চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
‘নীলসিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া/ আম্মা! লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া। কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/ সে কাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোরাতে’। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি যেদিন ভয়ে শিহরিত হয়ে গিয়েছিল, যে দিন শান্ত পশুরা কারবালার নিষ্ঠুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ভয়ে শিহরিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের আহাজারি ও আত্মবিলাপে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছিল, রাঙ্গা খুনে লাল হয়ে গিয়েছিল কারবালার প্রান্তর, এই সেই আশুরা দিবস, কারবালা দিবস ১০ই মুহাররম। এই দিনে হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) ফোরাত নদীর উপকুলে কারবালার প্রান্তরে তাঁর ৭২ জন সাথীসহ শহীদ হয়েছিরেন ইয়াযীদের বাহিনীর হাতে।
ইসলামের ইতিহাসের কুচক্রী শাসক ইয়াযীদের তত্ত্বাবধানেই এই বিষাদময় ঘটনার ফলক উন্মোচিত হয়। কুফার লোকদের আমন্ত্রণে হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) সেখানে যেতে চাইলে পথিমধ্যে ইয়াযীদের নরপশু সৈন্যরা তাঁকে গৃহবন্দী করে এবং পানির সংকটে ফেলে দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে। কুহক পাতক মায়াবী ছলনাময়ী অর্থের লালসায় পড়ে মানুষত্বহীন পিচাশ সীমার হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) কে শহীদ করেছিল এবং তাঁর খণ্ডিত মস্তক নিয়ে হাজির হয়েছিল স্বৈরাচারী শাসক ইয়াযীদের দরবারে। যা দেখে মানবতা সেদিন আর্তনাদ করছিল : ‘আমাকে বাঁচাও’ ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে।
সাহসী সিপাহসালার হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন আপোষহীন সংগ্রাম চেতনার অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব। ইতিহাসের পাতায় হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) একজন অকুতোভয়ী সাহসী বীর সেনাপতির নাম। যাঁর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছিল একাধারে বীরত্ব, সহিষ্ণতুা, আত্মত্যাগ, মানবতা এবং অনুপম চরিত্রের। ন্যায়ের জন্য দ্বীনের জন্য সত্যের জন্য চুড়ান্ত সর্বনাশা বাতিল শক্তির মোকাবিলায় তিনি নির্ভীক চিত্তে কথা বলেছিলেন, লড়াই করেছিলেন। দ্বীন ও মিল্লাতের স্বার্থ বিরোধী সকল স্বৈরাচারী ধর্মনিরপেক্ষ স্বার্থান্বেষী অপশক্তিগুলোর মোকাবিলায় তিনি ছিলেন এক ভয়ংকর আতংক। ইসলামের অনুসারী কোন ঈমানদার মানুষই কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করে না। ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফ শিক্ষা দেয়, তাতে পক্ষপাতিত্ব নেই। কুরআন ও হাদীস যে মুসলিম উম্মাহর সংবিধান। কারো মনগড়া মতবাদ ইসলাম স্বীকার করে না, মুসলিম উম্মাহ মেনে নিতে পারে না। শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই কথাগুলো তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। সর্বদাই অন্যায় আর অসত্যের বেড়াজালগুলো ছিন্ন ভিন্ন করে দিতেন, বলিষ্ঠভাবে। তাই তো ইয়াযীদের বশ্যতা স্বীকার না করে তিনি শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন সানন্দে। তবু তিনি দ্বীন ও মিল্লাত বিরোধী চুক্তিতে আপোষ করেননি। ‘মুসলমান ভাংগে, তবু মচকায় না’-এর বাস্তবতা তিনি তাঁর জীবনের বিনিময়ে দেখিয়ে গেলেন। তাই এই সাহসী সিপাহসালারের আলোকিত নাম পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং লেখা থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত।
‘ফিরে এলো আজ সেই মহাবরণ মাহিলা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাইনা। উ‘ীষ কুরআনের, হাতে ত্যাগ আরবীর/ দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো র্শি।’
হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর দ্যুতিময় জীবন হতে মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দিতে হবে যে, মুসলমানরা তাগুতী শক্তির সাথে কখনো কিছুতেই আপোষ করে না। মুসলমানরা কখনো আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তির কাছে মাথা নত করে না। সত্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠা কল্পে মুসলমানগণ বুকের তাজা রক্ত অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারে। তারা পারে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করতে। তারা ঘোষণা করতে পারে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে-‘ঐ শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা/ শমসের হাতে নাও, বাঁধো শির আমামা। জেগে উঠ মুসলিম হাঁকো হায়দারী হাঁক/ শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক।’
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায় হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার সাথীরা যে ত্যাগ ও করবানী স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আগতব্য মুসলিম উম্মাহর জন্য তা প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। গর্জে উঠবে মজলুম মানুষেরা ইমাম হুসাইনের সাহসী চেতনা বুকে ধারণ করে জালিমের বিরুদ্ধে। শত্রু পক্ষের একটি তীর এসে বিঁধল শিশু আব্দুল্লাহর কচি দেহে। মুহূর্তেই একটু ঝাঁকুনি খেল, তারপর করুণ আর্তনাদ, নিষ্পাপ মুখে বিষাদের ছায়া, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে কচি দেহটি, তারপর চিরশান্ত। পলকেই নিথর এই অমিয় মুখখানা। অগোচরে পান করল শাহাদাতের অমিয় সুধা। স্তব্ধ-বালিয়াড়ি, ফোরাত, মরু সাহারা, কারবালা! বাতাসের বিরহ-সুর তো নয়- করুণ কান্না, অদৃশ্যে অশ্রুপাত! চলমান ফোরাতের জল-! হায়, মর‘ সাহারায় এ কেমন বিষাদের দাবানল! তপ্ত বালিয়াড়িতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন হুসাইন (রা.)! রাসূল (সা.)-এর হৃৎপিন্ড! ফাতেমার লালিত কলিজার টুকরা! চোখের সামনে ছেলে আবদুলাহর নিথর দেহ পড়ে আছে। রক্ত ঝরছে দেহ থেকে। ঝরে পড়া একটুখানি রক্ত হাতে নিয়ে বালিয়াড়িতে মাখলেন হোসাইন! অসহায়, অনন্ত বিরহী! আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠলেন, ‘হে প্রভু! ওরা অত্যাচারী, ওদের বিচার তুমি নিজেই করো! প্রতিশোধ গ্রহণের ভার তোমার ওপরই রাখলাম’। হিজরি ৬১ সালের যবনিকা উঠল। ইসলামী খেলাফতের বিশাল এলাকাজুড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। মতার জন্য ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া সংগ্রাম করছেন। আমজনতার মধ্যে চাপা ক্ষোভ। কিন্ত কেউ তার বিরুদ্ধে দাবি তুলছে না। খেলাফতের ঘনায়মান সন্ধ্যায় অদৃশ্যে শত্রুতার জাল বোনা চলছে। চারদিকে লোমহর্ষক শোরগোল। মক্কা-মদিনা থেকে শুরু করে কুফা, বসরা এবং পুরো ইসলামী খেলাফতজুড়ে নীরবে বয়ে চলছে শত্রুতার নিঃশ্বাস! খেলাফতের সোনালি সূর্য ডোবার অন্তিম আবাস! হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খেলাফতের ভার ন্যস্ত করে গিয়েছেন তার ছেলে ইয়াজিদের হাতে। তিনি খেলাফতের জন্য তার ছেলেকেই যোগ্য মনে করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম রাজ্যগুলো এটা মেনে নিতে পারেনি। এমনকি এর বিরোধিতা করলেন স্বয়ং হোসাাইন ইবনে আলিও (রা.)। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) খেলাফতের ক্রান্তিকালে এসে তীব্রভাবে অনুভব করলেন- ইসলামী খেলাফতজুড়ে শুধু হতাশা, নিরাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু এরই মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, কুফা এবং বসরার গভর্নররা ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত নিতে শুরু করেছেন। সর্বত্র প্রচার হয়ে গেল ইয়াজিদ এখন সবার খলিফা-আমিরুল মুমিনিন। হিজরি ৬০ সালের যবনিকাপাত হল। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) চির বিদায় নিলেন। অন্তিমকালে তিনি ছেলে ইয়াজিদকে বলে গেলেন- ‘সাবধান! আমার অনুপস্থিতিতে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় হোসাইনকে পূর্ণ মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবে, মুসলমানদের ওপর তাঁর দাবি অনেক বেশি। যদিও তিনি তোমার হাতে বাইয়াত না হন এবং যুদ্ধে তুমি বিজয়ী হও তবুও।’ কিন্তু ইয়াজিদ খেলাফতের মসনদে বসেই এ অধ্যাদেশ জারি করল-‘হজরত হুসাইনসহ তার সঙ্গীদের থেকে খেলাফতের বাইয়াত নেয়া হোক। সহজে রাজি না হলে প্রয়োজনে কঠোর পন্থা অবলম্বন।’ অথচ হজরত মুয়াবিয়ার মৃত্যু সংবাদ এখনও মদিনায় পৌঁছেনি। হজরত হোসাইন (রা.) তখন এখানেই অবস্থান করছিলেন। জাতির কলঙ্ক মারওয়ান হজরত হোসাইনকে হজরত মুয়াবিয়ার মৃত্যুর সংবাদ এবং ইয়াজিদের অধ্যাদেশ শুনিয়ে দিল এবং গোপনে হজরত হোসাইনকে হত্যার পরিকল্পনাও সে করেছিল। হজরত মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যু সংবাদ শুনে হজরত হুসাইন (রা.) গভীর সমবেদনা প্রকাশ করলেন এবং ইয়াজিদের বাইয়াত অস্বীকার করলেন। তিনি প্রত্যক্ষ করলেন মদিনার আবহাওয়া এখন তার অনুকূলে নয়। অবস্থা করুণ-ঘোলাটে! তাই তিনি সপরিবারে মদিনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা করলেন। রাসূল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত করে মদিনাকে সালাম দিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে নানাজানের প্রিয় শহরকে বিদায় জানালেন। মক্কায় গিয়ে সেখানেই অবস্থান করলেন। চারপাশ থেকে শুভাকাঙ্খীরা এসে তাকে সালাম জানাতে লাগল। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা আর এবাদতে সময় কাটছে। কিন্তু চারপাশে কেমন যেন বিষাক্ত পরিস্থিতি বহমান। ওদিকে ইবনে আকিলের চিঠি, কুফার সংবাদ। সেখানের আমজনতা হজরত হোসাইনের (রা.) জন্য অধির আগ্রহে বসে আছে প্রিয় হোসাইনের হাতে বাইয়াত হবে বলে। সেখান থেকে বার বার চিঠি আসছে বিভিন্ন জনের নামে। হজরত হোসাইন মনে করলেন পরিস্থিতি অনুকূলে তাই তিনি কুফার উদ্দেশে রওনা দিলেন সঙ্গী-শুভাকাক্সীদের শত বাধা সত্ত্বেও। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ইয়াজিদের আদেশে ইবনে আকিলকে শহীদ করা হয়েছে। সময় এখন ইয়াজিদের। ভীতসন্ত্রস্ত্র জনতা এখন তারই কথা বলে। দিনার-দেরহাম বোবা মুখেও বাক ফোটায়, শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করে। কিন্তু প্রিয় হোসাইন তো এরই মধ্যে পৌঁছে গেছেন ‘হাজির’ নামক স্থানে। মুহূর্তেই এ খবর পৌঁছে গেল কুলাঙ্গার ইবনে জিয়াদের কানে। সে একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা প্রেরণ করল হজরত হোসাইনকে প্রতিরোধের জন্য। হজরত হোসাইন এরই মধ্যে ‘আসাবা’য় পৌঁছে গেছেন। ‘যাবালা’য় থাকতেই তিনি ইবনে আকিল ও অন্যদের শাহাদাতের খবর পেয়েছেন। ব্যথিত মন নিয়ে, ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে অলক্ষ্যে চোখে তবুও তিনি পথ চলছেন। আসু পরিস্থিতির করুণ পরিণতি জেনেও সামনে এগোচ্ছেন। অত্যাচারীর খোলা তলোয়ার সামনে-তবু ভয় নেই। যুগে যুগে যদি হোসাইন জেগে না ওঠে তবে কে রুখবে এ জালিমদের? হোসাইন তো পারতেন ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণ করে সুখে জীবন কাটাতে! কিন্তু তা করেননি। তিনি এই বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন অসত্যের সামনে মাথা নোয়াতে নেই, মৃত্যু অবধারিত জেনেও সত্যের পে লড়তে হয়। আজকের হোসাইনপ্রেমিকরা মাতম করে, হাহুতাশ তোলে, রোজা রাখে, আবার কেউবা কারবালার ময়দানকেই ঘৃণা করে, মহররমের দশম তারিখকে মন্দ দিন মনে করে, হায়রে প্রেমিকের দল! আজকের দুনিয়ায় ইয়াজিদ-শিমারদের কত ছড়াছড়ি, তবে একালের হোসাইনরা কোথায়? কেন জাগছে না? আজকের দুনিয়া কেন শিখছে না? অসত্যের সামনে যে মাথা নোয়াতে নেই!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।