শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বিশ্ব ব্যাপি অসম্ভব জনপ্রিয় খেলা হ’লো ফুটবল। বাংলাদেশ ও তার ব্যতিক্রম নয়। ষাট, সত্তর দশক ছিল এদেশে ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ আমলে ও এদেশে অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় এর উত্থান ঘটেছিল। গোষ্ঠ পাল, শিশির ঘোষ, শৈলেন মান্না, সামাদ, আব্বাস মির্জা, ইউ কুমার, মোস্তফা, নূর মোহাম্মদ, তাজ মোহাম্মদ, হফেজ রশীদ, মোহিনী ব্যানার্জী, জুম্মা খান, তসলীম সে’ কালের বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার ছিলেন। কবি নজরুলের কাছে সে সময় ফুটবল এত প্রিয় হয়ে ওঠে যে, তিনি ফুটবলকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে লেখেন অপূর্ব কবিতা। “জোর জমিয়েছে খেলা” নামের এ কবিতা সে সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা “দৈনিক নবযুগ” (১৯৪১ এর ১৭ নভেম্বর সংখ্যা তে) ছাপা হয়। এ কবিতার অংশ বিশেষ:
ক্যালকাটা মাঠে সহসা বিকাল বেলা,
ময়দানে জোর ভিড় জমিয়াছে বড় ছোট মাঝারির
স্বদেশী বিদেশী, লোভী নির্লোভ হেটো মেঠো বাজারীর।
এই দিকে “রাজী” ও দিকে “নারাজী” দল,
সেন্টারে পড়ে আছে “ভারতের স্বাধীনতা” ফুটবল !
আজ যার কথা লিখতে বসেছি তিনি ছিলেন অধূনালুপ্ত পাক-ভারত উপ মহাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তীর মহানায়ক “সৈয়দ আব্দুস সামাদ”। বিস্ময়কর ক্রীড়া নৈপূন্য, কঠোর অধ্যাবসায়, অসাধারণ কলা কৌশলের জন্য তৎকালীন তিনি “ফুটবলের জাদূকর” উপাধীতে ভূষিত হন। ফুটবলের “স্বর্ণযুগ” ব্রিটিশ আমলে সামাদ তাঁর ৩০ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে এমন সব অসাধারণ ও বিস্ময়কর ক্রীড়া নৈপূন্য প্রদর্শন করেছেন যা’ মানুষের হৃদয়ে আজ ও চির অ¤øান, চির ভাস্বর ও অভাবনীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। চোখ ধাঁধানো ড্রিবলীং, বল নিয়ন্ত্রণের অপূর্ব ক্ষমতা, প্রতিপক্ষের জালে গোল করার কৃতিত্ব প্রভৃতিতে তিনি ছিলেন কীংবদন্তীর নায়ক। ফুটবল জাদূকর সামাদের ক্ষিপ্রতা ও বল আয়ত্বে রাখার অসাধারণ কৌশল দীর্ঘ ৩০ বছর দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের বোকা ও স্তম্ভিত করে ছেড়েছে। তাঁর খেলায় সব চাইতে চাতুর্যময় ভেল্কি ছিল, তিনি নিজ কায়দায় (যা’ আর কেউ কোনদিন পারে নি) প্রতিটি প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের চতুর্দিকে চক্রাকারে বল নিয়ে নেচে নেচে তাদের এমন অসহায় করে ফেলতেন যে, তখন আর তাদের পক্ষে সামাদকে বাঁধা দেবার শক্তি থাকতো না। সে আমলে নিত্য নতুন ফুটবলের চাতুর্য্য দেখিয়ে তিনি সবাইকে বিস্মিত করেছিলেন।
সর্বকালের ফুটবলের ইতিহাসে এমন বল নিয়ন্ত্রণের কায়দা, গোল করার দক্ষতা ও কৌশল আর বুদ্ধির চকিত দীপ্তিতে আক্রমনের ধারা মুর্হুমুর্হু পরিবর্তনে সামাদের জুড়ি আর কখনও হবে কিনা জানিনা। বহুদেশের অনেক অভিজ্ঞ ফুটবল সমালোচক মন্তব্য করেছেন, যদি কখনও সর্বকালীন ফুটবল একাদশ বাছাই করা সম্ভব হয় তবে সামাদ নি:সন্দেহে লেফ্টআউট নির্বাচিত হবেন।
পশ্চিমবঙ্গের পুর্ণিয়া জেলায় ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে “ফুটবল জাদূকর সামাদ” জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল “সৈয়দ ফজলুল বারী”। সামাদের বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়না। তাঁর পিতার আর্থিক অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল ছিলনা। তাঁর উপর ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তাঁর একান্ত অনূরাগ। তারই ফলে লেখাপড়া তাঁর সপ্তম শ্রেণিতেই শেষ হয়ে যায়। তবে ছোটবেলা থেকে সামাদ অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান ছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সামাদ তার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূন্য ও কলাকৌশল প্রদর্শনের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারতে ক্রীড়া মোদিদের নয়নমনি হয়ে উঠেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে সামাদ কোলকাতার “মেইন টাউন ক্লাবের” পক্ষ হয়ে সর্বপ্রথম ফুটবল খেলা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রংপুরের তাজহাটের প্রখ্যাত সেন্টার ফরওয়ার্ড গোপাল রায় ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত তাজহাট ফুটবল দল গঠন করেন। এ’ দলের বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন জাদূকর সামাদ। একবার কুচবিহার মাঠে তাজহাটের সাথে মোহন বাগানের খেলা হয়। প্রথম হাফে তাজহাট এক গোলে হেরেছিল। বিরতির সময় মহারাজা সামাদকে অনুরোধ করেন অন্তত: গোলটা শোধ করে দিতে। বিনিময়ে সামাদকে পুরস্কৃত করা হবে। সামাদ এ’ কাজের জন্য মহারাজার হাতের মূল্যবান ঘড়িটি দাবী করেছিলেন। সংকল্পে অটল থেকে সামাদ দ্বিতীর্য়াদ্ধে দূ’টো গোল করে তার দলকে জয়ী করেছিলেন। শেষ বয়সেও জাদূকর সামাদের কব্জিতে মহারাজার সেই বিখ্যাত রিষ্ট ওয়াচটি শোভা পেতো।
রংপুরের তাজহাটের রাজ দরবারের সিঁড়ি বেয়েই জাদূকর সামাদ কোলকাতায় এসেছিলেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতার “এরিয়ান্স ক্লাসের সদস্য” ও ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত “ঈষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে” টিমে খেলেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় দলে যোগ দিয়ে সামাদ মায়ানমার, চীন, ইন্দোনেশীয়া ও যুক্তরাজ্য সফর করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অবিভক্ত ভারতীয় জাতীয় দলের ফুটবলে এটাই হলো সর্বপ্রথম বিদেশ যাত্রা। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সামাদ অবিভক্ত ভারতে ফুটবল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কায় ফুটবল খেলতে যান। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার বিখ্যাত “মোহামেডান স্পোটিং” ক্লাবে যোগদান করেন এবং ঐ বৎসরই তাঁকে ফুটবলে অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুন্য প্রদর্শনের জন্য তদান্তিন আই.এফ.এ (ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন) তাকে “হিরো অফ দি গেমস্” সম্মানে ভূষিত করেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সে সময়ে ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে অসম্ভব জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। সে আমলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে আমরা ফুটবলের যে বিখ্যাত ক্লাবগুলির নাম পাই তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কোলকাতার মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব, মহীশুর রোভার্স, মার্স ইউনিয়ন (বেঙ্গালোর), ওয়েলস্ রেজিমেন্ট, মোহন বাগান, ইষ্ট বেঙ্গল, স্যান্ডি মেনিয়ানস, তিলক মাটি (মাদ্রাজ), ফ্রন্টিয়ার হিলাল ক্লাব, সী ফোর্থ হাইল্যান্ডস, মূলতান এফ.সি গর্ভমেন্ট কলেজ (লাহোর), কে.ও.এস.বি, পুলিশ, এরিয়ান্স, রেঞ্জার্স, ইষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ও ক্যালকাটা ক্লাব। তখনকার দিনে সবচেয়ে বিখ্যাত কাপ ছিল আই.এফ.এ (ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন) শীল্ড কাপ।
সামাদের খেলোয়াড়ী জীবনে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছে খোদ “ইংল্যান্ডের মাঠে”। লন্ডনের ফুটবল মাঠে এক খেলায়, সামাদের গোলে শর্ট করা বল, গোলের বার পোষ্টে লেগে ফিরে এলে তিনি এই শর্টে গোল দাবী করে বসেন। তৎক্ষনাৎ রেফারীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে ফেলেন- “গোল বার” উচ্চতায় ছোট আছে। আমার শর্টের মাপ কখনই ভূল হতে পারেনা। অনেক বাক-বিতন্ডার পর “গোলবার” মাপার পরে দেখা গেলো, সত্যি “গোলবার” দেড় ইঞ্চি ছোট। সামাদের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অবশেষে বাতিল গোলটি, গোল হিসাবে গণ্য করেন রেফারী। এমনি নির্ভূল শর্ট এবং চ্যালেঞ্জ করার মতো ফুটবলার বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসে আজও জন্মায়নি। তৎকালীন লন্ডনের ফুটবল মাঠের সেই অভাবনীয় খেলার ঘটনা থেকেই তিনি পরবর্তীতে ইংরেজ দর্শকের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন “ফুটবল জাদূকর” খেতাবটি। সামাদের খেলোয়াড়ী জীবনে এমনি বহু চিত্তাকর্ষক ঘটনা ও কাহিনী দেশে বিদেশে অনেক ক্রীড়া মোদী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে সর্ব্বত্তই। সামাদ ছিলেন ফুটবল জাদূকর, তথা ফুটবল খেলার ইতিহাসের কিংবদন্তী। ফুটবল খেলার নিজস্ব টেকনিকে সামাদ ছিলেন অগ্রগণ্য।
এমনি বহু ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করেছেন। আসমুদ্র হিমাচলের মতো সব মাঠে ছড়িয়ে আছে, সে’ ইতিহাস- মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, সূমাত্রা, জাভা, বোর্ণিও আর চীনে। তারা আজও সামাদকে ভূলে নাই। তার প্রমাণ ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে চীনা অলিম্পিক ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন লি.ওয়াই.টন ভারতবর্ষে এসেই সামাদের নাম উল্লেখ করেছিলেন। সেবার সামাদ চীনা দলের বিপক্ষে খেলার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু খেলতে পারেন নাই। খেলার ৭ দিন আগে ভারতীয় মোহামেডানের গোলী ওসমান জানের সঙ্গে এক সংঘর্ষে তার “সীনবোন” ভেঙ্গে যায়। খেললে হয়তো আর এক ইতিহাস রচিত হতো।
খেলা চলাকালীন সময়ে মাঠে পায়চারী করা, সূযোগ মতো পায়ে বল পেয়ে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিপক্ষের গোল মুখে ছোটা। পাঁচজন প্রতিপক্ষ ও খেলার মাঠে তাঁকে আটকিয়ে রাখতে পারতোনা। গোলকীপারকে কাটিয়ে গিয়ে কোন কোন সময় গোলের জালে গোল না দিয়েও ফিরে আসতেন তিনি। অর্থ বাজী ধরে ও গোল দিতেন। এ যুগের পেলে, ম্যারাডোনা, বেকহ্যাম, রোলান দিনহো, মেসি ও তাঁর খেলা দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতো। এমনি অবাক করা কীংবদন্তীর ফুটবলার ছিলেন জাদূকর সামাদ। ১৯৩৭ সালে “আই লিন্টন কোরিন্থিয়ানস্ ফুটবল টীম” আসে অবিভক্ত বাংলায়। বহু ইন্টারন্যাশনাল খেলোয়াড় সমন্বয়ে গঠিত ইংল্যান্ডের সেরা ফুটবল একাদশ। তাঁদের বিরদ্ধে সম্মিলিত ভারতীয় একাদশের হয়ে খেলেন সামাদ। একবছর আগে তাঁর পা’ ভেঙ্গেছে, বয়স বেড়েছে। খেলোয়াড়দের বয়সের চেয়ে তাঁর খেলার বয়সই বেশী। তা’ সত্বেও তিনি দেখিয়ে ছিলেন যে, ইচ্ছে করলে এখনও তিনি বিপক্ষদের ডুগ্ডুগির তালে বাঁদর নাচ নাচাতে পারেন।
খেলা ছেড়ে দিবেন সামাদ। ৩০ বছরের উপর তিনি খেলেছেন, ঠিক তখন এলো ইংল্যান্ডের “সারভিসেস একাদশ” ভারতবর্ষে খেলতে। ইংল্যান্ডের সেরা লেফট আউট “কম্পটন” আছেন দলে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক সামাদ। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।