Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিজস্ব স্যাটেলাইট এবং তার সুফল

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এই আপত্তির বিষয় এখনো সমাধান হয়নি। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়। বাংলাদেশ বারবার আইটিইউর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে থাকলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব কক্ষপথ আনতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২৬টি কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪টি সি-ব্যান্ডের। এটি তৈরিতে খরচ ধরা হয় ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এই ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
স্পেসএক্স হলো মার্কিন মহাকাশযান ও রকেট প্রস্তুতকারক এবং উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০০২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন ইলোন মাস্ক। প্রতিষ্ঠানটির মহাকাশযান সিরিজের নাম ড্রাগন এবং রকেট সিরিজের নাম ফ্যালকন। ফ্যালকন সিরিজের সর্বশেষ প্রযুক্তির ভার্সন-৫ রকেটে করে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। ফ্যালকন-৯ রকেটের প্রথম সংস্করণ মহাকাশযাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে। মহাকাশে বাণিজ্যিক কার্গো সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার পরিকল্পনা অনুসারে এই রকেট তৈরি করে স্পেসএক্স। কার্গো পরিবহনসেবার পরিকল্পনা অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় যদিও পরে তা বাতিল করা হয়। গত আট বছরে বিভিন্ন সংস্করণের ফ্যালকন-৯ রকেট মোট ৫৮ বার মহাকাশে গেছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে একটি ফ্যালকন-৯ রকেট উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়। আর ২০১৬ সালে একটি ফ্যালকন-৯ রকেট বিধ্বস্ত হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়াটি দুভাবে সম্পন্ন হবে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো উৎক্ষেপণ ও নির্দিষ্ট কক্ষপথে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায় পেরোনো। এই প্রক্রিয়ার জন্য সময় লাগবে ১০ দিন । দ্বিতীয় ধাপে কক্ষপথের নির্দিষ্ট স্থানে জায়গা করে নেবে স্যাটেলাইটটি। এ জন্য সময় লাগবে ২০ দিন। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে স্থাপিত হতে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কমপক্ষে এক মাস সময় লাগবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বহনকারী ফ্যালকন-৯ রকেটের চারটি অংশ রয়েছে। অংশে থাকবে স্যাটেলাইট এবং এরপর অ্যাডাপ্টর। অ্যাডাপ্টরের নিচের অংশটিকে বলা হয় স্টেজ-২ এবং রকেটের শেষের অংশকে বলা হয় স্টেজ-১। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-১ খসে পড়বে এবং এটি পৃথিবীর দিকে ফিরে আসবে। এরপর রকেটের স্টেজ-২ স্যাটেলাইটটিকে কক্ষপথের দিকে নিয়ে যাবে।
স্যাটেলাইটটি কার্যকর হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ যাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং কোরিয়ায় অবস্থিত তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে। এই তিনটি স্টেশনের মাধ্যমে স্যাটেলাইটটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস এটি পর্যবেক্ষণ করবে। থ্যালেস প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে স্যাটেলাইটটি পর্যবেক্ষণের কাজ করবে। এই সময়ে সক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে এর দেখাশোনার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরই ছেড়ে দেবে ফরাসি কোম্পানিটি। জাতিসংঘের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর আউটার স্পেস অ্যাফেয়ার্সের (ইউএনওওএসএ) হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত মহাকাশে স্যাটেলাইটের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩৫। প্রতিবছরই স্যাটেলাইটের এ সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এসব স্যাটেলাইটের কাজের ধরনও একেক রকমের। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি বিভিন্ন ধরনের মহাকাশ যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের স্যাটেলাইটকে বলা হয় ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট’। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সঙ্গে এ স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরতে থাকে।
ফ্যালকন-৯ রকেটের নতুন সংস্করণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। এ রকেটটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে। এমনকি একই দিনে একাধিকবার তা মহাকাশে পাঠানো যাবে। এর আরও উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করে মহাকাশে যাবে মানুষ।একই রকেট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুনর্ব্যবহার বেশ কঠিন। আগামী বছর এ বাধা দূর হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সংস্করণটি ১০ বারের বেশি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা যেতে পারে। এমনকি তা ১০০ বার পর্যন্ত পাঠানো হতে পারে। ফ্যালকন-৯ রকেটের নতুন সংস্করণের প্রথম সফল উৎক্ষেপণ এটি। এটিকে ফ্যালকন-৯ বøক ৫ রকেট বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে এটি উৎক্ষেপণ করা হয়।
রকেটটির নতুন বুস্টার সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং তা নেমে আসে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন শিপে। এ বুস্টার এখন কয়েক মাস ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে স্পেসএক্স। এরপর তা আবার ওড়ানোর কাজে লাগানো হবে। মাস্কের লক্ষ্য হচ্ছে রকেট দুবার ওড়ানোর আগে যাতে রক্ষণাবেক্ষণ সময় কম লাগে, তা ঠিকঠাক করা। অর্থাৎ উড়োজাহাজের মতোই রকেট একাধিকবার ব্যবহার করা হলে খরচ কম হবে। এর আগে শেষ মুহূর্তে রকেট উৎক্ষেপণ বন্ধ হলে মাস্ক বলেছিলেন, ‘এটা সত্যিকার অর্থে কঠিন কাজ। আমাদের প্রায় ১৬ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, ছোটখাটো অনেক উন্নতি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমাদের এখনো এটি নিয়ে পরীক্ষা চালাতে হবে। যাতে মনে হয়, আমরা এখনো এটি করতে পারিনি। কিন্তু এটা করা সম্ভব।স্পেসএক্সের তৈরি ফ্যালকন-৯ রকেটটিকে দারুণ উপযোগী রকেট বলা হচ্ছে। মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পাশাপাশি এর উন্নত ও নতুন মডেল ব্যবহার করে ভবিষ্যতে মহাকাশে নভোচারী পাঠাবে নাসা। রকেটের নতুন মডেলটি তৈরি করতে স্পেসএক্স এর ইঞ্জিনের পারফরম্যান্স বাড়িয়েছে, রকেটের বিভিন্ন অংশ মজবুত করেছে। এ ছাড়া এর ল্যান্ডিং গিয়ারকে করেছে উন্নত। মাস্ক চান রকেটের শুধু প্রথম স্টেজ নয়, এ ধরনের রকেট ব্যবহারের পর তার পুরোটা যেন আবার কাজে লাগানো যায়। খরচের প্রায় ৬০ শতাংশ সেখানেই ব্যয় হয়।
তিন ধরনের সুফল দেশের মানুষ পেতে পারে এ স্যাটেলাইট থেকে। প্রথমত এ স্যাটেলাইটের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয় দুটিই করা যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার স¤প্রসারণ করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো সম্ভব।
তবে এসব সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেটি হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভিজাত দেশের ক্লাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে। বঙ্গবন্ধু-১ তৈরির ঘোষণা আসার পরপরই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ন্যানো স্যাটেলাইট প্রকল্পনিয়ে কাজ শুরু করে। এবার আসা যাক স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক দিকে। এখন দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সমপ্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে একটি চ্যানেলের ভাড়া বাবদ গুনতে হয় তিন থেকে ছয় হাজার মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে এই স্যাটেলাইট ভাড়া কমবে। আবার দেশের টাকা দেশেই থেকে যাবে।
শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রানসপন্ডার বা সক্ষমতা অন্য দেশের কাছে ভাড়া দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ থাকবে। এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রানসপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে বলে সরকার থেকে বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিক্রির জন্য সরকারের গঠন করা বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিসিএসবি) লিমিটেড কাজ শুরু করেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আরেকটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য হবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি কেইউ-ব্যান্ড ও ১৪টি সি-ব্যান্ড। প্রতিটি ট্রান্সপন্ডার থেকে ৪০ মেগাহার্টজ হারে তরঙ্গ বরাদ্দ (ফ্রিকোয়েন্সি) সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। এ হিসাবে ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মোট ফ্রিকোয়েন্সি ক্ষমতা হলো ১ হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ। কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারণে এই ১ হাজার পুরোটা ব্যবহার করা যাবে না। তবে কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মেগাহার্টজ ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
একদায় তলাবিহীন ঝুড়ি নামে আখ্যায়িত বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের সোপানে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। অনেক আগেই আমাদের এই সকল অর্জন আসা উচিত ছিল। কিন্তু নানা কারণে হয়েছে অনেক বিলম্ব। তবুও আমরা তৃপ্ত । এই অর্জন ধীরে হলেও আসছে। মানুষ আগামীতে ধীরে ধীরে উপকৃত হতে থাকবে। তবে মানুষ আরও বেশী উন্নয়ন পাবে যদি দেশে সুশাসন কায়েম হয়। সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি ও অনিয়ম দূরিভ‚ত হয়।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজিএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্যাটেলাইট


আরও
আরও পড়ুন