পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভিন্নমত পোষণের কারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বীকে বুয়েটের ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তার অপরাধ ছিল, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া। গত রোববার রাত আটটার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতালায় ১০১১ নম্বর কক্ষ যেখানে আবরার থাকত, সেখান থেকে আবরারসহ দ্বিতীয় বর্ষের সাত-আটজন ছাত্রকে হলের দোতালার ২০১১ নম্বর কক্ষে তৃতীয় বর্ষের বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের সাত-আটজন নেতা ডেকে পাঠায়। তারা আবরারের মোবাইল নিয়ে ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার ঘেটে দেখে। তাপর ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে আবরারকে পেটাতে শুরু করে। এর কিছুক্ষণ পর চতুর্থ বর্ষে অধ্যায়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন নেতা এসে দ্বিতীয় দফায় আবরারকে পেটায়। এক পর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তখন ছাত্রলীগের নেতারা অন্যান্য ছাত্রদের দিয়ে আবরারের নিথর দেহটি দোতালা ও নিচতালার সিঁড়িতে রেখে চলে যায়। মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এ হত্যাকান্ডের খবর প্রকাশ হয়ে পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে মাঠে নামে। এর মধ্যে হলের প্রক্টরসহ দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে ঘটনা ধামাচাপা দেয়া এবং সিসিটিভির ফুটেজ সরিয়ে ফেলার অভিযোগ উঠে। সিসিটিভির ফুটেজ না দেখিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ক্যাম্পাস থেকে বের হতে চাইলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের অবরোধ করলে শেষ পর্যন্ত তারা তা দেখাতে বাধ্য হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনকে আসামি করে মামালা করেন। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠনের বুয়েট শাখা কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক ও বর্বর এ হত্যাকান্ড নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভিন্নমতের জন্য একজনকে মেরে ফেলার অধিকার কারো নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যারা অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিগত প্রায় এক দশক ধরে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যেসব অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে, আবরার হত্যাকান্ড তারই ধারাবাহিকতায় ঘটেছে। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি চাঁদাবাজি ও নির্মাণকাজ থেকে কমিশন দাবিসহ নানা অভিযোগে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দেয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে ভাল কাজের জন্য সংগঠনটি গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে, এমন নজির নেই বললেই চলে। ফলে শিক্ষাবিদসহ দেশের সচেতন শ্রেণীর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রলীগের নৃশংসতার শেষ কোথায়? তাদের রুখবে কে? সর্বশেষ আবরার হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে, তার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? অথচ ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনটির সংগ্রামের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এই সংগঠনে এখন খুন-খারাবি ও অপরাধপ্রবণ মানসিকতাদের রাজত্ব চলছে। বুয়েটে যারা পড়াশোনা করে, তারা অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো নয়। তারা অন্যদের তুলনায় অত্যন্ত মেধাবী এবং সচেতন। আবরার যেমন মেধাবী ছিল, তেমনি যারা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারাও মেধাবী। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাদের মধ্যে ন্যূনতম কোনো মানবতাবোধ কাজ করেনি। চোখের সামনে পিটিয়ে পিটিয়ে তাদেরই একজনকে মেরে ফেলেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, নিষ্ঠুর, নির্মম, বর্বর ও খুনের মানসিকতা নিয়ে তারা যদি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়, তবে দেশের কি পরিস্থিতি হবে? যারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করল, তারা কি একবারও ভাবল না, তারা শুধু তাদের বাবা-মায়েরই গর্বের নয়, দেশেরও গর্বের। শুধু রাজনীতি এবং ভিন্নমত পোষণ করার কারণে একজনকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে তারা কি পেল? ছাত্রলীগের মতো সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে তারা এ কোন রাজনীতি করছে? তাদের কাজ কি, ভিন্নমত দমন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা? নাকি গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা এবং ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে রাডারের ভূমিকা পালন করা? দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে এক ধরনের নষ্ট রাজনীতির ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। এসবই যে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে নীতি-নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের চর্চা করা হচ্ছে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, আমরা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল, সারাবিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্বের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা ও অসভ্য মানসিকতা বিরাজ করছে, এ নিয়ে আমরা কি কোনো সভ্য জাতি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারব? শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে সব নয়, সবার আগে মানবিক উন্নয়ন প্রয়োজন, এ বিষয়টি নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই ভাবা উচিত। তা নাহলে, একটা সময় মানবতাহীন উন্নয়ন কাল হয়ে দাঁড়াবে।
আবরার হত্যাকান্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিত যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে। হত্যাকারিরা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী কিনা সেদিকে না তাকিয়ে তাদের অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত থাকলেই অপরাধীদের প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার এক ধরনের অপসংস্কৃতি রয়েছে। আবরার হত্যাকান্ডের সাথে যারা জড়িত, তারা যাতে কোনো প্রভাবেই ছাড় না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে এবং আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্রলীগ যে ১১ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশাপাশি এ কথাও বলা দরকার, বিগত এক দশক ধরে ছাত্রলীগ যেসব অপকর্মের কারণে মানুষের কাছে বদনামের ভাগিদার হয়েছে, তা থেকে তাদের বের হয়ে আসা উচিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত থাকবে এবং তাকে শ্রদ্ধা জানানোই সভ্যতা ও মানবিকতার দাবি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।