Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভ্রাতৃবোধের সুবাতাস ছড়িয়ে শেষ হলো ফিফা বিশ্বকাপ

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের সুবাতাস ছড়িয়ে শেষ হলো ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। যেখানে শুরু হয়েছিল, মস্কোর সেই লুঝনিকি স্টেডিয়ামেই সমাপ্তিরেখা টানা হলো একুশতম ফিফা বিশ্বকাপের। রাশিয়ার ১১টি শহরে ১১টি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই আসরে অংশ নিয়েছিল বিশ্বের ৩২টি দেশ। তুমুল লড়াইয়ের পর একে একে ঝরে যায় ৩০টি দেশ। টিকে থাকে শক্তিধর ফ্রান্স এবং নবীন ও উদ্দীপ্ত ক্রোয়েশিয়া। লুঝনিকে অনুষ্ঠিত ফাইনালের এই মহারণে শেষ পর্যন্ত জিত হয়েছে ফ্রান্সের। দ্বিতীয় বারের মত দেশটি বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জিতে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। মাত্র ৪১ লাখ লোকের ক্ষুদ্রদেশ ক্রোয়েশিয়া বিস্ময় জাগালেও রূপকথার শেষটা তার জন্য ভালো হয়নি; হয়েছে বিয়োগান্তক। যোগ্যতম হিসাবেই ফ্রান্স বিজয়ী হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার জন্য অবশ্যই এই রাশিয়া বিশ্বকাপ স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করবে। বিশ্বফুটবলের যারা জায়েন্ট, তারা পর্যায়ক্রমে সবাই পরাভূত হয়ে বিদায় নিয়েছে। সেখানে ক্রোয়েশিয়ার অর্জনকে মোটেই ছোট করে দেখা যায় না। লড়াকু মনোভাব, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আত্মশ্লাঘবোধ ও বৈপূণ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে ক্রোয়েশিয়া বিশ্বফুটবলে বিরল সম্মানজনক অবস্থান অধিকার করে নিয়েছে। আমরা বিজয়ী ফ্রান্সের সকল খেলোয়াড়, কোচ ও কর্মকর্তাদের শিরোপা জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাই। একইভাবে অভিনন্দন জানাই ক্রোয়েশিয়ার খোলোয়াড়, কোচ ও কর্মকর্তাদের। এত বিশাল ও বর্ণাঢ্য আয়োজন এবং তা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য রাশিয়া অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ যাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল বিশ্বকাপের এই আসরটি। ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফাস্তিনো অকুণ্ঠ ভাষায় এই বিশাল ও সফল আয়োজনের প্রশংসা করেছেন। আয়োজনকে বিশেষভাবে অবিস্মরণীয় করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার। তারা বৃষ্টিতে ভিজে যেভাবে ফুটবলকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, খেলোয়াড় ও সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দনে ভাসিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। আমরা তাদের বিশেষ ধন্যবাদ জানাই।
বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই মানুষের মিলনমেলা। মানুষ যে মানুষই, এই অভেদ মানবসত্ত¡া ও মানবতার প্রকাশ ঘটে বিশ্বকাপ ফুটবলে। এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি রাশিয়া বিশ্বকাপেও। যখন বিশ্বে বর্ণবাদের ফের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, উগ্রবাদের বিস্তার ঘটেছে এবং মুসলিম-অমুসলিম দ্ব›দ্বসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা সম্প্রসারিত হচ্ছে তখন বিশ্বকাপ ফুটবলে এর কোনো কিছুরই লক্ষ্য করা যায়নি। একই দলে সাদা-কালো-মিশ্র রঙের খেলোয়াড় একসঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেমন খেলেছেন, তেমনি কর্মকর্তাদের মধ্যেও এই বর্ণবিভেদ কোনো প্রভাব ফেলেনি। ইউরোপে মুসলিম বিদ্বেষ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও ইউরোপীয় দেশগুলোর ফুটবল টিমে বহু মুসলমান খোলোয়াড় রয়েছে। সেখানে কোনো মুসলিম বিদ্বেষ বা বৈষম্য স্থান পায়নি। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ গোটা ইউরোপই মূলত সাদাদের মহাদেশ। কিন্তু সেখানে বিপুলসংখ্যক কালো ও মিশ্র রংয়ের ইমিগ্রান্টের বসবাস ও অবিস্থিতি রয়েছে। রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণেই তারা সেখানকার নাগরিক অথবা আশ্রয়লাভকারী। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইমিগ্রান্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহৃদয় হলেও সাম্প্রতিকালে নানা কারণে ওইসব দেশেও বর্ণবাদী ও ধর্মীয় উগ্রতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। যারা উগ্র বর্ণবাদ বা ধর্মীয় বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে বা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তাদের লক্ষ্য যাই থাকুক, ইউরোপের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য তা অশনিসংকেত। ইমিগ্রান্টদের বাদ দেয়া কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উৎসাদন করা ইউরোপের পক্ষে বাস্তব কারণেই সম্ভব নয়। সবাইকে নিয়েই থাকতে হবে, এটাই বিকাশের পথ। জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশে এ চেষ্টা অব্যাহত আছে। ফুটবলের মতো ক্ষেত্রেও তা লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে সাদা-কালো-মিশ্র অথবা খ্রীস্টান-মুসলমান বিভেদ করা হয়নি।
বিশ্বকাপ ফুটবল একটা দর্শন উপহার দিয়েছে। তা হলো : মানুষে-মানুষে কোনো বিভেদ নেই। সেখানে বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এক পংক্তিতে। ছোট দেশ, বড় দেশ, গরীব দেশ, ধনী দেশ, কমিউনিস্ট দেশ, গণতান্ত্রিক দেশ ইত্যাদিরও কোনো পার্থক্য নেই। এই যে অভেদ দর্শন, সমমর্যাদার দর্শন, এটা যদি বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করে, এ ব্যাপারে সম্মিলিত ইচ্ছা গঠন করতে সমর্থ হয় তবে অশান্তি বলে কিছু থাকবে না। বিরোধ-বিসংবাদ-যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকবে না। একটা মানবিক ও সহৃদয় বিশ্ব গড়ে উঠবে। বিশ্ব হবে, শান্তিময় ও নিরাপদ। বিশ্বমানবের প্রকৃত প্রত্যাশা, একান্ত কামনা তো এটাই হওয়ার কথা এটাই হওয়া উচিৎ। আমরা আশা করতে চাই, বিশ্বনেতৃবৃন্দ বিশ্বকাপ ফুটবলের এই দর্শন উপলব্ধিতে আনবেন এবং তা অনুসরণ ও বাস্তবায়নের চেষ্টায় নিবেদিত হবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্বকাপ


আরও
আরও পড়ুন