Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হামলা উত্তাপ ও শঙ্কার বিস্তার ঘটাচ্ছে

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:১১ এএম

গত শনিবার নোয়াখালী-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী, দলের যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সোনাইমুড়িতে নির্বাচনী প্রচারণাকালে তিনি সরকারীদলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের হামলার সম্মুখীন হন। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে তিনি সহ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১২জন বিরোধী দলীয় প্রার্থী প্রতিপক্ষের হামলায় শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে বের হওয়ার পথে জাতীয় ঐক্যফ্রণ্টের শীর্ষনেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। তিনি অক্ষত থাকলেও তাঁর এবং জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রবের গাড়িসহ ঐক্যফ্রণ্টের নেতাদের ৭-৮টি গাড়ি ভাংচুর হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৩০ জন কর্মী-সমর্থক। এসব ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। এরূপ ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, অত্যন্ত উদ্বেগজনকও। উল্লেখ করা যেতে পারে, এর আগে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মঈন খান, মেজর হাফিজ উদ্দীন আহমদ, জেএসডি নেতা আসম আবদুর রব, গণফোরাম নেতা অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রমুখের ওপর হামলা হয়েছে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারনা শুরুর হওয়ার পর থেকেই বিএনপি, ২০ দল ও ঐক্যফ্রণ্টের নেতাদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে। প্রার্থী, নেতাকর্মী-সমর্থক কেউই এই হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পত্রপত্রিকার তথ্যও বিবরণ অনুযায়ী, ১০ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিনে দেশের অন্তত ৫টি স্থানে বাধাদান ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার ১৮টি জেলায়, বুধবার ১৭টি জেলায়, বৃহস্পতিবার ২৩টি জেলায় এবং শুক্রবার ৮টি জেলায় বাধাদান, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকরাই প্রধানত এই বাধাদান, হামলা ও সংঘর্ষের জন্য দায়ী। তাদের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের অংশগ্রহণও লক্ষ্য করা গেছে। বাকী সব ক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকা নিরবদর্শকের। অন্যদিকে পুলিশের ধরপাকড় বরাবর অব্যাহত থাকলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর রীতিমত বেপরোয়া রূপ নিয়েছে। বিএনপির তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে মামলা হয়েছে ১৫৮টি এবং গ্রেফতার হয়েছে ২৫৪৬ জন। আর ১০ ডিসেম্বর প্রচারণা শুরু হওয়ার পর মামলা হয়েছে ১৫টি এবং এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৫৫৬ জন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, গত শুক্রবার গ্রেফতার হয়েছে অন্তত ২১৬ জন। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের এই তান্ডবের ফলে দেশের সর্বত্র একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রচারে নামলেই হামলা এবং একই সঙ্গে মামলা ও গ্রেফতারের বিদ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি, ২০ দল ও ঐক্যফ্রণ্টের প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারছেন না। কর্মীদের মাঠে নামার তো প্রশ্নই ওঠেনা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় সিইসি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেয়া ও ধরপাড়ক করা যাবেনা। আইনশৃংখলা বাহিনী তার এ নির্দেশনা অমান্য করেই মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারেনি বা পারছেনা। নতুন নতুন মামলা ও এসব মামলায় গ্রেফতার তো হচ্ছেই, সেই সঙ্গে পুরানো মামলায় আসামী দেখিয়েও অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ধরনের গ্রেফতার থেকে প্রার্থীরা পর্যন্ত বাদ পড়ছে না। নজির হিসাবে গাজীপুর-৫ আসনে প্রার্থী বিএনপি নেতা ফজলুল হক মিলনের গ্রেফতারের কথা উল্লেখ করা যায়।
নির্বাচনের অভয় পরিবেশ এবং সকলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন সেটা এখনো করতে পারেনি। করার কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়নি। ঐক্যফ্রণ্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের অভিযোগ : ‘তফসিল ঘোষণার পর কে এম নূরুল হুদা নির্বাচন কমিশন এখনো সরকারের আদেশ-নির্দেশ পালন করছে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’ সেদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলার পর সিইসি জানিয়েছিলেন, এ ঘটনায় ইসি বিব্রত। এ নিয়ে বিশ্লেষকরা তাকে কার্যত তুলোধনা করেছেন। তাদের মতে, সিইসির বক্তব্য ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার একটা কৌশল মাত্র। ইসি বিব্রত হবে কেন? ইসির হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে। উপযুক্ত প্রতিকারের জন্য ইসি তার ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করবে, এটাই প্রত্যাশিত। তা না করে তার বিব্রত হওয়া কেন?
গত কয়েকদিন বিরোধীদলের নির্বাচনী প্রচারণার বাধাদান, হামলা, সংঘর্ষ, পুলিশের মামলা ও গ্রেফতার ইত্যাদির ব্যাপারে ইসি কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপই নেয়নি। উল্টো সিইসি নির্বাচন নিয়ে তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্রের আশংকা ব্যক্ত করেছেন এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। সাধারণত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত¡’ উপস্থাপন করা হয়। প্রতিপক্ষ বা কল্পিত তৃতীয় পক্ষের ওপর দোষ আরোপ করা হয়। এটা রাজনৈতিক বেলোচাল হিসাবে পরিচিত। প্রশ্ন উঠতে পারে, সিইসি কেন রাজনীতিকদের ভাষায় কথা বলবেন? নিজেদের অপারগতা, অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা আড়াল করতেই কি এই তৃতীয়পক্ষের ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন সিইসি? সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার যদি সঠিকভাবে, নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন তাহলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ কায়েম না হওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনী সংঘর্ষ ও সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব যদি ইসি ত্বরিত ও যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ইসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাভ করেছে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার জন্য এই উভয় প্রশাসনকে ব্যবহার বা কাজে লাগানোর দায়িত্ব ইসির। ইসি কি সেই দায়িত্ব পালন করছে বা করতে পারছে? পারছে না। এর পেছনে তার ইচ্ছা, আন্তরিকতা ও সক্ষমতার ঘাটতি থাকতে পারে। সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন যদি ইসির কথা না শোনে, তবে সেটা ইসির শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় হিসাবে গণ্য। সেক্ষেত্রে ইসির উচিৎ বিষয়টি প্রকাশ করা, স্বীকার করা যে, তাদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই।
এর আগের স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতে, ব্যতিক্রম বাদে, লক্ষ্য করা গেছে, সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন একট্টা হয়ে কাজ করেছে এবং সরকারের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ওই রকম হোক, এটা কেউ কামনা করেনা। অথচ অবস্থাদৃষ্ট অনেকেরই মনে হতে পারে, এ নির্বাচনও ‘নিয়ন্ত্রিত’ নির্বাচনই হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের মাঠে নির্বাচন কমিশন রেফারীর ভূমিকা পালন করে। রেফারীর কাজ পক্ষপাতমুক্ত থাকা। তাহলেই নির্বাচন প্রশ্নহীন হতে পারে। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার অভিযোগ করেছেন: ‘মাঠে খেলোয়াড় ফাউল করলে রেফারী বাঁশি বাজিয়ে ব্যবস্থা নেয়। নির্বাচনও একটি খেলা। বিভিন্ন দল নির্বাচন নামের খেলায় নেমেছে। ফাউল হতেই পারে। ব্যবস্থাও আছে। তবে ফাউল হলেও এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না। নির্বাচন কমিশন রেফারী অথচ তারাই ফাউল করছে।’ নির্বাচন কমিশন ফাউল করতে থাকলে নির্বাচন কেমন হবে, তা আন্দাজ করা মোটেই কঠিন নয়।
যারা নির্বাচনে ভোট দিতে চায়, পছন্দের প্রার্থী ও দলের বিজয় দেখতে চায়, দেশের মালিকানা ফেরৎ চায় এবং প্রাথিত সরকার কায়েম করতে চায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা অনেকটাই হতাশ। তাদের একটিই প্রশ্নঃ নির্ভয়ে, বিনা বাধায় তারা ভোট দিতে পারবো তো? ভোট দিতে পারা-না পারার এই শংকা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল, সর্বাগ্রে এই পরিবেশ নিশ্চিত করা, যা সে এখনো করতে পারেনি। তাহলে নির্বাচন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক হবে? নির্বাচন কমিশনের নিরবতা, নিচেষ্টতা ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে সারাদেশে ভীতির রাজত্ব কায়েমের একটা পরিকল্পিত তৎপরতা সহজেই লক্ষ্যনীয়। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই ভীতি ও আতংক সৃষ্টি করছে না, সমাজের বিভিন্ন অংশ এবং বিশেষ করে ভোটারদের মধ্যেও আতংক ছাড়াচ্ছে। এই আতংক তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করবে সঙ্গতকারণেই। বিভিন্ন এলাকা থেকে এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের পেশীবাজ নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষ দলের কর্মীদের এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া ছাড়াও বিরোধীদলের সমর্থক ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বারন করছে। অন্যথায় ভোটের পরে তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। পুলিশও প্রায় একই কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি দেয়ার একটা মানে হতে পারে, আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন করা। ২০১৪ সালে এরকম ভোটারবিহীন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগেই ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বদ্ন্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকী আসনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যায়নি। অথচ সেই নির্বাচনে নির্বাচিতরা ৫ বছর সংসদ সদস্য থেকেছেন এবং সরকারও ৫ বছর দৌর্দন্ড প্রতাপে দেশ শাসন করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগ দেশের শীর্ষ দুই দলের একটি। এযাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কমবেশি ৪০ শতাংশ ভোটার তার সমর্থক ও ভোট দিয়ে থাকে। এই ৪০ শতাংশ ভোটারের গড়ে ২০ শতাংশের বেশী ভোট দিতেই পারেনি ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বদ্ব্নিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে। অবশিষ্ট আসনে আওয়ামী লীগের ভোটারদেরও খুব কম সংখ্যকই ভোট দিয়েছে। দলটির ভোটব্যাংকের বাইরে থাকা ৬০ শতাংশ ভোটার তো ভোটাধিকার প্রয়োগই করতে পারেনি। মোট কথা, ওই নির্বাচন ভোটের নির্বাচনই ছিলনা। তাতে অবশ্য ক্ষমতায় থাকায় কোনো অসুবিধা হয়নি। এবারও যদি ৬০ শতাংশ ভোটারের অধিকাংশ এমনকি দলীয় সমর্থক ভোটারদের একাংশও ভোট দিতে না পারে তাতেও দলটির কিছু যাবে আসবে না। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে ‘বিজয়’ নিশ্চিত হলেই যথেষ্ট।
তবে অনেকের মতে, এবারের অবস্থা হুবহু ২০১৪ সালের মতো নয়। এবার প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ সব বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এমতাবস্থায়, বিজয়ের ব্যাপারে একটা শংকা দেখা দেয়া অসম্ভব নয়। হতে পারে, সে কারণে আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটাররা যাতে সবাই ভোট দেয়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে বিরোধীদলের সমর্থক ভোটাররা যাতে ভোট দিতে না পারে তার জন্য বিভিন্নরকম কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বিরোধীদলের প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধাদান, তাদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা ও ভীতি প্রদর্শন এবং পুলিশের মামলা ও গ্রেফতার অভিযান হয়তো এই লক্ষ্য অর্জনেই করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত একাদশ সংসদ নির্বাচন সবদলের অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক হবে বলে ধারণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে দেখা দিয়েছে। বিএনপি, ২০ দল ও ঐক্যফ্রণ্টের তরফে অবশ্য ইদানিং বারবারই বলা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত, যাই কিছুই হোক, তারা নির্বাচনে থাকবে। তাদের এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের পেশীবাজ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য এবং পুলিশী নির্যাতন, ধরপাকড় ও হয়রানি আরো বাড়তে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। এ আশংকাও করা হচ্ছে, একপক্ষ শুধুই মারবে অন্যপক্ষ সেই মার নিরবে হজম করবে, এমনটি নাও হতে পারে। পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সংঘাত-সহিংসতা, হানাহানি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে। দেশের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আশংকার এই প্রেক্ষিতে লাগাতারই বলছেন, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নির্মাণ জরুরি। এই সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করাও আবশ্যক। তাদের মতে, এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে এ ব্যাপারে তাকিদ দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেসে সদ্য পাস হওয়া একটি প্রস্তাবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই প্রস্তাবে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রæতি রক্ষা করতে বাংলাদেশে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই সংঘটিত সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, সহিংসতার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং যারা গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করতে চায় তারাই লাভবান হয়। প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি অংশগ্রহণের জন্য সব দলকে স্বাধীন ও নিরাপদ বোধ করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশের স্বাধীনতা, দেশজুড়ে প্রচারণা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আয়োজনের সুযোগ দিতে হবে।
আজকের বিশ্বে কোনো কিছুই কারো অগোচরে থাকে না। দূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ঘটছে, তা যেমন বাংলাদেশের মানুষের অজানা থাকছে না, তেমনি বাংলাদেশে কি ঘটছে, তাও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের অজানা থাকছে না। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের প্রস্তাব তারই প্রমাণ বহন করে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তার আভাস দিয়েছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার। তিনি ক’দিন আগে বলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে এবং ভোটাররা নির্বিঘে্ন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার এক প্রতিবেদনে বলেছে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি প্রচারকালীন সহিংসতা বন্ধ এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগের আহবান জানানো হয়েছে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মার্কিন কংগ্রেসের প্রস্তাব, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য এবং নিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বর্ণিত বক্তব্য থেকে সহজেই অনুধারণ করা যায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থে এবং দেশের বৃহত্তর কল্যাণে অবাধ, সুষ্ঠু ও সকল পক্ষের কাছে গ্রহণীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আমরা আবারও একথাই বলতে চাই, নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সদিচ্ছার ওপর এরকম একটি নির্বাচন নির্ভর করছে। নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। একই সঙ্গে দরকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। অত:পর ভোটপর্বের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ও সরকার কি করে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হামলা


আরও
আরও পড়ুন