসবুক পেজ এ লিখেছিল;
‘নারীর শরীর ছাড়া আছে কি ?’ যে শরীরের যন্ত্রণা সারাটি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। নিজেকে অপরাধী সাজিয়ে সেই শরীরের শোষণকারীকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী ?’ একযুগ পরে হলেও লিখির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মেয়ে মানুষ প্রতিশোধ এর নেশায় থাকে পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ। থানা পুলিশ অনেক কিছুই হলো। এর ভেতর দিয়ে আসল খুনি বেড়িয়ে গেল নিষ্পাপ হয়ে। আইনের চোখে ধুলো দিয়ে। লিখি বাংলাদেশে এসেছিল মাত্র তিন দিনের জন্য সরকারি একটি কাজে।
‘ঝন্টুর ফেসবুক আইডিটা আমি খুলে দিয়েছিলাম, তখন ইন্টারনেট অনেকই কম বুঝতো, আমার মনে একটা সংশয় কাজ করত। ঝন্টু মারা যাবার প্রায় এক বছর পর ওর আইডি খুলে বুঝতে পারি কে ওর সত্যিকারের খুনি !’ ভাই বিয়োগের বেদনায় আমি পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি অশ্রæ ভেজা চোখে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।