Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতন এবং তার কারণ

সেলিম সামীর | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

যে মুসলিম জাতি এক সময় দুর্দন্ড প্রতাপের সাথে অর্ধ পৃথিবী শাসন করল; বিশ্বের নেতৃত্ব দিলো, কেন তারা আজ বিশ্বের নেতৃত্ব হারালো? যারা ছিল মানব সভ্যতার জন্য এক উজ্জ্বল মডেল, কেন তারা আজ বিশ্ব দরবারে এতো অবহেলিত? যারা ছিল নির্যাতিত-নিষ্পেষিত মজলুম মানবতার ত্রাণকর্তা, কেন আজ তারাই নির্যাতিত-নিষ্পেষিত, অপমানিত-লাঞ্ছিত?
আমরা মুসলিম। আর মুসলিম মানেই মহান প্রভূর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী মানুষ। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার মাধ্যমে আল্লাহর প্রেরিত জীবনবিধান নিজের জীবনে সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে গুণ প্রকাশ পায়, তাই মানুষকে মুসলমান বানায়; একজন মানুষ পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু এই মুসলমানিত্বের প্রতিফলন আমাদের জীবনে খুবই কম। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানার মাধ্যমে আল্লাহর সামনে আমাদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত হওয়ার কথা ছিল; অথচ তার আইনের সামনে আমরা উদ্ধত। আমরা সৎ কাজের আদেশ তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অসৎ কাজের নিষেধ তথা অন্যায়ের উৎখাতে ব্যাপৃত থাকার কথা ছিল; অথচ আমরাই অসৎ কর্মে লিপ্ত, পথহারা, বিভ্রান্ত। আমরা কুরআনকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মানি কিন্তু এ ‘কোরআন’ নামক জীবন বিধানের বাস্তবায়ন আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। আমরা এ কোরআন দিয়ে নামাজ পড়ি কিন্তু এর দ্বারা আমাদের সমাজ গড়ি না। আমরা একে ‘সব সমস্যার সমাধান’ হিসেবে বিশ্বাস করি, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় এর প্রয়োগ নেই। অথচ, আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ কর।’
নিজে জ্ঞান অর্জন করা, অন্যকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহ দেয়া, জ্ঞান দেওয়া, নিজে সৎ পথে থাকা, অন্যকে পথে আনা, নিজে ভালো হওয়া, অন্যকে ভালো করা, নিজে খারাপ পথ থেকে দূরে থাকা, অন্যকে খারাপ পথ থেকে বিরত রাখা মুসলমানদের অপরিহার্য কর্তব্য। কিন্তু তারা যখন অন্যকে জ্ঞান দেওয়া, ভালো করা এবং সৎ পথ দেখানোর কাজ ছেড়ে দিলো তখন তারা নিজেরাও অশিক্ষিত, জ্ঞানহীন অধঃপতিত এবং পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ল। এরকম একটি জাতির অনৈক্যের হওয়া, শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী। প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য সমর শক্তির যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তির। আর এ মানসিক শক্তি আসে সুশিক্ষা, সৎ চরিত্র এবং জাতিগত মহত্তর আদর্শ থেকে। আর এগুলো মুসলমানদের মধ্য থেকে বিলীন হয়ে যাবার কারণে তারা নেতৃত্বের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে; যার ফলে তারা বিশ্ব নেতৃত্বের আসন থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; তাদের পতন ঘটেছে। জনৈক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, That the decline of islam began when people started to lose faith in the sincerity of its representatives. অর্থাৎ, ইসলামের পতন সেদিন থেকেই শুরু হলো, যেদিন থেকে মানুষ ঐ সমস্ত লোকের সততার ব্যাপারে, তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে লাগল, যারা ঐ ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছিল।
আমরা মুসলমানদের চরম উন্নতি ও পতনের সীমা চিহ্নিত করতে গিয়ে ঐ রেখার প্রতি অঙ্গুলি সংকেত করব যে রেখা খেলাফতে রাশেদা ও মুসলমানদের বাদশাহী যুগের মধ্যে বিভাজনকারী সীমারেখা। প্রথম অংশে দুনিয়ার নেতৃত্বের বাগডোর সেই সমস্ত ব্যক্তির হাতে ছিল, যাদের প্রত্যেকে তার ঈমান-আক্বিদা, আমল-আখলাক, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং উন্নত চরিত্রের দিক থেকে ‘অল পারফেক্ট’ হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন যদিও রাসূল (সা.) ছাড়া কেউ ‘অল পারফেক্ট’ হতে পারে না। কিন্তু রাসূল (সা.) তাদেরকে ইসলামের ছাঁচে এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন যে, একমাত্র দেহ ছাড়া তাদের আপন অতীতের সঙ্গে আর কোনো সামঞ্জস্য অবশিষ্ট ছিল না। না অভ্যাস ও প্রবণতার ক্ষেত্রে, না মন মানসিকতার ক্ষেত্রে, না চিন্তাভাবনার পন্থার মধ্যে, না প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে। এ সমস্ত ব্যক্তিত্ব আধ্যাত্মিকতা ও জাগতিকতার সমন্বয়ের জ্বলন্ত নমুনা ছিলেন। তারা একাধারে নামাজের ইমাম, কাজী ও বিচারক, মুত্তাকী-সাধক, সিপাহী ও মুজাহিদ, মুজতাহিদ ও ফকিহ, কুশলী সিপাহসালার, অভিজ্ঞ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ও নিপুণ রাজনীতিক ছিলেন। অনন্তর তাদের প্রাণসত্তা সভ্যতা সংস্কৃতির সমগ্র কাঠামোতে, রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে এবং মানুষের সামগ্রিক জীবন, সমাজ ও চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে যায়। তাদেও বৈশিষ্ট্যাবলীর পূর্ণ প্রতিবিম্ব পড়ে। সেখানে আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুবাদের মধ্যে কোন দ্ব›দ্ব ছিল না, ছিল না ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ। ধর্মই ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল উপাদান। সেখানে দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বিভাজন ছিল না, ছিল না নীতি ও উপযোগিতার মধ্যে কোনো রকম টানাপোড়েন। নৈতিক চরিত্রের মধ্যে ছিল না কোনো শঠতা-কলুষতা। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-স¤প্রদায় ও দল উপদলের মধ্যে পারষ্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ বা প্রবৃত্তিজাত কামনা-বাসনার ভিতর পারষ্পরিক প্রতিযোগিতা ছিল না। মোটকথা, তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ও ইসলামী সালতানাতের সমাজ জীবন এর শাসকদের নৈতিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ভারসাম্য ও সামগ্রিকতার পূর্ণ দর্পণস্বরূপ ছিল।
মুসলমানদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এমন সব লোকের হাতে থাকার কথা ছিল যারা সামনে আসা জীবনের নতুন নতুন সমস্যা সংকটকে এককভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে সঠিক ও যথাযথ ফয়সালা করার সামর্থ্য রাখেন এবং ইসলামের আইন প্রণয়নের মৌল নীতিমালা সম্পর্কে খুবই অবহিত এবং পারঙ্গম হবেন। অধিকন্তু তারা এতটা মেধা, কার্যক্ষমতা এবং জ্ঞানের অধিকারী হবেন, যাতে আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিজগতে এবং জমীনের বুকে যে প্রাকৃতিক সম্পদ, শক্তির উৎস রেখে দিয়েছেন তা থেকে তারা কাজ নিতে পারেন। বাতিলপন্থীরা সেগুলোকে তাদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে ব্যবহার করবে এবং জমীনে ফেতনা, ফাসাদ, অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টির কাজে এসবের সাহায্য নেবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর অনুগত বান্দারা এসব থেকে সেই কাজ নেবে যেজন্য আল্লাহ পাক এসব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নেতৃত্বের মর্যাদামন্ডিত আসনে বসা এসব লোকের মধ্যে উপরোল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের কোনোটাই ছিল না। এরা ছিল এসব কাজের সম্পূর্ণ অযোগ্য। অন্যদিকে এদের কারণে ধর্ম ও রাষ্ট্রনীতির মধ্যে কার্যত বিভাজন দেখা দেয়। কেননা এসব শাসকগণ জ্ঞানে-গরীমায় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এতটুকু যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না যে, তাদের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী লোকদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না। তারা হুকুমত ও রাষ্ট্রনীতিকে নিজেদের হাতেই রাখেন এবং যখন তারা চেয়েছেন কিংবা যখন পরিবেশ পরিস্থিতির দাবি দেখা দিয়েছে তখনই কেবল পরামর্শদাতা ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে উলামায়ে কেরাম ও দীনদার বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য নিয়েছেন এবং যেটুকু পরামর্শ মনমত হয়েছে তা গ্রহণ করেছেন বাকিটা পাশে রেখে দিয়েছেন; সে মতে রাষ্ট্রীয় কাজ আনযাম দেননি।
এভাবে রাষ্ট্রনীতি ধর্মের খবরদারী ও তত্ত্বাবধান থেকে মুক্ত হয়ে শেকলবিহীন হাতির মতো লাগামহীন হয়ে পড়ে। এসব রাষ্ট্রনায়কগণ ধর্মীয় আদর্শ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা তো দূরের থাক, নিজেরাই ধর্মীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েন। আরাম-আয়েশ, ভোগবিলাস এবং প্রবৃত্তিপুজায় তারা লিপ্ত হয়ে পড়েন। জৈবিক কামনা-বাসনা পূরণে তারা নিজেদেরকে বিলীন করে দেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রবৃত্তি প্রবণতা ও মন মানসিকতার প্রভাব জাতীয় জীবনের উপর পড়ে। তাদের অধঃপতিত বৈশিষ্ট্য হুকুমতের গোটা ব্যবস্থায়, জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে পরিপূর্ণভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। বিলাস ব্যসন ও প্রবৃত্তিপুজায় প্রাধান্য প্রতিষ্টিত হয় এবং ভোগবিলাসের সয়লাবে সমগ্র সাম্রাজ্য ডুবে যায়। সেখানে আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে শুরু হয় সংঘাত-সংঘর্ষ; ধর্ম রাজনীতি থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেখানে দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে বিভাজন তৈরী হয়, বিভিন্ন শ্রেণি-সম্প্রদায় ও দল উপদলের মধ্যে শুরু হয় পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহ, প্রবৃত্তিজাত কামনা বাসনার ভেতর পারষ্পরিক প্রতিযোগিতা। ফলে মুসলিম জনপদগুলোর ভেতর জাহিলিয়্যাত শ্বাস গ্রহণের অবাধ সুযোগ পায়। আরাম আয়েশ, ভোগবিলাসে মুসলিম জাতি আকণ্ঠ ডুবে যায়। এই নৈতিক অধঃপতন ও ভোগবিলাসে মত্ত মুসলিম জাতির পক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা, রাসূল (সা.) এর আদর্শ বাস্তবায়ন করা, বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনতর অবস্থায় জাতি তার নিজের অস্তিত্ব, সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখার শক্তিও খুইয়ে বসে। মুসলিম উম্মাহর পতন তরান্বিত হয়।
মুসলিম উম্মাহর সে হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে জাতির সোনালী যুগের সে আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারন করতে হবে। আজও যদি আমরা কোরআনকে আমাদের জীবনের সামগ্রিক পর্যায়ে পরিপূর্ণভাবে বাস্থবায়নের কাজে ব্রতী হই, নিজেরা বিশ্বাসদ্বীপ্ত জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত হয়ে আমাদের জ্ঞান ও শিক্ষা ইসলাম প্রচারে, মানুষকে পথ দেখানোর মিশনে ব্যবহার করি, যদি পুলিশের দক্ষতা ও সৈনিকের যোগ্যতা অর্জন করি, যদি সাহাবাদের মত ‘অল পারফেক্ট’ হওয়ার অবিরত প্রয়াস চালাই তাহলে বিজয় আমাদের আসবেই, বিশ্ব সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব আবার আমরা ফিরে পাবই। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবতার কলাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে এবং অকল্যাণ থেকে দূরে রাখবে আর ঈমান রাখবে শুধু আল্লাহর উপর।’
লেখক : কলামিস্ট



 

Show all comments
  • jack ali ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১০:৪২ পিএম says : 0
    What you mentioned in your article----Each and Everything happening in our country ---Not a single government run our golden Bangladesh by the Law Of Allah [SWT] They Disobey--as a result our country is Doomed----No Peace---also environmental Disaster as well-----May Allah Guide them so that we the general people can live in peace with respect as a human being ---by our tax payer money ----their salary is paid in full but our right have been violated violently''''''We cannot even whisper-----My driver went to cast his vote---they told him your vote have been cast ----go home---What a wonderful new government will do to us ?????????
    Total Reply(1) Reply
  • ডাঃ মোঃ সাইদুর রহমান ২৫ অক্টোবর, ২০২০, ৫:৪০ পিএম says : 0
    বিশ্ব মুসলিমদের নেতৃত্ব দেওয়ার মত বর্তমানে কোন নেতা নেই ! হয়ত ইমাম মাহাদী সেই শূণ্য স্থান পূর্ণ করবেন !
    Total Reply(0) Reply
  • Sumon Hossain ২৬ অক্টোবর, ২০২০, ৩:২৭ পিএম says : 0
    অসাধারণ লেখনি।জাতির এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে এই লেখনি হোক সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনার প্রধান পাথেয়।।
    Total Reply(0) Reply
  • Jobayed kader ali jimu ১২ আগস্ট, ২০২১, ৫:৫৩ এএম says : 0
    চমৎকার!আমাদের উচিৎ sir এর কথা গুলো মানা পরে ভালো লাগছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলিম


আরও
আরও পড়ুন