বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
শিক্ষা দিবস উপলক্ষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেবের ‘যেতে হবে বহুদূর’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটি নানা ব্যস্ততার মাঝেও মনোযোগসহকারে পড়ার চেষ্টা করেছি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তৃত আলোচনার কৌশলটি অবশ্য চমৎকৃত করার মতো। লেখাটিতে বর্তমান সরকারের শিক্ষাবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাফল্যের মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। এ ছাড়া এতে নতুন শিক্ষানীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জনগণকে অবহিত করার প্রয়াসও লক্ষণীয়।
অন্যের বিশেষ করে প্রতিপক্ষের ভুল-বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্ভুল কর্মপন্থা নির্ধারণ প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। পাক আমলে প্রণীত শিক্ষা কমিশন রিপোর্টগুলো এ অর্থে আমাদের জন্য বড় ধরনের অ্যাসেট বিশেষ। সম্ভবত এই বিবেচনায়ই নাহিদ সাহেবের লেখায় ১৯৬২ সালের ‘শরিফ কমিশন’ রিপোর্টটির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তাঁর ভাষায় এই তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে যেসব বিষয় সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑ শিক্ষাকে ব্যয়বহুল পণ্যের মতো করা এবং উচ্চবিত্তের সন্তানদের স্বার্থে উচ্চশিক্ষাকে সীমিত করা। সাধারণের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ একেবারেই সঙ্কুচিত করে ফেলা। শিক্ষা ব্যয়কে পুঁজি বিনিয়োগ হিসেবে দেখে শিক্ষার্থীদের তা বহন করা, ‘যে অভিভাবক বেশি বিনিয়োগ করবেন তিনি বেশি লাভবান হবেন’ এ জাতীয় ধারণা, অবৈতনিক শিক্ষাকে অবাস্তব বলে উল্লেখ করা, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি পাঠ বাধ্যতামূলক করা, উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা, সাম্প্রদায়িকতাকে কৌশলে জিইয়ে রাখার চেষ্টা, ডিগ্রি কোর্সকে দুই বছরের স্থলে তিন বছর মেয়াদি করা ইত্যাদি।
‘শরিফ কমিশন রিপোর্ট’-এর ওপর নাহিদ সাহেবের উদ্ধৃত মূল্যায়নের সাথে দ্বিমত পোষণের অবকাশ না থাকলেও বলা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর ৪৫ বছর ধরে একমাত্র উর্দু প্রসঙ্গ ছাড়া আর সকল ক্ষেত্রে আমরা সেই কুখ্যাত গণবিরোধী শরিফ কমিশন রিপোর্টের অঘোষিত বাস্তবায়নেই তৎপর থাকিনি কেবল, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিক্রম করে গেছি। শিক্ষাকে কতটা বাণিজ্যিক পণ্য ও উচ্চবিত্তের খায়েশের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে অগণিত কিন্ডারগার্টেন, কোচিং সেন্টার ও নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি তার প্রমাণ। অতঃপর উপযুক্ত ‘মামা’ বা রাজনৈতিক শুভ দৃষ্টি থাকলে মেধাকে পিছে ফেলে সম্মানজনক চাকরিটাও ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে। একালে শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত আর নি¤œবিত্ত, শহর আর গ্রামের যে পর্বতসম ব্যবধান ৫০ বছর আগে তা কল্পনা করাও গেছে কি? বরং এসএসসি ও এইচএসসিতে মেধার তালিকায় শহরের তুলনায় গ্রাম আর বিত্তবানদের তুলনায় গরিবের সন্তানদেরই জয়জয়কার ছিল সবখানে।
পাকিস্তÍান প্রকৃত অর্থে ইঙ্গ-মার্কিন ভাবধারার একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ছিল তখনও। আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্র তাদের সংবিধানে স্থান পায়নি কোনো দিনই। তাহলে পুঁজিবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর এ কোন সমাজতন্ত্রে বাস করছি আমরা, যেখানে শ্রেণি-বৈষম্য উৎসাহিতই করা হচ্ছে না শুধু বরং, নিয়তির অমোঘ বিধানেই পর্যবসিত? মেধা কেবল অভিজাত পরিবারের উত্তরাধিকার না হলে মধ্যম আয়ের এ যুগেও ফুটপাথ আর বস্তিবাসী নিবন্ধনহীন কোটি বনি-আদমের জন্ম মৃত্যুর ঠিকানা কেন? মেধার প্রসব ওসব স্থানে প্রাকৃতিকভাবে নিষিদ্ধ না হলে ক্যাডেট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দূরের কথা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তাদের দেখা মেলে না কেন? আইয়ুব-ইয়াহিয়ার ওপর দোষ চাপিয়ে আমাদের পার পাওয়ার উপায় আছে কী অর্ধশতাব্দী পরেও? দেশটার মালিক মোক্তার যখন জনগণ, রাষ্ট্র যখন সাংবিধানিকভাবে ‘সমাজতন্ত্রী’ তখনও মালিক বেদখল হলে পুঁজিবাদের দোষটা কী? তাহলে ‘গণতš’¿ আর ‘রাষ্ট্রধর্মের’ মতো সবকিছুই এখানে আলঙ্কারিক! অথচ সংবিধান বিরোধিতার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-!
বঞ্চনা আর দুর্ভাগ্যই যেন এ অঞ্চলের মানুষের নিয়তি। বৃটিশ আমলের দু’শ বছর সাম্প্রদায়িক কারণে এ অঞ্চলের সংখ্যাগুরু মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে শুধু বঞ্চিতই থাকেনি, শোষণ-নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিল নানাভাবে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে ৪৭-এ এই অঞ্চলের মানুষের ভোটেই সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। মূলত ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান নয় কেবল, সৃষ্টি হলো ভারতও। পাকিস্তানের ২৩ বছর এই অঞ্চলের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও বঞ্চিতই থেকে গেল। নতুন করে স্বাধীন হলো দেশ ’৭১-এ। শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল কী? ফুটপাত আর বস্তিবাসী বলতে গেলে শতভাগই একই সম্প্রদায়ের। চাকরি-বাকরিতেও তাদের ন্যায্য অবস্থান ক্রমেই সঙ্কুুচিত হয়ে আসছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের মতো। সংখ্যাগুরুদের জন্য কোটার দাবি ওঠার কথা ছিল অনেক আগেই। অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন সবচেয়ে প্রকট এখন শিক্ষা ক্ষেত্রে। সংখ্যাগুরু বলে উচ্চকণ্ঠে তা বলাও যায় না। বলতে হয় কানে কানে, ইশারায়, পাছে সাম্প্রদায়িক তকমাটা অজান্তেই লেগে যায়। তারপরও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে সজাগ থাকার লক্ষ্যে শিক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে আগ্রাসনের যৎকিঞ্চিত তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি এখানে।
প্রথম শ্রেণির বোর্ড প্রকাশিত বাংলা বই-এ শব্দ গঠন প্রক্রিয়ায় ঋ’তে ঋষি এবং র’তে রথ শেখানোর ধারাবাহিকতায় ম’তে মন্দির হলেও পারত। অসাম্প্রদায়িক মানসিকতাটা বোধকরি এখানে একটু হোঁচট খেল। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে গিয়ে এবার ম’তে ‘মসজিদ’ না লিখে ‘মগডাল’ লিখতে হলো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইটিতে ‘এই দেশ এই মানুষ’ রচনায় মঙ্গলের প্রতীক লক্ষ্মীর বাহন পেঁচার মুখোশ দেয়া হয়েছে অর্ধপৃষ্ঠা জুড়ে বৈশাখী উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে। ‘সখের মৃৎশিল্প’ রচনাটির অনুশীলনীতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪টি পুরাকীর্তির ছবি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে নির্মিত কান্তজীউর মন্দিরটি পুরাকীর্তি হিসেবে স্থান পেলেও কোনো প্রাচীন মসজিদ বা মুসলিম স্থাপত্য স্থান পায়নি। একই বইতে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘মুনাজাত’ কবিতাটি প্রার্থনা নামে সংকলিত হলেও এটি যে কোরআনপাকের প্রথম সূরা ‘ফাতিহার’ ভাবানুবাদ শিক্ষার্থীদের কাছে তা তুলে ধরা স্বচ্ছ ধারণা লাভে জরুরি হলেও তা উপেক্ষিত হলো। একই বইতে হুমায়ুন আজাদ রচিত ‘বই’ কবিতাটিও সংকলিত হয়েছে। পাপের জন্য পরকালে শাস্তির ভয় সকল ধর্মের অভিন্ন বাণী হলেও এই কবিতাটিতে ধর্মগ্রন্থ বিশেষ করে কোরআন শরিফ না পড়ার জন্য শিশুদের তাগিদ দেয়ার বিষয়টি প্রচ্ছন্ন। ‘সাহিত্য কনিকা’ অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই। এতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি স্থান পেয়েছে। জাদুকরী ছন্দের জন্য কবিতাটি আমার মুখস্থ ছিল স্কুল জীবন শুরুর আগেই। এবার আগ্রহ ভরে পাতাটা খুলতেই অবাক হলাম। লম্বা দাড়ি লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তিকে চিত্রে ভূমিদস্যু (কবিতার ভাষায় রাজা) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাকে প্রথম দৃষ্টিতেই মুসলমান বিবেচনা করা ছাড়া উপায় নেই। পাশেই করজোড়ে দাঁড়ানো ধূতি পরা উপেন। কবিতাটিতে ভূমিদস্যুর নাম-পরিচয় না থাকলেও কোথাও ‘রাজা’ কোথাও ‘বাবু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। বাবু শব্দটি আর যা হোক মুসলমানদের বেলায় ব্যবহারের প্রচলন বাংলা ভাষায় নেই। তাছাড়া ওই কবির কোনো রচনায় কদাচ কোনো মুসলমান চরিত্র এসে থাকলেও চাকর-বাকর, পিওন-চাপরাশি পদমর্যাদার ওপরে ওঠার সুযোগ পেয়েছে এমন নজিরও নেই। তাহলে ‘হঠাৎ রাজা’ কেন?
‘মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য’ নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই। এতে কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত কবি ও লেখকের দেশাত্মবোধক কবিতা ও রচনা স্থান পেয়েছে। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় সেই একই বইতে কলকাতার বাসিন্দা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঠিক বিপরীত চেতনাসমৃদ্ধ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ‘সাঁকোটি দুলছে’ শিরোনামে কবিতাটিও সংকলিত হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ অনুশীলনী থেকে সৃজনশীল প্রশ্নের দুটি নমুনা তুলে ধরছি।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও :
শিহাব উদ্দীন মিডল স্কুলে পড়ত। বাহাদুরপুর, মেঘলা, বাগমারা ও সেনগ্রাম পাশাপাশি গ্রাম ছিল। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান শিক্ষার্থী হাসি-আনন্দে স্কুলে যেত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে শিহাব দেখতে পেল তার হিন্দু সহপাঠীরা সপরিবারে ভারত চলে যাচ্ছে। দেবব্রতের বন্ধুত্বের স্মৃতি শিহাব ভুলতে পারে না। স্কুলের সামনের বরই গাছ থেকে বরই পাড়ার স্মৃতি ৭০ বছর বয়সেও শিহাব বিস্মৃত হয়নি। উদ্দীপক শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে : উদ্দীপকে সাঁকোটা দুলছে কবিতার কোন দিক ফুটিয়ে তুলছে?
উত্তরগুলো :
(ক) পড়শি নদীটি ধনুকের মতো বাঁকা।
(খ) সাঁকোটি এখনো আছে।
(গ) বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে।
(ঘ) এপার ওপার স্মৃতিময় একাকার।
অপর একটি উদ্দীপক :
ঋত্বিক কুমার ঘটক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার (ভারতের)। তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রে দেশ ভাগের যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। নিজের জন্মস্থানে যেতে হলে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে এই বেদনা তার মতো অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এ কারণেই তিনি বলতেন, ‘বাংলা ভাগ করিবার পারিছ। কিন্তু দিলটারে ভাগ করবার পারো নাই।’
এবার সৃজনশীল প্রশ্ন :
ক) বন্ধুরা কীভাবে একে অন্যকে ডাকাডাকি করত? (কবিতা থেকে)
(খ) বন্ধুদের সাথে কথায় কথায় ভাব ও আড়ি হতো কেন? (ওই)
(গ) উদ্দীপকটিতে ‘সাঁকোটি দুলছে’ কবিতার কোন দিকটি তুলে ধরা হয়েছে?
(ঘ) উদ্দীপকটি ‘সাঁকোটি দুলছে’ কবিতার মূল ভাবের প্রতিনিধিত্ব করছে মূল্যায়ন কর।
অর্থাৎ ক, খ ও গ প্রশ্নে শিক্ষার্থীর মগজ ধোলাইয়ের পর ‘ঘ’ প্রশ্নটিতে ‘বাংলাদেশের জন্মটাই ভুল’ কৌশলে এমন একটি জবাব শিক্ষার্থীদের মগজ থেকে বের করাই যখন আসল কথা তখন অতগুলো দেশাত্মবোধক রচনা কবিতা পাঠ্য করার তাৎপর্য কী কেবলই আইওয়াশ? বইটিতে অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের আদলে কবিতায় ১ম থেকে ক্রমিক নং ১১ পর্যন্ত এবং গদ্যের তালিকায় ৮ নম্বর পর্যন্ত একজন মুসলমানের নামও খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিন্ন চিত্র অন্য সকল বাংলা বইতেও। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম মিলবে ষষ্ঠ শ্রেণির বইটিতে। ১ম লেখাটি এম ওয়াজেদ আলীর লেখা ‘রাঁচি ভ্রমণ’। কিন্তু লেখাটি ‘রাঁচি ভ্রমণ’ না হয়ে যদি ‘মক্কা’ বা ‘আঙ্করা’ নিয়ে হতো? বোর্ড বইগুলোর মলাটে অঙ্কিত নকশা ও আলপনাগুলোও সম্প্রদায় বিশেষের শিল্পকলার প্রতিফলন থেকে বাদ পড়েনি, এমনকি মুসলমান শিক্ষার্থীদের ধর্ম শিক্ষার বইটিও।
শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলতে গেলেই মাদরাসা শিক্ষার বিষয়টি সঙ্গতভাবেই এসে পড়ে। বর্তমান সরকারের আমলে মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘কিছুই করা হয়নি’ এমন অবিবেচনা প্রসূত দাবি আমাদের নয়। মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার কথা আমরা যুগ যুগ ধরেই শুনে আসছি। আদতে এ লক্ষ্যে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। ‘মাদরাসা জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র নয়’ এখন সেটা খোলাখুলিভাবেই বলা হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হলো ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম মৌলিক জ্ঞান যারা লালন করেন তাদের পক্ষে আত্মঘাতী বা সন্ত্রাসী হওয়া সম্ভব নয়। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই আইএস বা জেএমবি প্রজননের যে উপযুক্ত ক্ষেত্র বানায় তা এখন প্রমাণিত। অতএব সন্ত্রাস নির্মূলের পূর্বশর্ত হিসেবে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা প্রতিটি শিক্ষার্থীর মন-মগজে পৌঁছে দেয়া জরুরি। তাই এটি শিক্ষা নীতিতেও অঙ্গীভূত হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজগুলোর তুলনায় মাদরাসাগুলোর উপায় উপকরণ ও সামর্থ্য একেবারেই সীমিত হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভর্তি পরীক্ষায় তাদের সাফল্য অভাবনীয়। এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ গ্রুপে ১ম হলো তামিরুল মিল্লাতেরই একজন াছাত্র। কিন্তু মেধার তালিকায় প্রথম হয়েও পছন্দের বিষয়টি পড়ার সুযোগ তাদের হয় না। অবাক হওয়ার বিষয়, ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জনের বিস্ময়কর সাফল্যের পরও ইংরেজি পড়ার জন্য সুযোগ দেয়া হয় না এক সময়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই। আদালতের রায় থাকার পরও এমন বর্ণবাদী নীতি একটি সভ্য দেশে কেমন করে চলতে পারে যে দেশের সংবিধানে সহঅবস্থান করছে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও সমাজতন্ত্র’ উভয়ই। এই সরকারের আমলেই কিছু সংখ্যক মাদরাসায় প্রথমবারের মতো ইসলামী বিষয়সমূহে উচ্চতর ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) চালু করা হয়েছে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে যাচ্ছে বলে প্রকাশ। এগুলো অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু একটি ভালো কাজ দ্বারা আর একটি মন্দকাজকে ‘জাস্টিফাই’ করা যায় কী?
আরেকটি প্রসঙ্গ হলো কওমি মাদরাসা। বাংলাদেশ বা উপমহাদেশই নয় বরং এর বিস্তৃতি আরো অনেক দূর। পুরনো ধাঁচের ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে পড়–য়াদের সংখ্যাও বিপুল। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও অন্যান্য জীবনমুখী বিষয়াবলি অনুপস্থিত বলে অনেকে একে জাতির জন্য বোঝা হিসেবে দেখেন। যদিও এরা সরকারের কাছে চাকরি চান না, উন্নয়নের জন্য অর্থ বা বেকার ভাতাও দাবি করেন না। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পুলিশের খাতায় এদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। আধিপত্য রক্ষায় এদের হাতে শতীর্থ খুন বা অপছন্দের শিক্ষক নাজেহাল হওয়ার ঘটনা শতবর্ষের ইতিহাসে বোধ করি একটিও নেই। নারী নির্যাতনের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক কথায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘সুনাগরিক’ বলতে যা বোঝায় তারা যেন তাই। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা ইথিক্স তাদের পড়ানো হয় না। সুতরাং তাদের ভয় ও সংশয় সরকারি সহায়তায় যুগোপযোগী হতে গিয়ে আম-ছালা দুটোই যে হারাবে না এর নিশ্চয়তা কী? অবাক না হয়ে পারা যায় কেমন করে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মাঝে একজনও ইয়াবাখোর বা মদ্যপ পাওয়া তো দূরের কথা, ধূমপায়ীও নেই। এই যে মৌলিকত্ব তা নষ্ট হতে দিতে কার মন চায়? সরকার কী এই সুন্দর ও মহৎ দিকগুলো অবিকৃত হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম? এর অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, অংক, ইংরেজি পদার্থ-রসায়ন, হেগেল-ডারউইন, মার্কস্্-মেকিয়াভেলী পড়ার গুরুত্ব অস্বীকার করা। এখন প্রশ্ন হলো, কওমি মাদরাসায় এসব বিষয়ের অনুপস্থিতি আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যা কিনা? যে কেউ বলবেন, ‘অবশ্যই নয়।’ আমাদের স্বীকৃত জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো ঘুষ-দুর্নীতি, দারিদ্র্য, মাদক-সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য-হানাহানি, ব্যাংকিং সেক্টরে অব্যাহত হরিলুট, মানি লন্ডারিং ইত্যাদি। আর কওমি শিক্ষাঙ্গন ও তাঁদের ‘প্রোডাকশন’গুলো এসব প্রভাব থেকে ঈর্ষণীয়ভাবে মুক্ত ও পবিত্র। তাহলে জাতীয় স্বার্থে এখানে একটা সমন্বয় ও সংস্কারের এভাবে নেয়া যেতে পারে যে, যে পরশ পাথরের প্রভাবে কওমি মাদরাসাগুলো হেন অবক্ষয়ের যুগেও প্রত্যাশিত সুনাগরিক গড়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে, আমাদের সকল শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেই পরশ পাথরের সংস্পর্শে নিয়ে আসার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। আর এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মাদরাসায় রূপান্তরেরও কোনো প্রয়োজন হবে না। অনুরূপভাবে কওমি মাদরাসাগুলোতেও পর্যায়ক্রমে জাগতিক ও জীবনমুখী বিষয়গুলো চর্চাক্ষেত্র তৈরি করা যেতে পারে, তবে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেই। নিবন্ধের শেষ পর্যায় মাদরাসা শিক্ষা (আলীয়া নেসাব) উন্নয়ন ও সংস্কারে কতিপয় পরামর্শ পেশ করছি।
ক) আমাদের সংবিধান শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির কোনো সুযোগ না রাখলেও বাস্তবে স্কুল-কলেজগুলোর তুলনায় মাদরাসাগুলো কম সুযোগ-সুবিধাই পেয়ে আসছে সব সময়। এই বৈষম্যের আশু অবসান জরুরি। এ লক্ষ্যে স্বতন্ত্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি বা কলেজ প্রতিষ্ঠা, পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি ও পাঠাগার, মাঠ, বাগান ও বিনোদনের ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি।
(খ) উচ্চতর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যোগ্যতা প্রমাণের পরও কোনোভাবেই ‘মাদরাসা পড়–য়া’ বলে যেন বৈষম্যের শিকার না হয় তা নিশ্চিতকরণ।
(গ) মাদরাসাসমূহে সাধারণ ও বিজ্ঞান বিভাগের পাশাপাশি বাণিজ্য বিভাগও চালুকরণ। তবে এ ক্ষেত্রে যারা বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে পড়বে আলিম পর্যন্ত তাদেরকে কোরআন হাদিস অথবা ইসলামী আইন ও ফিক্বাহ, বিষয়ে অন্তত ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। অনুরূপভাবে যারা সাধারণ বিভাগে অধ্যয়ন করবে তাদেরকে বাংলা ও ইংরেজিতে অতিরিক্ত দক্ষতা অর্জনে ন্যূনপক্ষে ১০০ নম্বরের বিশেষ পরীক্ষায় অংশ নেয়া।
(ঘ) ষষ্ঠ শ্রেণি হতে কম্পিউটারের ওপর বিশেষ কোর্স বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা।
(ঙ) মাদরাসা শিক্ষার চেতনা তথা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি বিধানে সহশিক্ষা নিরুৎসাহিতকরণ ও বিলোপকরণ।
(চ) দাখিল ও আলিমে সূরা ‘বাকারা,’ ‘আল ইমরান’ ও ‘নিসার’ মতো সূরাগুলোর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত ছোট সূরা ও বিষয়ভিত্তিক বাছাই করা আয়াত সমষ্টি পাঠ্য করা।
(ছ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে ইসলামী বিষয়গুলোর পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি অংক, অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি জীবিকামুখী বিষয়গুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুকরণ।
(জ) অনার্স-মাস্টার্সের সকল শিক্ষার্থীর জন্য ২০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা বাধ্যতামূলককরণ। অবশ্য যারা বাংলা/ইংরেজিতে অধ্যয়ন করবে তারা নিজস্ব মেজর বিষয়ের স্থলে অন্য কোনো বিষয় অর্থাৎ (বাংলা-ইংরেজির পরিবর্তে) যাতে নিতে পারে সে ব্যবস্থা রাখা। অনুরূপভাবে সকল বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্সদের জন্য কোরআন-হাদিস অথবা ইসলামী আইন ও দর্শন বিষয়ে ২০০ নম্বর বাধ্যতামূলক করা। অবশ্য যাদের বেলায় তা কমন হয়ে যাবে (অর্থাৎ যারা কোরআন-হাদিস ইসলামী আইন ও দর্শন এমন বিষয়ই অধ্যয়ন করছে তাদের ক্ষেত্রে) তাদের জন্য তদস্থলে অন্য কোনো বিষয় পছন্দ করার সুযোগ থাকবে।
(ঝ) ‘মাদরাসা শিক্ষা’ একটি বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা। এর সর্বজনবিদিত একটি রূপ ও চাহিদা সমাজে বিদ্যমান। সুতরাং যে কোনো ধরনের সংস্কার ও উন্নয়ন সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের অনুগামী ও সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া পূর্বশর্ত। সুতরাং মাদরাসা শিক্ষাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে নয় বরং লক্ষ্যে পৌঁছার মসৃণ ও প্রশস্ত পথ নির্মাণই হবে দায়িত্বশীলদের কাজ।
এখানে প্রসঙ্গত দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় যে, জঙ্গি তথা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত শিক্ষার্থীরা যেসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সেগুলোর কোনো একটিও বন্ধ বা নিষিদ্ধ না হলেও কোনো কারণ ছাড়াই ‘পিস স্কুল’গুলো তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বছরের মাঝপথেই। অন্যদিকে ভাষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অভিযোগে আজ পর্যন্ত ভারতীয় কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ না হলেও বন্ধ হয়ে গেল ‘পিস টিভি’-এর মতো একটি জনপ্রিয় চ্যানেল। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমানÑ এটাই যেন এক দুর্ভাগ্য!
শিক্ষামন্ত্রী ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এটি তার লেখাতেই প্রকাশ। আজও সেই চেতনা বিমুক্ত নন তিনি, সেই ইঙ্গিতও প্রচ্ছন্ন। এটা সত্য বলার সৎসাহস বৈকি? তবে এখন মন্ত্রী হিসেবে তিনি ডানদেরও মন্ত্রী আর সেই সুবাদেই এই আলোচনা। আলোচ্য শিক্ষানীতি অনেক আগেই একবার পড়েছি মনোযোগ সহকারেই। তার আবেগ ও প্রচেষ্টাকে সম্মান জানাই যদিও আলোচনা-সমালোচনার মতো অনেক কিছুই বিদ্যমান। তবু এটি একবাক্যে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির একটি ফিরিস্তি দিতেও ভুল করেননি তিনি। তবে যদি সেই ফিরিস্তিতিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোরও যদি উল্লেখ করতে পারতেন তিনি! ‘যোগ্য কৃষক’ এই দাবিতেই কারো জমিতে অনুমতি ছাড়াই চাষাবাদ করার এখতিয়ার মেনে নেয়া যায় কী? রাষ্ট্রপরিচালনা বা শিক্ষানীতি প্রণয়নের মতো বিষয়ের ক্ষেত্রেও বোধকরি একই মূলনীতি সমভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং বিষয়টি জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটা নির্বাচিত সরকারের হাতেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। কেননা, দুর্বল প্রস্তুতি নিয়ে ‘বহুদূর’ যাওয়ার ঝুঁকি অনেক। ‘শিক্ষানীতি’ প্রসঙ্গে এটাই আমাদের অভিমত।
লেখক : প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।