শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সিকানদার আবু জাফর (১৯ মার্চ ১৯১৯-৫ আগস্ট ১৯৭৫) বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাই বিচরণ করেছেন। তবে কবি ও নাট্যকার হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। তাঁর অধিকাংশ রচনা দেশপ্রেম ও বাঙালি চেতনায় উজ্জীবিত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও বিপ্লবী চেতনা সম্পন্ন অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন - যা এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর দেশপ্রেমমূলক রচনাগুলোর মধ্যে ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ একটি উল্লেখযোগ্য নাটক।
‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকে দেখা যায় জাতীয় চেতনা নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে সামরিকজান্তা আইয়ুব খানের দুঃশাসনে পূর্ববাংলার মানুষ যখন দিশেহারা তখন সিকানদার আবু জাফর ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটক রচনা করে বাঙালিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি চেয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলার শক্তি, সাহস ও দেশপ্রেমকে পূর্ববাংলার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে যাতে তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ ইতিহাসের কাহিনী ভিত্তিক একটি করুণ-রসাত্মক নাটক। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও পতনকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত হয়েছে। ইতিহাসের ধূসর আবর্ত থেকে মূলকাহিনী গৃহিত হলেও সিকানদার আবু জাফর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ নাটকে বর্তমানকালের জীবন জিজ্ঞাসাকে ইতিহাসের কাঠামোর মধ্যে প্রতিস্থাপন করেছেন। তাঁর হাতে পলাশীর কাহিনী পুনর্জীবন লাভ করেছে। এক অপরিসীম যন্ত্রণা-দগ্ধ পরিণতির মধ্য দিয়ে নাটকটি সমাপ্ত হয়েছে। চার অঙ্কে বারোটি দৃশ্যে নাটকটি রচিত। এর মধ্যে আটটি দৃশ্যেই সিরাজের উপস্থিতি রয়েছে। মূলত নাটকটি সিরাজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। এর কাহিনী শুরু হয়েছে যুদ্ধ দিয়ে। সিরাজের বাহিনী ফোর্ট উইলিয়ম দূর্গকে আক্রমণ করে ইংরেজ সৈন্যদের ঘায়েল করেছে। কিন্তু সিরাজের মনে স্বস্তি নেই; তাঁকে সিংহাসন চ্যুৎ করার জন্য চলছে নানা রকম প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের জাল ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। এতে যুক্ত হয়েছে আপন খালা ঘসেটি বেগম, সেনাপতি মির জাফর আলি খান, রায় দূর্লভ, জগৎ শেঠ প্রমুখ অমাত্যবর্গ।
নাট্যকার সিকানদার আবু জাফর ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকের নাট্টিক দ্বন্দ্বে দেখা যায়-সিরাজের দোলাচল চিত্তের এক জটিল পরিস্থিতি। একদিকে বাংলার স্বাধীনতা বজায় রাখা, অপর দিকে হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত নিকট আত্মীয়-স্বজনের ষড়যন্ত্র- এ উভয় চিন্তা মাথায় রেখে সিরাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নাট্যকার এমন জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নাটকটিকে নাট্টিক দ্বন্দের মধ্য দিয়ে ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে গেছেন। নাট্যকার বোঝাতে চেয়েছেন- সিরাজ সবকিছু বুঝতে পারছেন কিন্তু কঠোরতম কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না, মানবীয় গুণাবলী তাঁকে বাঁধা দিচ্ছে। এমনি এক আশংকাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নাটকটি এগিয়ে গিয়েছে। সংকল্প করেও সিরাজের শেষ রক্ষা হয় নি। অবশেষে ষড়যন্ত্রীরা জয়ী হয়েছে। সিরাজের মৃত্যু তথা এক বেদনাবহ পরিবেশের মধ্য দিয়ে নাটকটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকে সব মিলে ৪২টির মতো চরিত্র রয়েছে। দু-একটি বাদে অধিকাংশ চরিত্রই ঐতিহাসিক। অনেক ক্ষেত্রে নাটকের চরিত্রের সাথে ঐতিহাসিক চরিত্রের হুবহু মিল নেই। নাটকের সংলাপও বেশ স্বাধীন-স্বকীয় ভাবে তৈরী করেছেন নাট্যকার। ইতিহাসের সত্য ও সাহিত্যের সত্য সব সময় এক পথে নাও চলতে পারে। কারণ লেখক বা নাট্যকারগণ লেখার বশ থাকেন, তারা ইতিহাসের অনুগত নন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতটি স্মতর্ব্য, তিনি ইতিহাসের ‘বহুতর ঘটনা পুঞ্জ’ এবং বিভিন্ন অনুষঙ্গকে সাহিত্যে পরিহার করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি মনে করেন যে, এতে সাহিত্যের ‘র্কর্তৃত্ব’ হারিয়ে ফেলে এবং ফলত সাহিত্যের যে শিল্পরস আহরণ তা ব্যাহত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথের কথার মানে এই নয় যে, ইতিহাসের প্রতি সাহিত্যিকদের আনুগত্য প্রদর্শন একবারেই অপ্রয়োজনীয়। মূলত ইতিহাসের সত্যের প্রতি আস্থা রেখেই সাহিত্যিকদের ইতিহাস অনুসরণে সাহিত্য রচনা করতে হবে। তবে ইতিহাসকে হুবহু অনুসরণ লেখক নাও করতে পারেন। ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকে দেখা যায়, বাস্তবে সিরাজউদ্দৌলা বাংলায় কথা না বললেও এখানে তিনি সুন্দর বাংলায় কথা বলেন। রবার্ট ক্লাইভও ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে নাটকের মতো এভাবে কথা বলতেন কি না সন্দেহ। নাট্যকার যদি সিরাজের মুখে বাংলায় সংলাপ না দিতেন তবে নাটকটির সংলাপ এমন প্রাণবন্ত হতো না এবং দর্শক প্রিয়তাও পেত না। আর এ জন্যে নাটকে কোনো রূপ ঐতিহাসিকতাও ক্ষুণ্ন হয় নি। সিরাজ চরিত্র নিয়ে ইতহাসের সাথে ভালো-মন্দ বিচিত্র জনশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে। এ সব জনশ্রুতির প্রভাব কাটিয়ে নাট্যকার প্রকৃত সত্যকে যথাযথ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। নাটকের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, ‘‘সিরাজউদ্দৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদ্দৌলার জীবননাট্য পুনঃনির্মাণ করেছি। ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদ্দৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস ও তাঁর চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদগুণ- এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ এবং মানবীয় গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।’’ তাই দেখা যায়, ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকে সিরাজ একাধারে দেশপ্রেমিক, জাতীয় বীর, সাহসী যোদ্ধা, প্রেমময় স্বামী, স্নেহশীল পিতা, একনিষ্ট ধার্মিক প্রভৃতি সদগুণের অধিকারী।
সিরাজদ্দৌলার ট্র্যাজিক ইতিহাস নিয়ে প্রথম নাটক রচনা করেন প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষ। নাটকটি প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। তিনি যখন নাটকটি রচনা হাত দিয়ে ছিলে তখন এ দেশে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলছিল। তিনিও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই নাটকটি রচনা করেছিনে। এ নাটকেও গিরিশ চন্দ্র সিরাজকে কলঙ্ক মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘বিদেশি ইতিহাসে সিরাজ চরিত্র বিকৃত বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। সুপ্রসিদ্ধি ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়, শ্রীযুক্ত কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি শিক্ষিত সুধিগণ অসাধারণ অধ্যাবসায় সহকারে বিদেশি ইতিহাস খণ্ড করিয়া রাজনৈতিক ও প্রজাবৎসল সিরাজের স্বরূপ চিত্র প্রদর্শনে যত্নশীল হন।’’
আধুনিক নাটকের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকের গঠনশৈলী তেমন নিরীক্ষাধর্মী নয়। দৃশ্যগুলো কীভাবে মঞ্চায়িত হবে নাট্যকার তা স্পষ্ট ভাবে দিক-নিদের্শনা দেন নি। উদাহরণ স্বরূপ মুনীর চৌধুরীর ‘‘কবর’’ নাটকটির কথা বলা যায়। এ নাটকটিতে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী দৃশ্যগুলো মঞ্চায়িত করার জন্য সুস্পষ্ট দিক-নিদের্শনা দিয়েছেন। ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকে ঐতিহাসিক সত্যতাকে রক্ষা করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিরাজের চরিত্র বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। তাঁর চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে যে ধরণের উপস্থাপন ও সংলাপের প্রয়োজন ছিল তা সবক্ষেত্রে রক্ষিত হয় নি। তবে সিরাজের কিছু কিছু সংলাপ নাটকটিকে প্রাণবন্ত ও গতিশীল করেছে। তাঁর এমনি একটি সংলাপ : ‘‘বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজরা পেল কোথা থেকে আমি তার কৈফিয়ত চাই।’’ এ সংলাপের মধ্য দিয়ে সিরাজের শৌর্য-বীর্য আর দেশপ্রেমবোধেরই প্রকাশ পেয়েছে- যা ঐতিহাসিক নাটকের জন্য অপরিহার্য।
অন্যান্য চরিত্রগুলো সিরাজের তুলনায় অনেকটাই নিস্প্রুভ এবং একমুখী দোষে দুষ্ট। যেমন, খলচরিত্র মিরজাফর, ঘসেটি বেগম, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখ চরিত্রগুলো শুধুই শঠ মানসিকতার অধিকারী; তেমনি মিরমর্দান, মোহনলাল, রাইসুল জুহালা- কেবলই নীতিবান, ভালো মানুষ। নায়িকা লুৎফুন্নেসাও তেমন উজ্জ্বলতর ভাবে বিকশিত হতে পারে নি। এই একমুখিতা কেন্দ্রীয় চরিত্র সিরাজের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়; সিরাজ যেন একেবারেই ত্রুটিহীন একজন মানুষ যাকে পুরোপুরি ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে মেলানো যায় না। তবে ক্লাইভকে বোরকা পরিয়ে কিংবা উর্মিচাঁদ,জগৎ শেঠ, মিরজাফরে সংলাপের মধ্যে বালখিল্যতা এনে দর্শককের মনে হাস্যরস যোগানোর সাথে সাথে নাট্যকার তাদের ভীরুতাকেও তুলে ধরেছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ছোট-খাটো দোষ-ত্রুটি বাদে সিকানদার আবু জাফরের ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকটি অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার। তৎকালীন সময়ে বাঙালির মনে দেশপ্রেমবোধ জাগ্রত করতে নাটকটি অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে। পাঠকপ্রিয়তা কিংবা মঞ্চ সফলতার দিক দিয়েও এটি পাঠক-দর্শক হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়- বাংলা সাহিত্যে সিকানদার আবু জাফরের ‘‘সিরাজউদ্দৌলা’’ নাটকটির অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।