শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
‘১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের মধ্যরাত আনুমানিক ২ টা।আমি তখন গভীর ঘুমে। আমার বেডের পাশে টেলিফোনটি বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে বলল , মিনু আমি জয়নাল বলছি-
আমি অবাক হলাম এতো রাতে তোমার ফোন?
মিনু- খবর ভালো নয়। এইমাত্র খবর পেলাম পাকিস্তানি মিলিটারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন,পিলখানায় ইপিআর এবং ঢাকায় অন্যান্য জায়গায় আক্রমণ চালিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে অসংখ্য লোক মারা গেছে খবর পাচ্ছি। আমি একটু পরে খবর জানাচ্ছি, বলেই ফোন রেখে দিল।
জয়নালের কথা শুনে, আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে উঠে বসলাম।শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল । ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে , তবুও কেন জানি মনে হচ্ছে আমি এখন অন্ধকার কোন কবরের ভেতরে বসে আছি ।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলাম; নিয়ন আলোতে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বুলেটের শব্দ কানে আসতে লাগল, আমার গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো পাশের রুম থেকে একটা গেলাস পানি ভরে মুখে দিতেই হাত থেকে ছুটে পড়ল । সেদিন আর-
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। মেয়েটা আমার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে গেছে। কলেজ বন্ধ, সারারাত- দিন বাড়িতে একা কোথাও যাবার জায়গা নেই।বাহিরে বের হলে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যদি ধরা পড়বে ভয়ে কোথাও তেমন বের হতে দেয়নি, মমতার বাবা নারায়ণগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা।আমি মেয়ের মাথার চুল নেড়ে দিচ্ছি ।
সে রাতে আমার ঘুম উড়ে গেল অতিথি পাখির মতো । সকাল অবধি বসে রইলাম । তার পর থেকে আর কখনো কথা হয়নি । জয়নালের সঙ্গে আমার ।
মমতার বাবা,ছিল সৎ সাহসী দেশ প্রেমিক একজন মানুষ । বঙ্গবন্ধু ছিল তার একমাত্র নায়ক ।
স্বপ্ন দেখত দেশ স্বাধীন হবে । এদেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পারবে । সব সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে ভাবত ‘যে মানুষ বড় হয় সে ছোট বেলা থেকেই বড় হয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহান হৃদয়ের মানুষ ।’
পরের দিন সন্ধ্যায় পাকসেনা আমাকে এবং আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় ; আমি মমতাকে নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। আমাদের ভাগ্যে তাই ঘটে গেল । আমাকে চোখ বেঁধে অন্য জায়গায় নিয়ে গেল । আমি বুঝতে পারছি আমাদের হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে না । মমতা হারামিদের কাছে মাথা নত করিস না মা’ আমরা বাঙালি কার ওদের কাছে কখনো মাথা নত করবো না । আমারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে মরে যাব , তবুও মাথা নত করবো না । পাকসেনাদের ক্যাম্প আমাকে নিয়ে যাবে ঠিক এমন সময়; এক-সেনা বলল,
‘লারকি কো মার ডালো!›
ব্যঙ্গময় হাসি হেসে অন্য একজন আমার শরীর ছুঁয়ে বলছে;
‘না কালী কো দেখী না গোরী কো দেখী
পিয়া জিস কো চাহে সোহাগন ওহী হ্যায় ।› মমতা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে !ওর চোখ দিয়ে হয়তো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ।পৃথিবীটা আমার কাছে বীভৎস অন্ধকার মনে হচ্ছে ! জয়নালের মুখাবয়ব আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে; ‘মমতা তোকে একবার দেখত ইচ্ছে করছে ।› ‘আমার এত কাছে তবুও তোকে দেখতে পাচ্ছিনা ।›
কালো কাপড় দিয়ে মায়ের চোখ বাধা ছিল তখন আমাদের চিৎকার চোখের জলের গ্রোতধারা আবেগের কোন মূল্য অমানুষ পশুদের নিকট ছিল না । মনের ভেতরে বিশ্বাস ছিল আমরা একদিন স্বাধীন হবো বঙ্গবন্ধু আমাদের আদর্শের সেই মহান নেতা কখনো হারতে পারে না ।
বুলেটের শব্দ আমার কানে বার-বার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো । জানোয়ার গুলো মাকে খুন! করলো ।আমি পাথরে পরিণত হলাম সেদিন ।মায়ের মুখটা শেষ বারের মতো দেখতে চেয়েছিলাম; ওরা আমাকে দেখতে দেয়নি।
শতবার চিৎকার করে মাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে চাইলাম, জানোয়ার অমানুষ গুলো আমাকে দেখতে দিল না । সেদিন রাতেই আমাকে বিভিন্ন ভাবে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করলো । আমি প্রাণভিক্ষা চাইলাম ! ওরা কী মানুষ ছিল ! ছিল জানোয়ার। “ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রী তোমাদের মুখে আমি প্রসাব করে দিলাম’’ ।
মাকে খুন করবার দিনই তো আমি মরে গেছি , তোরা একটা মৃত মানুষের সঙ্গে শত বার যেনা করছিস , কুত্তার বাচ্চা । নিজেকে তখনও অসহায় মনে হয়নি। বেঁচে থাকার একটা স্বপ্নছিল দেশ স্বাধীন হবে আমরা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিবো ।
আমাকে ক্যাম্পের পাশে একটা বাড়িতে বেঁধে রাখতো , কোনকোন দিন তিনজন চারজন আমাকে নিয়ে আদিম খেলায় মেতে উঠত ; আমি চিৎকার করতাম আকাশের পাখি গুলো হয়তো কেঁদে উঠত , ঠিক তখন জানোয়ার গুলো হেসে উঠত ।
আমি তখন তিন মাসের পোয়াতী, আমাকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো । আমি আত্মহত্যা করতে চাইলাম? এজীবন দিয়ে কী হবে । আমি একা মরলে কি হবে। দেশের মানুষ যদি ভাল থাকে ।তাদের যদি উপকার করতে পারি, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পাব।
মানিকগঞ্জ থেকে নদী পথে আমি বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। বাবার পরিচয়টা আমাকে দারুণ কাজে দিয়েছিল। আমি নিজে যুদ্ধে যোগ হলাম ,
যুদ্ধ করলাম। দেশের জন্য মানুষের জন্য। বিভীষিকাময় সে দিন গুলির কথা মনে হলে বড্ড কষ্ট হয়।
নিজের কাছে ভাল লাগে, দেশের জন্য কিছু একটা করতে পারছি ।
আমি শারীরিক ভাবে দিন-দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি ; আমার পেটের ভেতর জানোয়ারের বাচ্চা বড় হতে লাগল । আমি ৭নং সেক্টরে চলে আসলাম । বাবার অনেক বন্ধু, পরিচিত লোকজন ছিল । রফিকুল ইসলাম বকুল নামে আমার সঙ্গে একজনের পরিচয় হলো, তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন । সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপখায়িয়ে চলতে শিখতে বললেন , নারীর জন্য তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যুদ্ধ করা খুব কষ্টের বিষয় ছিল । আমি সবসময় ভেবেছি, আমার তো পৃথিবীতে কেউ নেই । বাঙালি যারা আছে তারাই তো আমার মা বাবা, ভাই, বোন । নিজের ভেতরে একটা প্রতিশোধের নেশা কাজ করেছিল । পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে । বকুল কাকার বিভিন্ন পরামর্শ মতো আমি কাজ করতে লাগলাম । বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশে খোঁজ খবর নিয়ে দিতাম । বাঙলার দামাল ছেলেরা রাতের অন্ধকারে পাক সেনাদের চারদিকে ঘিরাও করে , বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করত । ওদের গোপন সংবাদ আমি বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে দিতাম ।
আমি সুজানগর চলে আসলাম , আমার এক দূর সম্পর্কের ফুফুর বাড়িতে । আমি সে খানে কিছুদিন থাকতে লাগলাম । তার কিছুদিন পরে, প্রচণ্ড গুলাগুলি এক দুপুরে । সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া এলাকা জুড়ে রক্তের নদী ভেসে যেতে লাগল ।পাক সেনারা সেদিন সাতবাড়িয়া সহ আশেপাশের গ্রামের হিন্দু মুসলমান সহ প্রায় দুইশত জনের মতো মানুষকে হত্যা করে । একটা সময় যুদ্ধ থেমে গেল । তার কিছুদিন পরেই আমি মৃত সন্তান প্রসব করলাম ! আমি তবুও নিজেকে সুখী মনে করছি । আমার মতন লক্ষ লক্ষ মা›বোনের ইজ্জত নিয়ে পাকসেনা খেলেছে । অপশক্তির দল এখনো গোপনে-গোপনে পাকসেনাদের দালালি করে । মন বলে মুখের উপর থু-থু ছিটিয়ে দেই।
‘ বুকের ভিতর ঐ একটা স্বপ্ন নিয়েই বড় হয়েছি সেটা হলো বঙ্গবন্ধু । মা বাবা মারা গেল, তাদের কবর থাকে আমার মা›বাবার কোন কবর নেই ! কোথায় গিয়ে দুফোঁটা অশ্রু ফেলব । বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি হঠাৎ সজীব হয়ে উঠল । বেতারে ভেসে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা ।জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু । বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মজিব ।মার্চ মাসের সেই ভাষণ আমাকে জাগিয়ে তুলে । আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায় ।
দেশ এগিয়ে চলছে , আমি নতুন একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি , সে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন; এদেশের মানুষ সুখে থাকবে ।এদেশ এগিয়ে যাবে পৃথিবীর সব দেশকে ছাড়িয়ে । স্বাধীনতার গল্প মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে । বঙ্গবন্ধু তুমি সমস্ত পৃথিবীর অহংকার ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।