বাংলা সন ইসলামী ঐতিহ্যেরই অংশ
বাংলাসন ইসলামী ঐতিহ্যজাত। এ সনের উদ্ভাবন ঘটেছে হিজরিসন থেকে। এর উদ্ভাবন, প্রবর্তন সবই মুসলমানরা করেছে।
বাঙালি জাতিসত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ দিন পহেলা বৈশাখ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই প্রাণের উচ্ছ¡াসে মাতে এ দিনে। সব ভেদাভেদ ভুলে।
অন্তরের টানে মানুষ একে অপরের কাছাকাছি আসে। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে সবার ওপরে মানুষ সত্য-এ বিষয় উপলব্ধি হয় মর্মে মর্মে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিদেশি অপসংস্কৃতি রোধে এটি একটি গ্রহণযোগ্য বাস্তব পদক্ষেপ। তবে পহেলা বৈশাখের আয়োজন যেন শুধু ফ্যাশনভিত্তিক হয়ে না ওঠে, বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব মর্মে অনুধাবন করতে হবে এবং সেভাবে সামাজিক পরিবেশ সুবিন্যাস্ত করতে হবে। বৈশাখের অস্তিত্ব আমাদের হৃদয়ে গ্রথিত। সমগ্র অস্তিত্বে বৈশাখ প্রভাব ফেলে। এ প্রভাব থেকে সমাজের কোনো স্তরই বাদ পড়ে না। কবি-সাহিত্যিকগণ বৈশাখ বিষয়ে আন্দোলিত হন। তারা গদ্যে ও কাব্যে বৈশাখের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করেন। ধ্বংস-সৃষ্টি, বিরহ-মিলন, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সব কিছুই উঠে আসে শিল্পীদের বিভিন্ন প্রকার শিল্পের বাঁকে বাঁকে। সাহিত্যে বৈশাখের পদচারণা ব্যাপক। ঋতুভিত্তিক সাহিত্য চর্চার ইতিহাস এ জাতির সুদীর্ঘ। শিল্পের বিভিন্ন শাখার বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে লিভ লিও টলস্টয় বলেছেন, ‘মানুষের অর্জিত অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়ে যখন বহিঃপ্রকাশের জন্য ক্রিয়াশীল হয়, তখন তা শিল্পে পরিণত হয়। যদি অনুভূতি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ পায়-তখন সেটি সাহিত্য, যদি শারীরিক দোলার ভেতর থেকে প্রকাশ পায়- সেটি নৃত্য, যদি সুরের মাধ্যমে প্রকাশ পায় সেটি সঙ্গীত, যদি রঙের মাধ্যমে প্রকাশ পায়- সেটি চিত্র প্রভৃতি।’ ঋতুর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সহজেই সাহিত্যিকদের আন্দোলিত করে, বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। সম্রাট আকবরের সময় থেকে খাজনা আদায়ের মাস বৈশাখ থেকে শুরু হলেও বর্তমানে তা পরিবর্তীত হয়ে প্রাণের মেলার উৎসবে পরিণত হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকগণ প্রাণের মেলার এ উৎসবকে শব্দে ধরে রাখতে বারবার প্রয়াসী হয়েছেন।
কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫৪০-১৬০০ খ্রি:.) বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। চন্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতু ও ফুলরার দাম্পত্য জীবনের সুখ-দুঃখের বর্ণনা দিয়েছেন চমৎকারভাবে তাদের জীবিকা ছিল কাঠ কাটা ও পশু শিকারের ওপর নির্ভরশীল। ফুলরা বাড়ি-বাড়ি মাংস বিক্রি করে। কিন্তু সব সময় বিক্রি এক রকম হয় না। মাঝে মাঝে বেশ কষ্টে দিন কাটে। কবি কষ্টের বর্ণনায় প্রচন্ড দাবদাহের মাস বৈশাখের কথা স্মরণ করেছেন। গ্রীষ্মের দাবদাহ জীবিকা অর্জনে অনেক সময় অনেক বেশি দুরূহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। প্রাকৃতিক বিরূপ অবস্থা স্বাভাবিক কাজে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বলেছেন,
বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিকে পসরা \
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে খুঞ্চার বসন \
নিযুক্ত করিল বিধি সবার কাপড়।
অভাগী ফুলরা পরে হরিণের দুড় \
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.) ঋতুচক্রের গতিশীলতা, মানব ও প্রকৃতির অবস্থা, শাশ্বত ঘূর্ণনের বন্ধন সব কিছুকে চমৎকারভাবে তার চতুর্দশপদী কবিতা ‘নতুন বৎসর’ এ উল্লেখ করেছেন,
ভূতরূপে সিন্ধুজনে গড়ায়ে পড়িল
বৎসর কালের ঢেউ, ঢেউর গমনে
নিত্যগামী রথ চক্র নীরবে ঘুরিল
আবার আয়ুর পথে হৃদয় কাননে
কত শত আশা লতা শুকায়ে মরিল
হায়রে কব তা কারে, কবিতা কেমনে
কি সাহসে আবার তা রোপিব যতনে
সে বীজ, যে বীজ ভূতে বিভল হইল
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি:) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঋতুভিত্তিক লেখা লিখেছেন। বৈশাখের বারতা তার কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নিমগ্নভাবে বৈশাখ বন্দনা করেছেন। একদিকে বৈশাখের ধ্বংস রূপ, পাশাপাশির নতুন বছরের আগমন সৃষ্টিকে নতুন রূপে উৎসাহিত করে, এমন সত্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতা।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রæ বাষ্প সুদূরে মিলাক
মুছে যাক সব গ্লানি। মুছে যাক জরা
অগ্নিস্নানে দেহে-প্রাণে শুচি হোক ধরা
বৈশাখের মতোই রুদ্র, আশান্ত, বিপ্লবী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি:)। বৈশাখের আগমনে মুক্তির উল্লাসে কবি মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। নতুনের আহŸান ও সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি উদ্দীপ্ত হন। কাব্যিক ব্যঞ্জনার মাধ্যমে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন,
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নূতন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন
তাই যে এমন কেশে-বেশে
মধুর হেসে
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪ খ্রি:) একজন জীবনঘনিষ্ঠ নিমগ্ন কবি। তার কবিতায় অনুভূতি ব্যাপক ও দীপ্রতর। কবিতার ভেতর আধুনিক মনস্কতার প্রয়োগ সফলভাবে করেছেন। তার কবিতা মানব মনের জটিলতাকে উন্মোচন করে। বৈশাখ নিয়েও কবিতা লিখেছেন বৈশাখকে উন্মোচন করেছেন সাদা মেঘের ভেলা ও সাদা কড়ির সাথে। বৈশাখকে তিনি শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। ‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি’ কবিতায় লিখেছেন,
ঘুমিয়ে পড়ব আমি একদিন
তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা
যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়
কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৯-১৯৭৪ খ্রি:) বৈশাখকে বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যে অভিহিত করেছন। বৈশাখের রুদ্র রূপ কবিকে আন্দোলিত করে, আলোড়িত করে। তিনি বৈশাখকে বিপ্লবের প্রতীক, জঙ্গিনির্ভীক আপোষহীত সৈনিক হিসেবে দেখেছেন। ‘বৈশাখ’ কবিতায় তিনি বলেন,
সংগ্রামী তোমার সত্তা অদম্য, অনমনীয় বজ্র দৃঢ় প্রত্যয় তোমার
তীব্র সংঘর্ষের মুখে বিশাল সৃষ্টিকে ভেঙে অনায়াসে কর একাকার
সম্পূর্ণ আপোষহীত, মধ্যপথে কোন দিন থামেনা তো জানে না বিরতি
তোমার অস্তিত্ব আনে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত গতি
প্রচন্ড সে গতিবেগ ভাঙে বস্তি, বালাখানা, ভেঙে পড়ে জামশিদের জাক
লাভ-ক্ষতি সংজ্ঞাহীন, নিঃশঙ্ক, নিঃসঙ্গ তুমি
হে দুর্বার, দুর্জয় বৈশাখ।
কবি আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫ খ্রি:) বৈশাখকে কল্যাণময় হিসেবে দেখেছেন। বৈশাখ নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। সে যেন সব শুভ সংবাদের বার্তাবাহক। কবি বৈশাখকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। নতুনের আগমন সাড়া জাগায় প্রকৃতি প্রাণে। ‘হে বৈশাখ’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
মৃগনাভি-দুলনায় নিজেকেই নিজে মুগ্ধ করে রেখেছ
ঊষার লালিত্যে
আর মধ্য দিনের আগমনে তুমি অকৃত্রিম
তোমাকে আমি কী দিতে পারি
কী দেব বলো হে বৈশাখ
কবি সুকান্ত ভট্টচার্য (১৯২৬-১৯৪৭ খ্রি:) বৈশাখকে দেখেছেন ভিন্ন মাত্রায়। বৈশাখের আগমনে প্রকৃতি যেমন নবরূপ গ্রহণ করে, তেমনি মানব মনেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগা স্বাভাবিক; তবে সে পরিবর্তন হোক কল্যাণমুখী, সৃষ্টিশীল। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায় এ ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজনীয়। কবি বৈশাখকে প্রকৃতি ও মানুষের নবরূপে জেগে ওঠার অফুরন্ত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ‘বৈশাখী’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
এসো এসো এসো হে নবীন এসো এসো হে বৈশাখ
এসো আলো এসো হে প্রাণ ডাক কালবৈশাখীর ডাক
বাতাসে আলো ঝড়ের সুর
যুক্ত করো নিকট দূর
যুক্ত করো শতাব্দীতে দিনের প্রতিদানে
নাগরিক কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬ খ্রি:) বৈশাখকে অভাব, অনটন, যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। দৈবদুর্বিপাককে নিয়তির লিখন হিসেবে তাচ্ছিল্য করেছেন। তবু মানুষ নিজের ভেতরে বড় একা; আর কখনো খুব বেশি অসহায়।
রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ
কাল বোশেখের তান্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে
বৈশাখকে নিয়ে বহু কবি-সাহিত্যিক কাব্যে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। চমৎকারভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে তারা বৈশাখের জয়গান ও নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক কবিই বৈশাখ নিয়ে লিখেছেন। বর্ষের শুরু, গ্রীষ্মের দাবদাহ, পানির অভাব, ফলের সম্ভার সব কিছুই তাদের লেখায় ফুটে উঠেছে সাবলীলভাবে। বৈখাশ নিয়ে যারা লিখেছেন, তাদের ভেতর আরও রয়েছেন- সর্ব কবি সৈয়দ আলী আহসান, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান, মোখারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী আশরাফ, আবুল হোসেন, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, মোহাম্মাদ মনিরজ্জামান, শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, আফজাল চৌধুরী, ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান প্রমুখ। এছাড়া আরও কবি-সাহিত্যিকগণ তাদের কাব্যে বৈশাখের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নববর্ষের চেতনা-বৈশাখের আগমন জাতিসত্তাকে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।