Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় আর কোনো এক্সপেরিমেন্ট কাম্য নয়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বহু বছরের প্রতীক্ষার পর স্বাধীন বাংলাদেশে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারের ধারাবাহিক অঙ্গীকার দেখা গেলেও শিক্ষাব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান, অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক মান সম্পর্কে এখনো সিদ্ধান্তহীনতা দেখা যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিভিন্নতা এবং বৈষম্য ক্রমেই বিস্তৃতি ও গভীরতা লাভ করেছে। দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রে বিনামূল্যে সব শিশুর জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকলেও তা যেন শুধু কাগজে-কলমেই। সরকার সব শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকারের এই ব্যর্থতার সুযোগে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। মূলত ঔপনিবেশিক আমল থেকেই দেশের একশ্রেণীর ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ ও প্রচেষ্টায় অসংখ্য স্কুল-কলেজ গড়ে তুলেছিলেন। এসব দানশীল ব্যক্তির উদাত্ত অবদানের ওপর ভিত্তি করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। এক সময়ের জমিদার ও দানশীল ব্যক্তিরা সামাজিক দায়বোধ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য জমি ও অর্থসম্পদ দান করলেও সাম্প্রতিক কয়েক দশকে শিক্ষা খাতে আরেক শ্রেণীর বিনিয়োগকারীর অভ্যুদয় ঘটেছে, যারা শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা খাতে সরকারের অপর্যাপ্ত বিনিয়োগের কারণেই এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শহরের অনেক তথাকথিত নামী-দামি স্কুল-কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, মাদরাসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার সাথে সাথে শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের অনৈতিক-বার্ণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষত পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল দেখানোর এই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়। শহরের মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারগুলো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে যেন জাতে উঠে যান। পাবলিক পরীক্ষায় কোন স্কুল বা কলেজ কত সংখ্যক জিপিএ-ফাইভ, গোল্ডেন জিপিএ পেল এই মানদন্ডই হচ্ছে বিদ্যালয়ের নামী-দামি হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত। শিশুর মানসিক বিকাশ, সুস্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা এবং নৈতিক শিক্ষাসহ সমাজে ও আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার বাস্তবসম্মত চর্চা এখানে একেবারেই গৌণ। শুধুমাত্র পাবলিক পরীক্ষায় উচ্চ গ্রেডপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাকেই অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে শিক্ষার মান ক্রমেই নিম্নগামী হয়েছে। ভালো গ্রেড নিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার পরও অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাতৃভাষা, ইংরেজি এবং বিভাগীয় বিষয়ভিত্তিক ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। এভাবে পাবলিক পরীক্ষার সিঁড়ি ডিঙিয়ে একসময় তারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছেন, সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এসবের বাইরে ব্যবসা ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটা বিভাগে যে অবক্ষয়, দুর্নীতি ও লুটপাটের মচ্ছব দেখা দিয়েছে তার পেছনে কাজ করছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং অনৈতিক প্রতিযোগিতা, নিয়োগ বাণিজ্য এবং সংকীর্ণ দলীয়করণ।
চলতি দশকের শুরুতে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রথমেই প্রাথমিক স্তরের শিশুদের ওপর দু’টি নতুন পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করা হলেও পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার নামে পাবলিক পরীক্ষা চালু রেখে তথাকথিত নামী-দামি স্কুলগুলোকে শিক্ষাবাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ অক্ষুন্ন রাখা হয়। শিশুর প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড নিশ্চিত করার প্রত্যাশা অভিভাবকদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তৈরি একটি মুনাফার দুষ্টচক্রে নিক্ষেপ করেছে। এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট টিউশনি বাণিজ্য, গাইডবই বাণিজ্য থেকে শুরু করে তা এক সময় প্রশ্নপত্র বাণিজ্যে গিয়ে ঠেকেছে। প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সাথে সংশ্লিষ্ট চক্রের কোটি কোটি টাকার স্বার্থ থাকলেও এভাবে পাবলিক পরীক্ষাগুলোই অনাস্থার নিগড়ে পড়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের মানদন্ড হিসেবে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এহেন বাস্তবতায় প্রাথমিক স্তরে অপ্রয়োজনীয় পাবলিক পরীক্ষা বন্ধের দাবির সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরাও সহমত পোষণ করছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই সাথে পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্র ও পন্থাগুলোকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং যেভাবে, যাদের মাধ্যমে এমন অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে, তাদের কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত এহেন অপকর্ম বন্ধের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দাজালে ধরা পড়ার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নেপথ্য ভূমিকার কারণেই এদের মূলোৎপাটন সম্ভব হয় না। এ কারণেই শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির সব উদ্যোগে দেখা দেয় এক প্রকার শুভঙ্করের ফাঁক। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার এবার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের বিদ্যালয়ে সব ধরনের পরীক্ষা না নেয়ার ব্যাপারে একটি নির্দেশনা প্রকাশ করেন। এটি প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশনা এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কোনো চ‚ড়ান্ত বা আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি। প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণীর ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি, বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং ডায়রি মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ অগ্রগতি মূল্যায়নের কথা বলা হলেও মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি ঠিক করতে বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট চ‚ড়ান্ত হলেই পরীক্ষা বাতিল করে প্রাথমিক স্তরে নতুন শিক্ষা পদ্ধতির যাত্রা সূচিত হবে বলে জানা গেছে। বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল হলেও চতুর্থ শেণীতে বিদ্যমান পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং পঞ্চম শ্রেণীতে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। পঞ্চম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষার গতানুগতিক ধারা অব্যাহত রেখে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের এই ধারার মূল্যায়ন ও প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত রাখা প্রায় অসম্ভব হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ এবং বিদ্যালয়মুখী করতে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কতটা সুফল দেবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যেখানে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, খেলার মাঠ নেই, পাঠাগার নেই, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই, এমনকি হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংখ্যক শ্রেণীশিক্ষকও নেই। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সময়কাল বাড়িয়ে এবং উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শুধুমাত্র পরীক্ষা বাতিল করেই শিক্ষার মানোন্নয়নের আশা করা যায় না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ ও মানসম্মত শিক্ষক এবং ব্যবস্থাপনা পরিষদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ ও সামাজিক-রাজনৈতিক অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর শিক্ষার মানোন্নয়ন মানে পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর উচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, এমন ধারণা জাতির জন্য আত্মঘাতী। আমাদের আজকের সমাজ বাস্তবতায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। দেশে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট, সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা, নৈরাজ্য ও অবিচারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তার মূল কুশীলব তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত প্রভাবশালী আমলা, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক মহল। মূলত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ধ্বংসের বীজ। শত বছর ধরে শাসন-শোষণের ধারা অব্যাহত রাখতে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ধ্বংসের এই বীজ বপন করেছিল। সেই ধ্বংসযাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। শাসন-শোষণ ও রাজনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখার লক্ষ্যে ব্রিটিশরা ভারতের হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ঐতিহ্য ভেঙে দিয়ে নতুন একটি ভোগবাদী উচ্চাকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। এ জন্য তারা প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্রিটিশ পুঁজিবাদের অনুকারবৃত্তির অনুক‚ল করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ, হুইগ পার্টির পার্লামেন্ট মেম্বার লর্ড বেবিংটন ম্যাকলের একটি চিঠি বা বক্তব্যকে বিশেষভাবে উদ্ধৃত করা হয়। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রæয়ারিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ম্যাকলে এই বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন বলে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা দাবি করলেও ব্রিটিশরা তথ্য উপস্থাপন করে কেউ কেউ বলেছেন সে সময় তিনি লন্ডনে ছিলেন না, তিনি তখন কলকাতায় ছিলেন। তারিখে হেরফের হতে পারে, এটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে তার পাঠানো চিঠিও হতে পারে। তার বক্তব্যটির ভাবানুবাদ অনেকটা এ রকম, সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি ভারতের অভ্যন্তরে সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি এখানে এমন একজন লোকও খুঁজে পাইনি যিনি ভিক্ষাবৃত্তি করেন, চুরি করেন, এমনই ঐশ্বর্যময় এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন এই জাতি। আমি মনে করি আমরা যদি তাদের এই ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মেরুদন্ডকে ভেঙে দিতে না পারি তাহলে কখনোই আমরা এই দেশকে সত্যিকার অর্থে জয় করতে পারব না। আমি তাদের এই পুরনো ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের জায়গায় ব্রিটিশ মূল্যবোধ অনুপ্রবেশের প্রস্তাব করছি। আমরা যদি তা করতে পারি এবং তারা যখন মনে করবে ব্রিটিশ ভাষা ও সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির চেয়ে শ্রেষ্ঠতর তাহলে এক সময় তারা তাদের আত্মবিশ্বাস হারাবে এবং আমরা তাদের পদানত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।’ লর্ড মেকলের এই প্রস্তাবের অনেক পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল ১৮৮২ সালে। ভাইসরয় লর্ড রিপনের নির্দেশে ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ ইউলিয়াম উইলসন হান্টারের নেতৃত্বে ১৮৮২ সালে গঠিত হান্টার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকার যে নীতিই গ্রহণ করুক না কেন, হান্টার কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশমালা আজ প্রায় দেড়শ’ বছর পরও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি উনবিংশ শতকের শুরু থেকে ২০ বছর পর পর ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষানীতি মূল্যায়ন ও সংস্কারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণও করেছিল। এ ক্ষেত্রে তারা বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়েছেন। ১৮৪২ সালের হান্টার কমিশনের আগে ১৮৫৪ সালে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার চার্লস উড শিক্ষা সংস্কারের যে সুপারিশমালা ব্রিটিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন তা উড ডেসপাচ নামে পরিচিত। শোনা যায়, ভারতে শিক্ষার সঙ্কটসমূহ মূল্যায়নপূর্বক প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরামর্শসহ নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ডেসপাচ রিপোর্ট প্রণয়নের নেপথ্যে মূল ভ‚মিকা পালন করেছিলেন, প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ড মিল। উড ডেসপাচে ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে যে চারটি মূল লক্ষ্যকে তুলে ধরা হয়, তা হচ্ছে : ১. শিক্ষাব্যবস্থায় পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোজন ঘটানো এবং পশ্চিমা সংস্কৃতি সম্পর্কে ভারতীয়দের পরিচিত করা। ২. ভারতীয়দের এমনভাবে শিক্ষাদান করা যাতে ব্রিটিশদের অনুগত পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয় এমন একটা শ্রেণী তৈরি হতে পারে। ৩. নতুন প্রজন্মের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি নিশ্চিত করা এবং তাদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা জোরদার করা। ৪. ভারতীয়দের মধ্যে ভোকেশনাল ও ব্যবহারিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যাতে তারা নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন এবং তা ব্যবহার, বিপণন ও বাজার তৈরির ক্ষেত্রে যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে পারে।
শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করলেও স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকরা শিক্ষানীতি প্রণয়ন, উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়কে অগ্রাহ্য করে এসেছে। এর ফলেই দেশে একটি লোভী, ভোগবাদী, দুর্নীতিপরায়ণ ও সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বোধহীন বেপরোয়া অনৈতিক শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে উঠেছে। যারা বর্তমানে দেশের প্রশাসন, রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশে সত্যিকার অর্থে সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য আত্মনিবেদিত এবং আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম উন্নত নৈতিক গুণসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তুলতে হলে জাতীয় চাহিদা এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিরিখে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তা খুবই ইতিবাচক হলেও এ সময়ে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা আগেই মূল্যায়ন করতে হবে। প্রাক-প্রাথমিক ও ৮ বছরের নিচের শিশুদের বইয়ের বোঝা এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক নিরানন্দ ব্যবস্থা থেকে মুক্ত রাখা তার ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবনের জন্য প্রস্তুতি বা ভিত্তি গঠনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে পরীক্ষাবিহীন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সময়টুকু খেলাধুলা ও সামাজিক মেলবন্ধন, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে শিশুরা আধুনিক যুগের বিকল্প ব্যবস্থার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। লেখাপড়া ও খেলাধুলা বাদ দিয়ে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ ও অনিয়ন্ত্রিত বিনোদনে আসক্ত হয়ে পড়লে তা তাদের জন্য সম্মিলিতভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। শিশুদের শিক্ষা মূল্যায়নের গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হোক এমন একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেখানে জিপিএ-ফাইভ নিশ্চিত করার জন্য পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রেস্টিজ ইস্যু এবং শিক্ষা বাণিজ্যের সুযোগ বন্ধ হয়। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে আর কোনো এক্সপেরিমেন্ট নয়। আমাদের সামগ্রিক বাস্তবতায় যেসব নীতি ও পদ্ধতি দেশি-বিদেশি শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের যথাযথ পর্যালোচনায় দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর বলে গৃহীত হবে তাই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা খাতের বিনিয়োগ যেন বহুলভাবে বেসরকারি, বিদেশি ঋণ বা পরামর্শকনির্ভর না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে না পারলে এর প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষানীতি


আরও
আরও পড়ুন