Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্ত্রাস নয়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ বলেই সারাবিশ্বে ইসলামের বিজয় আসবে

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

মুসলমানদের জঙ্গী বলে সব রকমের সন্ত্রাসের জন্য তাদের দায়ী করার যে অসত্য রেওয়াজ গড়ে তুলেছিল পশ্চিমা বিশ্ব, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর পরিচালিত দুটি হামলায় তার অসারতা প্রমাণিত হয়েছে, আর প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছে। প্রমাণিত হয়েছে, মুসলমানরা নয় শ্বেতাঙ্গরাই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের দুটি মসজিদে হামলায় অর্ধশত মুসলিম নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়েছে সকল রকম সন্ত্রাসের জন্য মুসলমানদের দায়ী করার যে রেওয়াজ ইহুদি পরিচালিত পশ্চিমা মিডিয়া এতদিন চালিয়ে এসেছে, তা কতটা অসত্য।
এখন আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বোধদয় ঘটেছে যে, বিশ্বের কোথাও সন্ত্রাস ঘটলেই তার জন্য মুসলমানদের দায়ী করা কতটা অন্যায় ছিল। এই অন্যায়টা চোখ বুঁজে এতদিন তারা চালাত একটি বিশেষ কারণে। সে কারণটা হলো প্রতিকূল পরিবেশ সত্তে¡ও সারাবিশ্বে ইসলামের প্রসার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সারাবিশ্বে ইসলাম-বিরোধী শক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি হওয়া সত্তে¡ও ইসলামের প্রসার ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণেই যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে ইসলাম-বিরোধী প্রচারণার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে শ্বেতাঙ্গ হামলার পর তা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিউজিল্যান্ডের নিকটতম দেশ অস্ট্রেলিয়ার একটি মসজিদেও ইতোমধ্যে শ্বেতাঙ্গরা একটি হামলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে হামলায় শান্তিকামী বিশ্ব শোকে স্তব্ধ হলেও তারা তাতে এতটাই অভ্যস্ত যে বিশ্ববাসীর শোককে তারা হিসাবের মধ্যেই নেয়নি।
এরও কারণ তাদের অন্ধ ইসলামবিদ্বেষ। শত্রু যারা, শক্তি প্রয়োগের নিয়ম-নীতিও ঠিক করবে তারাই। এরমধ্যে বিবেক বা মানবিকতার কোনো প্রশ্ন আসবে না, এটাই তারা এতদিন বিশ্বাস করে এসেছে এবং এখনও করে যেতে চাইছে। কিন্তু বিশ্বে যে ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে তা যেন তারা আমলেই নিতে চাইছে না। এমন একটা সময় ছিল যখন বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। কিন্তু এখন? এখন সেই সত্য অচল হয়ে গেছে। এখন বরং পৃথিবীব্যাপী যে নতুন সত্য বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সূর্য অস্ত যায়। কারণ সে কালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বলতে এখন আর কোথাও কিছুর অস্তিত্ব নেই। জাতিসংঘের কল্যাণে এখন পৃথিবীর সব দেশই স্বাধীন-সার্বভৌম। যেখানে কোনো সাম্রাজ্যে নেই, সেখানে কোনো সাম্রাজ্য সূর্য অস্ত যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্নও নেই। তবে এ কথা অবশ্য বলা যাবে না যে, পৃথিবীতে বর্তমানে ব্রিটিশ বা অন্য কোনো সাম্রাজ্য না থাকলেও পৃথিবীর সকল দেশই বাস্তবে সমান প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে না, তা নয়। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব অন্যভাবে চালাচ্ছে বহু দেশ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে অধিক অগ্রসর হওয়ার সুযোগে।
এসব ছাড়াও অন্যান্য নানা কারণে পৃথিবীতে গড়ে উঠছে নানা আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। এর কোনো কোনোটি আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বার্থে। এ ব্যাপারে সার্ক তথা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থার কথা উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও ধর্মীয় বিকাশে সহযোগিতার কারণে গড়ে উঠেছে কোনো কোনো সংস্থা। যেমন ওআইসি।
মাঝে-মধ্যে কোনো দেশের একই সাথে দুটি আঞ্চলিক সংস্থার সদস্য ভুক্ত হওয়াতে সমস্যাও হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের রয়েছে বিশেষ সমস্যা মোকাবেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা। সকলেই জানেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধর মাধ্যমে বাংলাদেশ লাহোর প্রস্তাবের আলোকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা দানে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের মানুষ ও সব সরকার এ জন্য সব সময়ই ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে। তবে ভারতের সম্ভবত আশা ছিল, একারণে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের সময় ভারতের পরামর্শ গ্রহণ করবে।
এ নিয়ে একবার বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জগৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে যাত্রা শুরু করে।
ইতোমধ্যে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে প্রথমে লন্ডন যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে, ভারতের ইচ্ছার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবস্থান করছে। এটা জানতে পেরে তিনি নিজের ইতিকর্তব্যও ঠিক করে ফেলেন। সকলেই জানেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামার সময়েই তিনি বাংলাদেশকে অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসাবে ঘোষণা দেন। এতে তাঁর দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি দিকও প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য হওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসির একটি অধিবেশন আহূত হয় এবং বাংলাদেশ সে অধিবেশনে যোগদান করবে বলে জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে যোগদানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভারত। ভারত বঙ্গবন্ধুর এ সম্মেলনে যোগদানের বিরোধিতা করে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর উপদেশ কামনা করেন। মওলানা ভাসানী সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেন, তুমি যদি একটি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাকো, তাহলে তোমার মনে যা চায়, তা করো। আর তুমি যদি ভারতের আশ্রিত নেতা হয়ে থাকো, তাহলে ভারত যা বলে তা করো।
এতে বঙ্গবন্ধু তাঁর জবাব পেয়ে যান এবং লাহোর ঐতিহাসিক সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে বঙ্গবন্ধু যেদিন লাহোর, যান, সেদিন ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, ভারত বাংলাদেশকে মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা দান করলেও ভারতের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ভারতের আজ্ঞাবাহী দেশ হিসাবে পাওয়া, একটি প্রকৃত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে নয়।
আজকের এ লেখা শেষ করার আগে যে কথাটি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে চাই, তা হলো মুসলমানদের অন্যান্য জাতির সঙ্গে সমতাভিত্তিক সম্পর্কই আমাদের কাম্য। নিউজিল্যান্ডের দুটি মসজিদে যেভাবে হামলা হয়েছে খ্রিস্টানদের ওপর সেভাবে মুসলমানরা পাল্টা হামলা চালানোর পক্ষপাতী নয়। কারণ সেটা ইসলাম বিরোধী। ইসলাম বিশ্বাস করে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুসারে ধর্ম পালন করার অধিকার আছে। ইসলামের এই উদার নীতির কারণেই আজ ইতিহাসে সবচাইতে দ্রুত প্রসারণশীল ধর্ম বিশ্বাস হিসাবে সে এগিয়ে চলেছে।
পক্ষান্তরে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানরা যেন তেন প্রকারে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধির যে কোনো অন্যায় পথ অবলম্বন করার পক্ষপাতী। অতীতে যখন উপমহাদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন ছিল তখন তারা এ ধরনের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রমুখ ইসলাম প্রচারকের কল্যাণে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রথমদিকে সেক্যুলারিজমের নাম ভাঙ্গিয়ে ইসলামের প্রশ্নে বাধা দেয়ার অপচেষ্টা চালায় মিত্র রাষ্ট্রের দাবিদার ভারত। কিন্তু তাদের সে অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুটি বড় ভিত্তির একটি বাংলা ভাষা হলেও আরেকটি যে ইসলাম, এ সম্পর্কে কারো কোনো দ্বিধা নেই।
আমরা যারা বাংলাদেশকে অধিক হতে অধিকতর শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাদের কর্তব্য হবে স্বাধীন বাংলাদেশের এ দুটি ভিত্তিকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করে তোলা। এব্যাপারে উদাসীনতা দেখিয়ে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলে দাবি করতে পারে না। একথাও অত্যন্ত জোর দিয়ে সকলকে বলে রাখতে চাই, সন্ত্রাস কোনো দিনই ইসলাম সমর্থন করে না।
যে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় একদা পৃথিবীতে নিজেদের শাসন ও শোষণ কায়েম করেছিল, আজ তারাই তাদের অতীত প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নিচ্ছে, যার বাস্তব দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। ইসলাম শান্তি, সাম্য ও সর্বাঙ্গীন ভ্রাতৃত্বের বলে বলিয়ান হয়েই পৃথিবীতে এগিয়ে যাবে। এ বিশ্বাস আমাদের দৃঢ়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সন্ত্রাস


আরও
আরও পড়ুন