শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আমার অটোরিক্সায় উঠলেন আমার চাচাত ভাই সাথে তার বউ। বিয়ে করেছে সপ্রতি শুনেছি বউ বেশ লম্বা ছিপছিপে, শ্যামলা। আমার ভাই অবশ্য মোটা ফর্সা মাঝারি লম্বা। দুজন ঠিক এক সাথে হেঁটে এল।
রিক্সাই উঠে ও বলল, তাড়াতাড়ি চালাও। আমাকে তো ও আপনি বলেই সম্বোধন করত। আমি একটু ভাবনায় পড়ি। রিক্সাই ওঠার আগে ও আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিল আমি একটু অপ্রস্তুুত হই। কেমন আছ- বলতে গিয়েও আমি থেমে যাই। সম্ভবত অন্য রিক্সা না থাকায় ওরা আমার রিক্সায় উঠেছে। আমি বুঝলাম ও আসলেই বিব্রত বোধ করছে ওর নতুন বউয়ের সামনে, তার কাজিন অটোরিক্সা চালায়। তাই আমাকে আপনি বাদ দিয়ে তুমি বলছে। আমি ওর চেয়ে প্রায় পাঁচ বছরের বড়। একটু ভিন্ন ধরনের পারিবারিক শিক্ষায় আমরা বড় হয়েছি। বয়সে বড় হলে আমরা আপনি সম্বোধন করি, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি এটাকে বলি ‘কদমবুছি’।
এতক্ষণ পর আমার একটু ভাল লাগল। আমি ওর সাথে কথা বলিনি। তাহলে ও বিব্রত হও ওর নতুন বউয়ের সামনে।
আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমি আমার মায়ের সাথে আমাদের বাড়িতে থাকি। আমার ভাই বোনেরা সবাই বড় বড় চাকুরী করেন, কেউ এখানে থাকেন না, শুধু আমি আর মা। মায়ের বয়স প্রায় শেষ দিকে। আমি সকালে রিক্সা নিয়ে বের হই সকাল সাতটায় তার আগে চা বানাই রান্না করি, মা আর আমি একসাথে খাই। এর পর আমি বের হই রিক্সা নিয়ে। আমি বেশী লেখাপড়া করতে পারিনি এটাই আমার মায়ের জন্য আর্শীবাদ আমি আছি মায়ের সাথে আমি দুপুরে ফিরি প্রায় ৩টায়। বাসায় ফিরলে মা আর আমি একসাথে খাই তারপর আমি আবার বের হই। সন্ধ্যার পর আর অটোরিক্সা চালাই না। বাজার নিয়ে রান্না করি। মা দুপুরে রান্না করেন, আমি সকালে আর রাত্রে। মায়ের হাটুতে ব্যাথা মেরুদন্ডে ব্যাথা। ডায়াবেস্টিস, ব্যাথা নিয়ে মা ঝুকে ঝুকে বাঁকা হয়ে হাটেন, আমি ব্যাথার বড়ি কিনি, আমার বড় বড় ভাই বোনেরা খেয়াল করলে মায়ের চিকিৎসা একটু ভাল ভাবে হতে পারত।
বাবা মারা গেছেন প্রায় ১১ বছর আগে। তারপরই মা বেশী ‘যয়ীফ’.... হয়ে গেলেন। চিন্তা করতে করতে বাসার প্রায় কাছে চলে এলাম। আমাদের বাড়ী ছোট্ট ভাঙ্গাচোরা একতলা, রিনোভেশন হয়নি কতদিন, কেউ খেয়াল করেনি-আমার অবশ্য খুবই ভাললাগে। বাড়ীর সাথে বেশ অনেকখানি জায়গা অনেক গাছপালা আমি লাগিয়েছি বেশীরভাগ পাতাবাহার। পাতাবাহার আমার খুব পছন্দ। বিভিন্ন জায়গায় থেকে জোগাড় করা সারি সারি রং এর সাথে রহ. মিলিয়ে।
আমার ভাই এর বউ রিক্সা থেকে নেমে বলল কি চমৎকার দেখ সন্তু। এত সুন্দর পাতাবাহার বাগান আমি জীবনে দেখেনি। আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, এটা আমার বাগান। শেষে সামনে নিলাম। কাজিন আমাকে ভাড়া দিলো। একবার মনে করলাম নিব কেন? পরক্ষণেই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভুল ভাঙ্গল। ঐ চোখে আছে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা, ভয়, বিব্রত হওয়ার আশংকা। আমি যদি ওর নাম ধরে ডাকি, ওর বউ যদি বুঝে ফেলে আমি তার জামাই এর কাজিন!
অটো নিয়ে আমি খুব দ্রæত সরে পড়ি। আমার মা কি বিষয়টা বুঝবেন। আমি আশংকায় থাকি। আচ্ছা আজ দুপুরে আমি কোথায় খাব? বাসায় তো আর ফেরা যাবে না। মা কি বলে ফেলবেন তার এক ছেলে অটো চালায়। না খেয়ে মত অপেক্ষঅ করবেন আমার জন্য। আমি কি করব? আমার কাজিনের নাম সন্তু। যদি আজ ওরা আমাদের বাড়ী থাকে তবে আমি রাত্রে কোথায় থাকব? ওকে তো লজ্জা দেয়া যাবে না। ও ল পাশ করে শুনেছি চাকুরী করে। জজ অর্থাৎ বিচারক। অনেক বড় মানুষ। আমি আতংকিত হই। ওরা যদি বেশ কদিন আমাদের বাড়ী থাকে। আমি কখনও বাড়ীর বাইরে থাকিনি। এই বাড়ীর একটা রুম একটা বিছানা আমার নিজস্ব। বাবার মৃত্যুর পর বাবার রুমেই আমি থাকতে শুরু করি। এখানে খাটে, জানালায়, ছোট্ট আলনায় বাবার স্মৃতি খুঁজে পায়। মনে হয় বাবা বুঝি আমাদের দেখছেন আমাকে আর মাকে। মা সোজা হয়ে হাটতে পারেন না আমি বেশ রুগ্ন লম্বা একটু কুঁজো হয়ে হাঁটি, আমার গায়ে শক্তি কম।
বাবাতো শেষ দিকে আমাকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তা করতেন। সবাই তো খুব ভালো আছে। আমি বাবাকে বলতাম চিন্তা কর না বাবা আমি এ শহরেই থাকব ঠিকই একটা চাকুরী বা কোন ব্যবসা শুরু করব-কোনটাই হয়নি অটো চালায় আর মনে হয় আমার দু:খে বাবা বুঝি মন খারাপ করেছেন। আমি বলি বাবা আমি তো মাকে নিয়ে আছি তোমার শহরেই তোমার অন্য ছেলেমেয়েরা তো মাকে কখনও রান্না করে খাওয়াতে পারে না।
মা আমাকে ফোন দেন। তোর রিক্সায় নাকি ওরা এসেছে? সন্তু অনেক ভয় পাচ্ছিল ওর বউ যদি বুঝে ফেলে তুই ওর কাজিন। ওর বউতো ডাক্তার। তুই বাবা আজ রাতে বাড়ী আসিস না তোর খালার বাসায় থাকবি খেয়েছিস তো? চিন্তা করনা মা অসুবিধা হবে না- ফোনটা কেটে দিই। শেষ কথায় মায়ের গলাটা কি একটু ভারী মনে হল। কি যেন মা বলতে চাইলেন আমি ফোনটা কেটে দিলাম। আমি দুপুরে কিছু খেলাম না, খেতে ইচ্ছে করল না, রিক্সা চালালাম সারাদিন ক্লান্ত হয়ে একটা গ্যারাজ-এর সামনে দাঁড়ালাম। এখানেই আমি আজ থাকব। সন্ধ্যা হল, আজ আমি প্রথম বাড়ীর বাইরে রাত কাটাচ্ছি। রাতে মনে হয় কিছু খেতেই হবে। আমি কখনও খিদে সহ্য করতে পারি না, একটা রেষ্টুরেন্টে গেলাম। খাব। খেতে পারলাম না। এরচেয়ে আমার রান্না অনেক ভালো, মায়ের রান্নার তো তুলনা হয় না। গলার কাছে বার বার খাবার আটকে যাচ্ছে। এমন লাগছে কেন বুঝতে পারছি না।
আবার গাড়ীতে এসে বসি। বাবা খুব সামান্য সরকারী চাকুরী করতেন সৎ ছিলেন আমরা অনেক ভাই বোন বেশ কষ্টে বড় হয়েছি। টাকার টানাটানি ছিল, অবশ্য অন্যরা খুব মেধাবী ছিলেন সবাই ম্যাট্রিক ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করল, তারপর ভার্সিটিতে ভর্তি হল অথচ আমার পড়াশুনাই হল না। রিক্সার পেছনছিটে ঘুমাতে গেলাম। আমি শোওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে যায় আজ ঘুম আসছে না।
বাবা শেষ দিকে আর হাটতে পারতেন না, অতি কষ্টে বাথরুমে যেতেন তারপর একদিন স্ট্রোক করলেন, আমি মা উনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তিন দিন পর উনি মারা গেলেন। সবাই এসেছিল তাঁর মৃত্যুর পর। অনেক কান্নাকাটি করলাম আমরা। তিন দিন পর খানা হল বিশাল খানা, শহরের সব গণ্যমান্য লোক এল সে খানায় কত টাকা যে খরচ হল, অথচ বাবার ঠিকমত চিকিৎসা হয়নি শুধু টাকার অভাবে। তিন দিন পর সবাই চলে গেলেন কি যে এককিত্ব, বুঝানো মুশকিল। প্রতিদিন ঘুমালে মনে হত বাবা বেচে আছেন ঐ যে বাবা যায় নামাজে। নামাজ পড়ছেন লম্বা টুপি মাথায়, আমি আসলে স্বপ্ন দেখেছি মনে হত না ঘুম ভাঙ্গলে খুব কষ্ট হত, বুঝতাম বাবা আসলেই মারা গেছেন শব্দ করে কাঁদতাম, মা কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেলেন।
কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই। মনে হল বিচারকের এজলাসে আমার কাজিন, কাঠ গড়ায় আমি হাত জোড় করে। গভীর গলায় উনি বলছেন অটোরিক্সা চালিয়ে আমাদের পরিবারের সম্মান তুমি ভুলুন্ঠিত করেছ। তোমার ১০ বছরের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, আমি কাঁদতে থাকি, আমাকে এবারের মত মাফ করে দেন আমি আর অটো চালাব না সত্যি সত্যি। কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, স্বপ্ন দেখছিলাম আমি আজ ফিরব আমার বাসায়, ওরা চলে গেছে ব্যাস্ত মানুষ-আমার জীবন আপাতত : মাকে নিয়ে আবারও একইভাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।