শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
অসাধারণ উদ্যমী আর সৃষ্টিশীল নান্দনিক জীবনের অধিকারী এবং ২০০১ সালে সাহিত্যে ‘‘নোবেল পুরস্কার’’ প্রাপ্ত ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক ভি এস নাইপল সাধারণত একেবারে সোজাসাপ্টা কথা অর্থাৎ বক্তব্য আর কখনও কখনও বিতর্কিত মন্তব্যের কারনেই মূলত তিনি বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে বিদগ্ধ লেখক ও পাঠকদের কাছে অধিক পরিচিত লাভ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়ানো অতিব ভ্রমণপিপাসু এই মননশীল প্রতিভাবান সাহিত্যিক তার লেখায় বিশ্বের অনেক জায়গাকে যেমন স্থান অর্থাৎ ঠাঁই দিয়েছেন আবার সেসব জায়গার ইতিহাস-ঐতিহ্য কৃষ্টি-কালচার বিষয়াদি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন; তেমনি তার বৈচিত্রময় পান্ডিত্যপূর্ণ লেখার মধ্যে বিগত দিনের উপনিবেশ ও তার বাস্তবতা আর পরবর্তী সময়ে ভীষণভাবে দ্বদ্ব-সংঘাত, কলহ-বিবাদ আন্তরিক এবং সচেতনভানে প্রতিফলত হয়েছে। একজন স্রাষ্টার চোখ নিয়েই তিনি দেখেছেন এবং লিখেছেন। জানি যে, লেখক মানেই স্রষ্টা আর দ্রষ্টা। একজন লেখক কলমের কালিতে যেমন শব্দে শব্দে গেঁথে শিল্পরুপ সৃষ্টি করে তেমনি দার্শনিক চোখ নিয়ে জীবন সমাজ প্রকৃতি আর বাস্তবাকে দেখেন। সাধারণ মানুষের সাথে আর লেখকের মধ্যে পার্থক্যটা এখানেই।
আসলে ভি এস নাইপল সমকালীন সময়ে ইংরেজি সাহিত্যে একজন কতো বড়ো মাপের লেখক বোদ্ধা চিন্তাশীল সাহিত্যিক তা প্রমাণ মেলে তার রচনা ‘ইন আ ফ্রি স্টেট’ বই এর জন্য ১৯৭১ সালে ‘‘ম্যান বুকার প্রাইজ পদক’’ অর্জন করার মধ্যে। এখানে তিনি তার বিশ্বাস বোধ চিন্তা-ভাবনাকে অধিক সৃষ্টিশীল কারুকার্যে শব্দের মেলাতে ভাবের রঙে ভাষার যাদুতে এক অনবদ্য শিল্পসত্বাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া তার রচনা ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস (১৯৬১)’ এই বইটির জন্যও তিনি বিশ্বে পাঠককূলে সাহিত্যাকাশে বেশি পরিচিত নন্দিত হয়েছেন। এই বইটির মধ্যে লেখক অত্যান্ত দক্ষ শিল্পীর মতো করে ভারতীয় অভিবাসীদের ক্যারিবীয় অঞ্চলে সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গল্প সাবলিলভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি, এই অঞ্চলে সমাজে এই অভিবাসীদের নিজেদের ভিত অর্থাৎ শিকড়কে মজবুত দৃঢ় ও অটুট রাখার জন্য যে প্রচেষ্টা তারা সংগ্রামী জীবনে করেছেন তারই গল্প ফুটে উঠেছে। মোদ্দাকথা, তার লেখা সৃষ্টিশীল গ্রন্থগুলো পাঠককে ভাবিয়ে তোলে এবং এক নব-চেতনায় স্রোত নদীতে দীর্ঘ সুন্দর পথের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর এখানেই এই বোদ্ধা সাহিত্যিক সফলতার মুকুট নিয়ে খ্যতিমান হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
‘‘ডেভিড কোহেন পদক’’ ১৯৯৩ প্রাপ্ত ভি এস নাইপল ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষ করে জীবনের প্রথম দিকে অত্যন্ত অর্থকষ্টের মধ্যে যাপিতজীবন অতিবাহিত করতেন। শুধু তাই নয়, তার এই সাহিত্যজীবনে একাকিত্বও অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ছিল। এতো কিছুর পরেও একথা বলতেই হয় যে, বর্তমান বিশ্বে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে হাতে গোনা যে ক’জন শক্তিমান সাহিত্যিক দিকপাল হয়ে বিরাট সৃজনশীলতার জায়গা তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে সাহিত্যিক ভি এস নাইপল একজন এবং অন্যতম ব্যক্তিত্ব পুরোধা। ভি এস নাইপল তার নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন- ‘আমার জীবন খুব ছোটো, গুজবে কান দেয়ার সময় নেই।’ আসলে তিনি কখনও গুজবে এতোটুকু কান দেননি বলেই আজ বিশ্বসাহিত্যে নিজেকে শক্ত অবস্থান করে নিতে পেরেছেন। ভি এস নাইপল তার বর্ণাঢ্য সাহিত্যজীবনে চলার পথে সমাজ জীবনে মানব জীবনে যাহা দেখেছেন জেনেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন তাহা তিনি তার সাহিত্যকর্মে নির্মলতার পরশে প্রকাশ করে দেখিয়েছেন। আমরা তাই তার সাহিত্যপাঠে সেসবের জলন্ত ছাপ দেখতে পাই। বিশেষ করে, লেখকের উপন্যাস সমূহে মানবজীবনের যতো গ্লানি, হতাশা, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা এবং চরম দুর্দশাকে বর্ণনার মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ নমুনা সৃষ্টি করেছেন।
ভি এস নাইপল বাংলাদেশে গত ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘ঢাকা লিট ফেস্টের’ অনুষ্ঠানে একজন সম্মানিত লেখক হিসেবে এসেছিলেন। এই মহতী অনুষ্ঠান উদ্বোধনে তিনি তার চরম ও পরম আত্মবিশ্বাস থেকে বলেছিলেন- ‘আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি লিখবো তার কিছুই জানতাম না। কিন্তু লিখবো এটা জানতাম।’ আসলে একজন লেখক নিজের প্রতি কতোটা বিশ্বাস না থাকলে এমন কথা বলতে পারে না। মূলত, তিনি এমন কথা বলতে পেরেছিলেন বলেই আজ তার সৃষ্টিশীল রচনা অনবদ্য লেখাগুলো বিশ্ববাসিকে উপহার দিতে পেরেছেন। একজন উপন্যাসিক হিসেবে তিনি যেসব উপন্যাস লিখেছেন তা সত্যিই অনন্য। আর এসব উপন্যাসগুলোতে তিনি তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে কলমের ছোঁয়ায় অসংখ্য চরিত্র জন্ম দিয়েছে। যা পাঠককে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়।
বিগত ১৯৯০ সালে ‘‘নাইট উপাধি’’ বিজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নাইপল ছিলেন মূলত একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ। ভ্রমণকে তিনি তার জীবনের সাধনার একটা মূল্যবান দিক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন আর ভিন্নভিন্ন অভিজ্ঞতা জ্ঞান অর্জন করেছেন। এবং সেগুলোকে তিনি তার লেখার মধ্যে রচনাতে অকপটে তুলে ধরেছেন। মূলত তার ভ্রমণ বিষয়ক বইগুলোতে ভয়, জাগানিয়া ও সত্য ইত্যাদি বর্ণনার উদাহরণ পাওয়া যায়। ফলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তব চিত্রকে তাদের কৃষ্টি কালচার ধর্ম বিশ্বাস ইতিহাসকে তিনি নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় শব্দের ভিড়ে উপস্থাপন করেছেন। আমরা তার এই জাতীয় বইগুলো পাঠ করলে দেখতে পাই যে, তিনি এখানে তার প্রথম দিককার সাহিত্যকর্মে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সামাজিক চিত্রকে তুলে ধরে বড়ো মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কালের বিচারে তিনি অবশ্যই এক অনন্য মহানায়ক। একজন সত্যিকারের সাহিত্যিকের মতোই তিনি তার রচনাশৈলিকে সমৃদ্ধ ও গতিময়তার রূপে রুপান্তর ঘটিয়েছেন। পাঠকের চিন্তাকে ভাবনাকে বোধকে বিশ্বাসকে যেমন নাড়া দিয়েছেন এবং অন্য এক ভাবের চেতনার রসের আস্বাদন করিয়েছেন, তেমনি আবার হৃদয়কে একান্তে জয় করেছেন। ভি এস নাইপলের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দ্য মিষ্টিক ম্যাসুর-১৯৫৭’ ‘মিগ্যেল স্ট্রিট-১৯৫৯’ দ্য মিমিক মেন-১৯৬৭’ দ্য সাফ্রেজ অব এলভিরা-১৯৫৮’ ‘আ হাউজ ফর মিষ্টার বিশ্বাস-১৯৬১’ ‘মিষ্টার স্টোন অ্যান্ড দ্য নাইটস কম্প্যানিয়ন-১৯৬৩’ ‘আ ফ্ল্যাগ অন দি আইল্যান্ড-১৯৬৭’ ‘গেরিলাস-১৯৭৫’ ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার-১৯৭৯’ ‘দি এনিগমা অব অ্যারাইভাল-১৯৮৭’ ‘আ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-১৯৯৪’ ‘ম্যাজিক সিডস-২০০৪’ ‘হাফ আ লাইফ-২০০১’ ‘দ্য নাইট ওয়াচ ম্যানস অকারেন্স বুক অ্যান্ড আদার কমিক ইনভেনশন-২০০২’ ইত্যাদি বইগুলো উল্লেখযোগ্য এবং পাঠক নন্দিত।
ভি এস নাইপলের পিতামহ ভারত থেকে ক্যারিবীয় দ্বীপ ত্রিনিদাদ ও টোবাগতে পাড়ি দেন। আর এখানেই (ত্রিনিদাদে) তিনি ১৯৩২ সালে ১৭ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদাতা পিতা ভারতীয় নাগরিক এবং একজন লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। ভি এস নাইপল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া করেন এবং লন্ডনেই স্থায়ী বসবাস করেন।
৩০টিরও বেশি বই রচয়িতা বিশ্বখ্যাতিমান নন্দিত সৃষ্টিশীল এই প্রতিভাবান লেখক ৮৫ বছর বয়সে তার ভক্ত-পাঠককুলকে কাদিয়ে গত ১১ আগষ্ট ২০১৮ শনিবার লন্ডনে তার নিজ বাড়িতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ফলে আমরা বিশ্ববাসী ইংরেজ সাহিত্য এবং বিশ্ব সাহিত্যের একজন বড়ো মাপের প্রকৃত সু-সাহিত্যিককে হারালাম। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনা করছি। তিনি তার বৈচিত্রময় সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মের মধ্যে আগামী দিনে বেঁচে থাকবে এই গভীর বিশ্বাস অন্তরে সতত রাখি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।