Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় আমনের বাম্পার ফলন হলেও এবারো ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না কৃষক। ধানের উৎপাদন খরচ এবং বিক্রয় মূল্যে সমন্বয়হীনতার কারণে লোকসান দিতে দিতে নিস্ব হতে চলেছে দেশের কৃষক সমাজ। ধানের বাম্পার ফলনের ধারাবাহিক সাফল্য একদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় বড় অবদান রাখছে অন্যদিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জনকে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে দাবী করছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হলেও কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। গতকাল একাধিক সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে কৃষকরা আমন ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে। ফলনও অনেক ভাল। তবে এই ফলন নিশ্চিত করতে কৃষকদের যে পরিমান আর্থিক বিনিয়োগ ও শ্রম দিতে হয়েছে, বিনিয়োগের ন্যায্য মুনাফা দূরের কথা, বর্তমান বাজারমূল্যে উৎপাদন খরচও উঠছে না।এমনকি গতবারের বাজার মূল্যের চেয়েও মনপ্রতি দুই থেকে তিনশ টাকা কমে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। যেখানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী হওয়া অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হবে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন কৃষকের উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে বিনিয়োগের মুনাফা নিশ্চিত করা। কৃষকের উৎপাদন খরচ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই চালের মত নিত্যপণ্যের বাজার মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করার সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
যৌথ নদীগুলোর উপর উজানে ভারতের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের কৃষকরা সেচ সংকটের সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পসহ বড় বড় সেচ প্রকল্পগুলো এখন কার্যত অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এসব বাস্তব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই দেশের কৃষকরা স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে এক প্রকার বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। বহু আগেই এ দেশের কবি লিখেছিলেন, ‘সব সাধকের বড় সাধক/ আমার দেশের চাষা’। নিরলস কায়িক শ্রম এবং সেচ, বীজ, সার ও কীটনাশসহ উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে অকুণ্ঠ বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে এ দেশের কৃষকরা দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করলেও ধান-আলুসহ ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেরাই ঋণগ্রস্ত, নিরন্ন ও প্রায় বাস্তুহীন জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির মূল ভিত্তি বহুলাংশে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন ছাড়া উন্নয়নের জাতীয় লক্ষমাত্রা কখনোই কাঙ্খিত সাফল্য রেখা স্পর্শ করতে পারবে না। কোটি কোটি কৃষক পরিবারকে লোকসান ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়ে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অসম্ভব। যারা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান নিশ্চিতের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গৌরবজনক সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে, তাদের প্রতি সরকারের অনীহা- অবহেলা অমার্জনীয়।
চলতি মওসুমে প্রতিকেজি আমন চালের উৎপাদন খরচ ৩৪ টাকা হিসেবে কেজি প্রতি আমন চালের ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে কৃষকরা ধান উৎপাদন করলেও চাল উৎপাদন করে মিলাররা। অতএব সরকারের চাল ক্রয়ের সুফল ভোগ করে মূলত: মিলাররা। সেই সাথে সারাবছর যথেচ্ছভাবে চালের মূল্য বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফার সুযোগও মিলার ও মজুদদারদের হাতে। যেখানে চলতি আমন মওসুমে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে দেড় কোটি মেট্টিক টনের কাছাকাছি, সেখানে সরকার স্থানীয় বাজার থেকে মাত্র ৬ লাখ টন আমন চাল সংগ্রহ করবে বলে জানা যায়। ইতিমধ্যে আমনের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক কৃষকের গোলায় উঠলেও এখনো সরকারী ক্রয় শুরু হয়নি। ১ ডিসেম্বর থেকে চাল ক্রয় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ধান-চাল ক্রয়ে ধীরগতি, অস্বচ্ছতা এবং অনিয়মের মধ্য দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহে সরকারী লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণই থেকে যায়। দেশে বাম্পার ফলনের পরও ভরা মওসুমে ভারত থেকে চাল আমদানীর সুযোগ দিয়ে দেশের কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার নজিরও আছে। যেখানে দেশে প্রতি বছর সাড়ে তিন কোটি মেট্টিক টনের বেশী ধান উৎপাদিত হয় সেখানে কৃষক ও আভ্যন্তরীন বাজার থেকে মাত্র ১০-১৫ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা খুবই অপ্রতুল। ধান-চাল কেনার ক্ষেত্রেও নানাবিধ অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক দলবাজির অভিযোগ উঠতে দেখা যায়। বছরে চালের চাহিদার পুরোটা দেশের কৃষকরা উৎপাদন করলেও কোটি কোটি টন চালের বাজারমূল্যের নিয়ন্ত্রণ থাকে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী সিন্ডিকেটের হাতে। কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে কৃষক এবং সাধারণ ভোক্তারা অসহায়। কৃষিখাতের ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং ধান-চালসহ খাদ্যপণ্যের মজুদ, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পিত বিপণন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকের নিরাপত্তা একই সুত্রে গাঁথা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ন্যায্যমূল্য


আরও
আরও পড়ুন