Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৫ অক্টােবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

গলিতে নোবেল

অয়েজুল হক | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

রাতুল সাহেব ওনার বিড়ালের নাম রেখেছেন ওল্ডম্যান। তার যুক্তি মানুষ যদি পশুপাখির নাম টাইগার, লায়ন, টিয়া,শালিক, দোয়েল, কোয়েল রাখতে পারে তাহলে পশু পাখির নাম কেন মানুষ জাতের সাথে মিলিয়ে রাখা যাবেনা। তার বিড়ালটি বয়স্ক বলে ওল্ডম্যান নাম রেখেছেন। ইচ্ছা আছে একটা অল্প বয়স্ক বিড়াল এনে নাম দেবেন, ইয়ং ম্যান। সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হয়ে তিনি এখন কর্মহীন। কাজের ভেতর ঘুমানো, বাড়ির পাশের একটা দোকানে চা খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে পড়ে থাকা। সকাল বেলা পেপার আসলে পেপার পড়া। রাতুল সাহেবের একমাত্র মেয়ে নিশির সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করার সুযোগ নেই। লেখাপড়া শেষ করেই ভাল একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব শুরু করেছে। সারাদিন ব্যস্ত চাকরি নিয়ে, বাড়ি ফিরে ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে। মানুষ দিন দিন মমতাহীন হয়ে যাচ্ছে। পরিবারেই নিরাপত্তাহীন পারিবারিক মানুষ। দেশে ঘটে চলা ঘটনা গুলোয় মন খারাপ হয়। রাতের বেলা মন খারাপের পরিমাণ টা আরও বাড়ে। তিনি একবার তার স্ত্রীর কক্ষের, একবার মেয়ের, একবার নিজের শোবার ঘরের পাশ দিয়ে পরিভ্রমণ করেন। সৌরজগতের মতো এটা রাতুল সাহেবের একটা জগত! চক্কর দেয়া। তিনি এ জগতের গ্রহ না নক্ষত্র সেটা পরিস্কার নয়। রাতের বেলা বিড়াল ওল্ডম্যানও তার সাথে চক্কর দেয়। তাকে এ জগতের উপগ্রহ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।
নিশি অবশ্য পিতার এ পরিভ্রমণ কে ভালো চোখে দেখে না। তার ধারণা বাবা ব্যক্তিগত ব্যপারে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। লিটন তার কলেজ জীবনের বন্ধু। বর্তমানে ভবঘুরে। রাস্তার মানুষ গোনাই তার কাজ। তারপরও লিটনের প্রতি একটা টান আছে। অবসর পেলেই তার সাথে যোগাযোগ করে। আজ সন্ধ্যায় তার সাথে আড্ডা দেয়ার কথা ছিল। সে আসেনি। তারপর থেকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, রিসিভ করছে না। রাত একটার দিকে লিটন যখন ফোন রিসিভ করে তখন ব্যাটারির চার্জ প্রায় শেষ। মেজাজ, দেমাগ, রাগ সব উজাড় করে বলে, তুমি একটা খারাপ লোক।
- হুম,খুবই খারাপ লোক।
- তুমি আমাকে মোটেই ভালোবাস না।
- হু, মোটেই না। খুবই খারাপ বাসি।
- তাহলে আমার নাম্বার টা ব্লক লিস্টে ঢুকিয়ে দাও।
- কেন! ব্লক করা ভালো না।
- ভালো।
- যদি তোমার সমস্যা হয় তুমি সেটা করতে পার। তুমি এমন কিছু করনি যে ব্লক করতে হবে।
- তোমাকে পেলে আচ্ছা মত দিতাম।
- আমি তো আছিই তবে পেলে বা ম্যারাডোনা হতে পারবো না।
- শয়তান কোথাকার, গালি দেব কিন্তু।
- অলরেডি দিয়ে ফেলেছ।
- এই চাইতেও বেশি দিতে পারি।
- খুব ভালো, পারফরম্যান্স ধরে রাখলে উন্নতি হবে। নোবেল পুরষ্কার পেতে পার। মানুষ শান্তিতে নোবেল পায় তুমি পাবে গালিতে। গালি নোবেল।
- কী, এভাবে বিদ্রæপ?
রাতুল সাহেব বাইরে চক্কর দিচ্ছিলেন। মেয়ের চিতকার শুনে ছুটে আসেন, কী হয়েছে?
নিশি গম্ভীর গলায় বলে, কিছু হয়নি বাবা।
- কিছু না হলে চিতকার করছিস কেন?
ওল্ডম্যান কাতর গলায় ম্যা ম্যা করে ওঠে। রাতুল সাহেব বলেন, ওল্ডম্যান কী বলছে জানিস?
- না, জানিনা।
- সে বলছে তোর মেজাজ খারাপ। দ্রæত সরে পড়তে।
- তাহলে সরে পড়।
- দেখ, ওল্ডম্যানের সব কথা শুনতে হবে এমন কোন কথা নেই।
- তুমি তোমার ওল্ডম্যান কে নিয়ে চলে যাও।
- না, কিছুক্ষণ গল্প করব।
বাবা তোমার বকবকানি আমার একদম ভালো লাগেনা। বকবকানির ওপর নোবেল চালু থাকলে তোমার একটা চান্স ছিল।
রাতুল সাহেব বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন, গো টু হেল।
নিশি ভেতর থেকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজা কথা বলতে পারলে তার কথা হতো, আমি জড় বলে এমন নিষ্ঠুর আচরণ শোভনীয় নয়।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পাওয়া একটা অভিশাপ। অভিশপ্ত জীবনে কাউকে জড়াতে নেই। নিশি মেয়েটাকে কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে লিটন। তার জীবনে কোন রুটিন নেই। আপাতত পথে পথে ঘোরা ই তার কাজ। কতো রাত অনুমান করতে পারেনা। চিপা চাপা গলিপথ ধরে এগিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ একটা কালো কুকুর তার পিছুপিছু আসছে। সে দাঁড়ালে কুকুর ও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কুকুরের কোন নাম আছে কিনা শুনে দেখা দরকার। নিশির বাবা রাতুল সাহেবের বিড়ালের মতো কোন নাম। হাত দশেক দূরে থাকা কুকুর কে লক্ষ্য করে বলে, এই কী নাম তোর?
কুকুর টা ঘাতঘোত শব্দ করে লেজ নাড়ে। কিছু একটা বলে বশ্যতা স্বীকার করা ভাব। কুকুরের ভাষা আছে? থাকতে পারে। হয়তো মানুষ সে ভাষা বোঝে না। লিটন আবার বলে, আমার পিছুপিছু আসছিস কেন?
কুকুর টা যেন বুঝতে পারে। রাগ হলে মানুষ যেমন বড় বড় পায়ে চলে যায় কুকুরের চলা যাওয়া তার চেয়ে দ্রæত। মানুষ দুই পায়ে যায় কুকুর যায় চার পায়ে। সামনে অন্ধকার চিপা গলি। একেবারে ফাঁকা। এদিকটাতে লোকজনের আনাগোনা কম বলে মনে হয়। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন জামার কলার চেপে ধরে। মুহুর্তেই আরও কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে। ক্যাক ক্যাক শব্দের হাসি। নেতা সামনে আসে। অন্ধকারে নিরেট ছায়ার মতো মনেহয়।
লিটন ভয় পেলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়, ট্রাজেডি ভরা জীবন। উপভোগ না করে উপায় নেই। নিজেকে দার্শনিক মনে হয়। দার্শনিক স্টাইলে বলে, কী নাম?
সামনের লোকটা লিটনের কথা শুনে ভড়কে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কেউ যেচে পড়ে নাম জিজ্ঞেস করতে পারে হয়তো জানা ছিলনা। জবাব দেবে কী দেবেনা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে, নোবেল।
- কোন বিষয়ে, ছিনতাই?
পাশ থেকে একজন হুংকার দেয়, গুরুর সাথে মশকরা। একদম....
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লিটন বলে, এই ব্যাটা নেড়িকুত্তা গুরুর সাথে কথা বলছি তুই বেয়াদবি করিস কেন?
লোকটা ধেয়ে আসতে যায়। নোবেল থামতে ইশারা করে। থমথমে গলায় বলে, কী করেন?
- ঘোরাঘুরি করি।
- সেটা সবাই করে। প্যাচানো কথা আমার একদম পছন্দ নয়।
- সত্য কথা আজকাল মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। কী করি বললে আপনি খুশি হবেন জানলে সেটাই বলতাম।
চিপা গলির নোবেল এবার মূল প্রসঙ্গে আসে, যা আছে বের কর।
- জামাপ্যান্ট আর মোবাইল ছাড়া কিছু নাই। সবকিছু নিয়ে নিতে পারেন। খুলে দেব?
কয়েকজন মিলে লিটন কে চেক করে। চেকিং শেষে একজন বলে, গুরু এই মোবাইল ছাড়া কিছু নাই। চিপা নোবেল ইশারায় মোবাইল চায়। এ লোকটার সম্ভবত কথা বলার চেয়ে ইশারা বেশি পছন্দ। লিটন মোবাইল দিতে দিতে বলে, গুরু একটা আর্জি ছিল।
- কী?
- এক মিনিট কথা বলব।
চিপা নোবেল মুচকি হাসি দিয়ে বলে, কারো সাথে কথা বলে লাভ নেই।
- গুরু এইখানে লাভ লোকসানের ব্যাপার না। আমাকে একটা মেয়ে খুব জ্বালাচ্ছে। ভুল করে আপনাকেও জ্বালাতে পারে। শুধু বলে দেব গুরু কে যেন ডিস্টার্ব করা না হয়।
নোবেল মোবাইল টা লিটনের হাতে দেয়। লিটন নিশির কাছে কল দেয়। এতো রাতে কী জেগে আছে নিশি! লিটনের ধারণা প্রথম বারেই কল রিসিভ করবে মেয়েটা।
গভীর রাত। নিশির চোখে ঘুম নেই। লিটন নামের ভবঘুরে ছেলেটাকে সে ভুলতে পারছে না। বেশ কয়েকদিন তার সাথে যোগাযোগ নেই। রাতের নিস্তব্ধতা মাড়িয়ে মোবাইল বেজে ওঠে। তড়িঘড়ি রিসিভ করতেই ওপ্রান্তে লিটনের গলা শোনা যায়, নিশি আমাকে নোবেল ধরেছে।
- সে তো বুঝতেই পারছি। সেদিন আমাকে গালিতে নোবেল দিলে। আজ কিসে দিবে?
- নিশি এ নোবেল দেয়না, নেয়।
- মানে!
- এ হলো চিপা গলির নোবেল। গুরুও বলতে পার। তাদের অবশ্য কমিটি আছে। সদস্য সংখ্যা কম নয়। আজ আমাকে ধরেছে।
- আমি কী করতে পারি?
- কিছুই করতে হবেনা। চিপা গলির নোবেল গুরু বলেছে মোবাইলটা তার দরকার। দিয়ে দিচ্ছি। গুরু বলেছে এক মিনিটের বেশি কথা না বলতে। বাই, আর কথা হবেনা।
নিশি কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকে। সে দিন দিল গালির নোবেল, আজ বলছে গলির নোবেল। শব্দ দুটো মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নোবেল


আরও
আরও পড়ুন