পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের এলাকাকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে শিল্পপার্কে স্থানান্তর করা হয়েছে। অথচ সেই ট্যানারি শিল্পই এখন ধলেশ্বরি নদী ও তার আশপাশের এলাকা দূষিত ও বিষাক্ত করে চলেছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আধুনিক ট্যানারি শিল্পপার্ক যে গড়ে তোলা হয়েছে, তা যেন বিফল হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। যে দূষণ রোধে ট্যানারি শিল্পের স্থানান্তর, তা যদি পুনরায় নতুন এলাকা দূষিত করে, তাহলে এই স্থানান্তরে কী লাভ হলো? গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হাজারিবাগ থেকে স্থানান্তরিত ১১১টি ট্যানারি থেকে প্রতিদিন নির্গত বিশ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত তরল ও কঠিন বর্জ্য ধলেশ্বরী ও এর আশপাশের এলাকা দূষিত করে চলেছে। ধলেশ্বরী যদি দূষিত হয়ে পড়ে, তবে বুড়িগঙ্গার সাথে সংযোগ থাকার কারণে তাও পুনরায় দূষিত হয়ে পড়বে।
হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভার শিল্পপার্কে স্থানান্তর নিয়ে বছরের পর বছর ধরে টালবাহানা হয়েছে। ট্যানারি মালিকদের নানা অভিযোগ এবং শিল্পপার্ক পুরোপুরি প্রস্তুত না করে স্থানান্তর কার্যক্রম শুরু করার কথা শোনা গিয়েছে। এমনকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা ছাড়াই স্থানান্তর কাজ শুরু হয়। ফলে শুরু থেকেই ট্যানারি বর্জ্য উন্মুক্ত স্থানসহ ধলেশ্বরী নদীতে পড়তে থাকে। পত্র-পত্রিকায় এমন প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে, ট্যানারি থেকে নির্গত বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্যরে কারণে ধলেশ্বরীর মাছ ও জীববৈচিত্র বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আশপাশের ফসলী জমি বিরান হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। সিইটিপি পুরোপুরি স্থাপন নিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের কথাও শোনা গেছে। কর্তৃপক্ষ বরাবরই বলেছে, সবকিছু ঠিক আছে। বাস্তবে দেখা যায়, সব ঠিক নেই এবং এক ধরনের বেহাল অবস্থার মধ্য দিয়েই শিল্প বর্জ্য নিঃসরণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সিইটিপি যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বুয়েটের একটি দল পরীক্ষা করে দেখেছে, ট্যানারি বর্জ্য শোধনে সিইটিপিতে যে ধরনের এবং যে পরিমাণ কেমিক্যাল প্রয়োজন তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। এ দলের প্রধান অভিযোগ করে বলেছেন, সিইটিপি পরিচালনাকারী চীনা প্রতিষ্ঠানকে বারবার বলা সত্তে¡ও তারা ভাল কেমিক্যাল ব্যবহার করছে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, চীনা প্রতিষ্ঠানটি আলাদা একটি ক্রোমিয়াম ইউনিট বসিয়েছে, যা থেকে নির্গত গ্যাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ অন্যান্য ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করতে পারে। ট্যানারি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ হাজার ঘনফুট তরল বর্জ্য সিইটিপি থেকে ধলেশ্বরি নদীতে ফেলা হয়। অন্যদিকে বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে ফেলা এই বর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন করা হচ্ছে না। তাদের মতে, সিইটিপি থেকে যে তরল বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে, তাতে বিষাক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি ৭.৪৮ মাইক্রোগ্রাম। অথচ তা হওয়া দরকার দুই মাইক্রোগ্রাম। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিমের এই পর্যালোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সাভার ট্যানারি শিল্পপার্ক পুরোপুরি চালু হলেও, তাতে বর্জ্য শোধনের বিষয়টি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এছাড়া ট্যানারির দক্ষিণে বর্জ্য ফেলার জন্য যে পুকুর তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো সময়মতো পরিস্কার করা হয় না। এর দুর্গন্ধে আশপাশের পরিবেশ ও মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এলাকার মানুষ অভিযোগ করে বলেছে, পুকুর ভরে বর্জ্য যখন উপচে পড়ে তখন প্রকল্পের শ্রমিকরা পাড় কেটে দেয়। এতে আশপাশের এলাকা দূষিত করে ফেলে। পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনগুলো বলেছে, আদালতের নির্দেশ থাকা সত্তে¡ও ট্যানারি কর্তৃক দূষণের বিষয়টি কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সাভারে ট্যানারির আধুনিক শিল্পপার্ক করার পরও যদি নদী, ফসলী ক্ষেত ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার পরিবেশ দূষিত হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যে চরম গাফিলতি রয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারটি কেন সঠিকভাবে কাজ করবে না? এর পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছে তারা কেন গাফিলতি করছে? তাদের এই গাফিলতির কারণে নদী ও পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা কি তারা বুঝতে পারছে না? এক নদী ও পরিবেশ বাঁচাতে গিয়ে আরেক নদী ও পরিবেশ মেরে ফেলার নিশ্চয়ই এই শিল্পপার্কের উদ্দেশ ছিল না। আমরা দেখেছি, ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর নিয়ে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ থেকে শুরু করে নানা টালবাহানা হয়েছে। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায়ই এখানে ট্যানারি স্থানান্তর শুরু হয়। তারপর থেকে বর্জ্য শোধন ও শোধনাগার নিয়ে শুরু হয় অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। সিইটিপি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় বেশ কিছু ট্যানারি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যে বর্জ্য ফেলা শুরু করে। যখন চালু হলো তখন দেখা গেল, বর্জ্য শোধনে যে পরিমান ও মানের কেমিক্যাল প্রয়োজন তা দেয়া হচ্ছে না। অর্ধ পরিশোধনের মাধ্যমেই বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর অবধারিত ফলাফল হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী বুড়িগঙ্গার মতোই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, ধলেশ্বরী ও এর আশপাশের পরিবেশ বাঁচাতে ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধনের যথাযথ ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের গাফিলতি বরদাস্ত করা যাবে না। বর্জ্য পরিশোধনের বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে যদি ট্যানারি শিল্পপার্ক সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা প্রয়োজন হয়, তবে তা রাখা যেতে পারে। কারণ ট্যানারি বন্ধ হলে তা চালু করা যাবে। নদী ও পরিবেশ হারিয়ে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।