শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
জমিদার রবীন্দ্র নাথ সম্পর্কে অমিতাভ চৌধুরি দেশ,শারদীয় সংখ্যায় লেখেন-’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামন্তবাদী প্রজাপীড়ক জমিদার ছিল। তার দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধি এবং জোর-জবরদস্তি করে তা আদায়ের বিরুদ্ধে ইসমাইল মোলার নেতৃত্বে শিলাইদহে প্রজা বিদ্রোহ ঘটেছিল।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার তখনকার কবিতা, কাব্য নাটকে মুসলমানদের ¤েøচ্ছ, যবন প্রভৃতি আপত্তিকর শব্দে চিত্রায়িত করেছেন। তার ‘রুদ্রচন্ড(১৮৮১) কাব্য নাট্যে আছে:
ম্লে’ছ সেনাপতি এক মুহম্মদ ঘোরী
ত¯‘রের মত আক্রমিতে দেশ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সতী’ কবিতাটি মারাঠাদের দস্যু রুপে না দেখিয়ে বীর রুপে উপস্থাপনের অপকৌশল। তার ‘কথা’ গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলো - ‘বন্দীবীর’, ‘মানী’, ‘প্রার্থনাতীত দান’, ‘শেষ শিক্ষা’, ‘হোরীখেলা’, ‘বিচারক’ প্রভৃতি কবিতা মূলত রাজপুত ও শিখ বীরত্ব বিষয়ক যেখানে মুসলিম বীরদের খারাপ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা তাদের কবিতায় দেশ,মাটি,মানুষ,ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এসেছেন।তারাও তাদের অনেক কবিতায় নিজ ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন।কিন্তু নিজ ধর্মকে বড় করতে গিয়ে অন্য ধর্মের দুর্নাম করেননি।বরং স¤প্রীতির জয়গান গেয়েছেন।ইসলাম একটি উদার-অসা¤প্রদায়িক সার্বজনীন ধর্ম।ইসলাম একটি মানবতাবাদী-বৈশ্বিক শান্তিকামী মতাদর্শ। ইসলাম বহুজাতিক সহাবস্থানে বিশ্বাসী স¤প্রীতিময় একটি মতবাদ।এখানে সাদা কালো,ধনী-গরীব,উঁচু-নিচুতে কোন ভেদাভেদ নেই।কোরআনের সুরা আল-আনআম ১০৮ নং আয়াতে আছে-’ইসলাম কখনো কারো ধর্মীয় দেবদেবীকে কটাক্ষ করতে বা গালি দিতে বারণ করে।’ তাই বাংলা সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের রচনায় অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করা কবিতা পাওয়া যায়নি। (অসমাপ্ত)
আধুনিক বাংলা মুসলমান কবিদের মধ্যে কায়কোবাদের (১৮৫৭-১৯৫১) আসন বিশিষ্ট রুপে চিত্রিত।তার রচিত ‘মহাশ্মশান’ কাহিনী কাব্যের ধারায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেছে।আধুনিক বাংলা কাহিনী কাব্যের ধারায় রঙ্গলাল,হেমচন্দ্র প্রভৃতি হিন্দু বীরের মাহাত্ম বর্ণনা করতে গিয়ে মুসলমানকে প্রতিপক্ষরুপে ও হীনবর্ণে চিত্রিত করেছেন।কিন্তু কায়কোবাদ সা¤প্রদায়িক কোপমুন্ডুকতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে মানবিক মননের পরিচয় দিয়েছেন।এখানে জোহরা ও ইব্রাহিম কার্দির প্রেমের প্রকাশ করতে গিয়ে সা¤প্রদায়িকতার কোন স্থান দেননি কায়কোবাদ। ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্যের একবিংশ সর্গে আতাখাঁর অনন্যচিত্ত প্রেমিকা হিরণের সংলাপ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে কবির চিন্তার বিশেষ রুপটি প্রতিফলিত।মুসলমান আতাখাঁকে ভালোবাসার কারনে হিরণের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর:
মুসলমান ম্লে’ছ নহে,নহে নীচ জাতি,
অনর্থক গালি কেন দেও তাহাদেরে!
একই পিতার পুত্র হিন্দু-মুসলমান-
পরস্পর ভাই ভাই,নহে তারা পর----
জাতি ভেদ ভুলে যাও,হিন্দু-মুসলমান
ভারতের প্রিয় পুত্র সবি এক জাতি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উলেখ্যযোগ্য মুসলমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন(১৮৪৮-১৯১০) তার রচিত ‘সঙ্গীত লহরীতে’ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের স্বপ্ন দেখেছেন।যেমন:
ভারত সভা জাতি সভা হ’েছ দলে দলেরে।।
নাই ভেদাভেদ কোন প্রভেদ হিন্দু-মুসলমান।
ক্রমে ক্রমে হইতেছে এক দেহে এক প্রানরে।।
ইসমাইল হোসেন সিরাজী(১৮৭০-১৯৩১) স্বাধীনতার অক্লান্ত সৈনিক ও মুসলিম পূনর্জাগরণের কবি।ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ইসলাম ও স্বাজাত্যবোধ এতই প্রবল ছিল যে,তিনি স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রামী ছিলেন।বলকান যুদ্ধে তুর¯ে‘র রাষ্ট্র ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ায় সদলবলে ভারতীয় কংগ্রেসের পরবর্তী কালীন সভাপতি ডাক্তার মুখতার আহমদ আনসারীসহ ইসমাইল হোসেন সিরাজী তুর¯ে‘ গমন করেন।তিনি ভারতের মুসলমানদের পরাজয় ও পতন দেখে আহত বোধ করেছিলেন। তাইতো ‘অনল প্রবাহ’ কাব্য দ্বারা ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার আহŸান জানান কবি।
মানবতার কবি,সাম্যের কবি,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতোই আবির্ভূত হন।সমকালীন হিন্দু-মুসলমান সমস্যা দেখে ধর্ম নিরপেক্ষ মানবতাবাদের কল্পনায় কবি কবিতা লেখা শুরু করেন।তার অন্যতম জনপ্রিয় ও আলোড়িত কবিতা ‘বিদ্রোহীর’ মাধ্যমেই কবি হিন্দু-মুসলমানের স¤প্রীতির স্বপ্ন বুনেছেন।এই কবিতায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকে আহরিত শব্দ,উপমা,রুপক ও বাকভঙ্গি ততকালীন সবার মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।কবির উ’চারণ যেমন:
আমি বেদুঈন,আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ।
আমি বজ্র,আমি ঈশান বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইগ্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার
আমি পিণাক পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ,আমি প্রাননাদ প্রচন্ড।
তিনি দেশের তরুন সমাজকে উদার মানবতার উ’চাদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দের উর্ধ্বে ওঠার আহŸান জানান।আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি যিনি সমান দক্ষতার সাথে হিন্দু ও মুসলমানের ঐতিহ্যকে কাব্যে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯২৬ সালে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মলনের উদ্ভোধনী সংগীত রুপে তিনি ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি রচনা করেন। এখানে তিনি বলেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃ মুক্তি পণ! ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম!’ ওই জিঞ্জাসে কোন জন!
কান্ডারী!বলো,ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!
নজরুল মানসে হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে পরিপূরক হতে পেরেছে তার সাম্যবাদী চিন্তার ফলে।তিনি উ’চ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন,’হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।’ ‘সাম্যবাদ’ কবিতায় কবি বলেন-
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
এটাই বাংলা কবিতার মূল সুর।অসা¤প্রদায়িকতা বাঙ্গালীর হাজার বছরের সাধনা।সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কন্ঠে ও তাই আমরা শুনি এই সুরের মূর্ছনা।বাংলা কবিতার এই চির বহমান সুর বেঁচে থাকুক সবার হৃদয়- মননে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।