৯২ বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন অনবদ্য ফাইনাল ফুটবল বিশ্ব আগে কখনো দেখেছে কিনা কে জানে! কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে ফ্রান্স-আর্জেন্টিনার শিরোপ নির্ধারণী লড়াইটি পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চে ঠাসা! নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিট দুই দল লড়েছে সমানে সমান। একদল এগিয়ে গেলে, মুহূর্তেই দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে ম্যাচে ফেরে অন্য দল।৩-৩ এর সমতায় শেষ ম্যাচ বিজয়ী নির্ধারণে গড়ায় টাইব্রেকারে।
সেখানে ফ্রান্সকে ৪-২ ব্যবাধানে হারিয়ে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা।ফুটবলের মহতারকা মেসি শিরোপা জেতার স্বাদ নিয়ে ইতি টানতে পারলেন দেড় যুগের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার।অন্যদিকে ফাইনালে দুর্দান্ত এক হ্যাট্রিক করেও টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারলেন না কিলিয়ান এমাবাপে।
ফাইনাল শুরুর আগে অনেক ফুটবল সাম্প্রতিক ফর্ম,এমবাপে জিরুডদের গতি আর দক্ষতা বিবেচনায় ফ্রান্সকে ফেভারিট হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।তাদের মত ছিল, শিরোপা খরা ঘুচাতে হলে আর্জেন্টিনাকে খেলতে হবে অসাধারণ ফুটবল।
কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে ফাইনালের পুরোটা সময়জুড়ে সেই অসাধারণ ফুটবলের মুগ্ধতা ছড়িয়েই তৃতীয় বারের মত বিশ্বকাপ ঘরে তুলল মেসি-ডি মারিয়ারা। বিশেষ করে প্রথমার্ধে স্কেলোনির শিষ্যরা মাঠে ছিল অপ্রতিরোধ্য।রেফারির খেলা শুরুর বাশি বাজানোর পর থেকেই বল পজিশন,মাঝমাঠ,আক্রমণ সবখানেই ছিল আর্জেন্টিনার আধিপত্য।একের পর এক দারুণ সব আক্রমণে মেসি-ডি মারিয়ারা ব্যাতিব্যাস্ত রাখছিলেন ফ্রান্স রক্ষনভাগকে।
আর্জেন্টিনার লাগাতার আক্রমণের চাপে দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেল গতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।ইনজুরি কাটিয়ে ফাইনালের একাদশে জায়গা পাওয়া ডি মারিয়া এদিন শুরু থেকে মাঠে আলো ছড়িয়েছেন। ২১ তম মিনিটে বা প্রান্ত দিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ফ্রান্স ডি বক্সে ঢুকে পড়া এই মিডফিল্ডারকে আটকাতে গিয়ে ফরাসি ডিফেন্ডার উসমান দেম্বেলে ফাউল করে বসলে পেনাল্টির বাশি বাজান রেফারি। যদিও সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। নিজের স্বভাব যার টঙ্গীতে স্পট কিক থেকে লক্ষ্যভেদ করে দলকে লিড এনে দেন মেসি।
৩৬ তম মিনিটে পেনাল্টি এনে দেওয়া ডি মারিয়া নিজেই নাম লেখালেন স্কোরশিটে। মাঝমাঠ থেকে ডিফেন্স ছেড়া এক পাসে বক্সের সামনে থাকা আলভারেজকে খুজে নেন মেসি।আলভারেজ বল বাড়িয়ে দেন ম্যাক এলিস্টারের দিকে।তার পাস বক্সে বাঁ দিকে ফাঁকায় পেয়ে কোনাকুনি শট নেন ডি মারিয়া।চেষ্ঠা করেও সেই শট ঠেকাতে পারেননি হুগো লরিস।স্কোরলাইন আর্জেন্টিনা ২-০ ফ্রান্স!
প্রথমার্ধে ফ্রান্স মুলত রক্ষণ সামলাতেই ব্যাস্ত ছিল। বিরতির আগ পর্যন্ত গোলের উদ্দেশ্যে কোনো শটই নিতে পারেনি। যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে আর্জেন্টিনা শট নেয় ৬টি, যার ৩টি থাকে লক্ষ্যে।
তবে বিরতির পর খেলার গতি বাড়ায় দিদিয়ে দেশামের দল।তবে গ্রিজম্যান-মুয়ানিরা সুবিধা করতে পারছিলেন না। ৮০ তম মিনিট পর্যন্ত ২-০ গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।এমবাপের টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জয়ের স্বপ্ন প্রায় শেষ।তবে এই ফরাসি ফরোয়ার্ড যে এত সহজে হার মানার পাত্র নন।এরপর মাত্র এক মিনিটের মাথায় দুই দুই বার আর্জেন্টিনার জালে বল পাঠিয়ে চোখের পলকে এই ফরাসি সেনসেশন স্কোরলাইন করে ফেললেন ২-২!
৮০ তম মিনিট স্পটকিক থেকে লক্ষ্যভেদ ব্যবধান কমানোর পরের মিনিটে দারুণ এক ভলিতে দলকে ফেরান সমতায়।এমবাপে বীরত্বে ম্যাচে ফেরা ফ্রান্স এরপর ছিল দুর্দান্ত।বাকি সময়টাতে আর্জেন্টিনার উপর ছড়ি ঘুরিয়ে অন্তত দুই তিনবার জয়সূচক গোল পেতে পেতেও পায়নি বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।শেষ মুহুর্তে মেসির জোরালো এক শট ফরাসি গোলরক্ষক হোগো লরিস ঠেকিয়ে দিলে সমতায় শেষ হয় নির্ধারিত সময়ের খেলা।
অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের খেলা শেষেও দুদল সমতা নিয়েই মাঠ ছাড়ে।পরের অর্ধে ফের মুগ্ধতা ছড়ান মেসি। তার ১০৮ মিনিটের করা গোলে ম্যাচে আবার এগিয়ে আর্জেন্টিনা।তবে তখনও আরও রোমাঞ্চে বাকি! কিন্তু ১১৬ মিনিটে বল প্রতিপক্ষের বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে মন্টিয়েলের হাত স্পর্শ করে বল। তাতে পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। স্পটকিকে আর্জেন্টিনার জালে বল জড়িয়ে করেন ১৯৬৬ সালের ফাইনালে ইংল্যান্ডের হয়ে জিওফ হার্স্টের পর হ্যাটট্রিকে ভাগ বসান এমবাপ্পে।সঙ্গে ৮ গোল করে তিনি বনে যান আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
এরপর টাইব্রেকারে মার্টিনেজ বীরত্ব আর মেসিদের ঠান্ডা মাথার স্পটকিকে ইতিহাস লেখে আলবিসেলেস্তেরা।তৃতীয়বারের মতো ঘরে তুলে বিশ্বকাপ শিরোপা।