Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

আওয়ামী লীগের কাছে গণতন্ত্রের মূল্য কতটা?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সামনের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদের পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যেভাবে কথাবার্তা বলে চলেছেন, তাতে আশংকা হচ্ছে আসন্ন এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। আওয়ামী লীগ নেতারা যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে যেভাবে উন্মক্ত হয়ে উঠেছেন, তাতে তাদের কথাবার্তায় যে স্ববিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে, সেটা বুঝার ক্ষমতাও যেন তারা হারিয়ে ফেলছেন।
আমাদের এ বক্তব্যের সপক্ষে একটা দৃষ্টান্ত দিলেই যথেষ্ট হবে বলে আমাদের ধারণা। বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গে নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে পূর্বেকার সমঝোতা লংঘন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপি সে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ফলে দেশের ইতিহাসের অন্যতম বির্তকিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারীতে। দেশের জনগণ এ বিতর্কিত নির্বাচনকে সঙ্গতকারণেই ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’ আখ্যা দেয়। কারণ দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পর এ নির্বাচন হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসন।
৫ই জানুয়ারী সে নির্বাচন প্রকৃত প্রস্তাবে যে একটি প্রহসনে পরিণত হয়ে পড়েছিল তা এতোদিনে বুঝতে পারছেন আওয়ামী লীগের দুই নম্বর নেতা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে এজন্যও বিএনপিকে দুষতে তিনি ভুলেননি। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ঐ বিতর্কিত নির্বাচন বর্জন করায় সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা ৩০০ এর অর্ধেকের বেশী ১৫৩ জন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক কলংকের জন্ম দেয়। এখন আওয়ামী লীগের দুই নম্বর নেতা ওবায়দুল কাদের বলছেন, সংসদে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আওয়ামী প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার এ ঘটনা ছিল বিএনপির তৈরি ফাঁদ।
প্রশ্ন ওঠে, এটা যদি বিএনপি তৈরি ফাঁদই হয় তবে সে ফাঁদে আওয়ামী লীগ পা দিয়েছিল কেন? আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা কি রাতারাতি হঠাৎ নাবালেগ-নাবালেগা হয়ে গিয়েছিলেন যে তারা নিজেদের কোন্টা ভাল, কোন্টা মন্দ তা বুঝবারও বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন? আসলে তারা বুদ্ধি হারিয়েও ফেলেননি, রাতারাতি নাবালেগ-নাবালেগা হয়েও যাননি। তারা স্বেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না।
আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না তার অসংখ্য প্রমাণ আছে বাংলাদেশের ইতিহাসে। অথচ আওয়ামী লীগের কাছে দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল এর বিপরীতটাই। কারণ ১৯০৬ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে জন্ম নেয়া মুসলমানদের এই রাজনৈতিক দলটির দীর্ঘতম রাজনৈতিক ধারাবাহিক তার অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোন দলের নেই। তাছাড়া ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে দলের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাষায় (পকেট) মুসলিম লীগের বিপরীতে আমজনগণের মুসলিম লীগ হিসাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হওয়ায় এমনটাই এ দলের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল।
দু:খের বিষয় জনগণের সকল রকম প্রত্যাশাকে অবাস্তব প্রমাণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম থেকেই অগণতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণ শুরু করে। তাই তো আমরা দেখতে পাই, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একমাত্র একটি সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। এরপর কিছু অভাবনীয় ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগের এ অবিশ্বাস্য পদক্ষেপের মূলে থাকতে পারে এই সত্য যে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। আর সেই বিএনপি ছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া সেই নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অন্যতম বিএনপির তুলনায় সামরিক ক্যুর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন আওয়ামী লীগের কাছে অধিক প্রিয় মনে হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেত্রীর গণতন্ত্রে বিশ্বাসও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পরের ইতিহাসও একই সত্যের প্রমাণ বহন করে। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগদিলেও আওয়ামী লীগ জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী বিরোধী আন্দোলন থেকে বহুদিন দূরে সরে থাকে। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নবাগতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এরশাদ আমলের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে।
এ সাধারণ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে দেশের দুই প্রধান দল সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হয়। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল তেমনি সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী নেত্রীর বিশ্বাস ছিল দেশের সবচাইতে সুসংগঠিত ও প্রাচীনতম দল হিসাবে তারাই নির্বাচনে জয় লাভ করবেন। নির্বাচন চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি অবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষ হলে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সুক্ষ কারচুপি হয়েছে।
তবে তাঁর এই কথায় জনগণ কোন আমল দেয়নি। স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচন বিজয়ী বিএনপির চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশে সরকার গঠিত হয় এবং সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়ার প্রধান মন্ত্রীত্বের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে প্রধানত বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্তাবধায় সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসহ সংবিধান সংশোধিত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই ব্যবস্থাই যে গণতন্ত্রের নিরিখে সব চাইতে উপযোগী তা বাস্তবে প্রমাণিত হলো। কারণ এই ব্যবস্থার অধীনে দেশে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পালাক্রমে দেশে দুই প্রধান দল বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। দু:খের বিষয় এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের অতিরিক্ত ক্ষমতা-সুধার মাধ্যমে একই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও এক পর্যায়ে পচিয়ে ফেলা হয়। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীদের আমলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণাকে দুই প্রধান দলের মধ্যে অতীতের সমঝোতার লংঘন বলে অভিযোগ এনে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি কর্তৃক বর্জিত সেই নির্বাচনের ফসলই বাংলাদেশের বর্তমান সরকার।
দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি কর্তৃক বর্জিত হওয়ায় ৫ জানুয়ারীর এ নির্বাচন হয়ে পড়ে চরম বিতর্কিত। জনগণ এ নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিশ্বাসী জনগণ যেখানে সাধারণত নির্বাচনের দিনে সকল কাজ ফেলে সর্বাগ্রে ভোটার লাইনে দাঁড়াতে অভ্যস্ত সেখানে অধিকাংশ কেন্দ্র ভোটদানের নির্দিষ্ট সময়ে ছিল ফাঁকা, প্রায় জনশূন্য। যদিও প্রচুর ভোটে সরকারী দলের বিজয়ী হওয়ার কথা সরকারী দলের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, প্রকৃত পক্ষে ভোট দানের নির্দিষ্ট সময়ে অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল ফাঁকা। বিরোধী দল তো দূরের কথা, ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মীও ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন, তারা না গেলেও তাদের ভোট দানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে। বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের অল্প সংখ্যক নেতাকর্মীরা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ইচ্ছামত দলীয় প্রার্থীদের ব্যালটপত্রে সীলমেরে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত ভোট-সংখ্যা কল্পনাতীতভাবে বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ‘বিপুল ভোটে বিজয়ী’ হন।
অবশ্য ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের যে সামান্য অংশই যান তা ফাঁস হয়ে পড়ে পরদিন দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ভোট কেন্দ্র সমূহের সচিত্র প্রতিবেদনে। ফলে জনগণ এ নির্বাচনের নাম দেন ভোটারবিহীন নির্বাচন। তবে জনগণ এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও এতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যে লজ্জিত বোধ করেননি, তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য, যেখানে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যে বিনা প্রতিদ্বিদ্বতায় নির্বাচিত হন তার মূলে ছিল বিএনপির পাতা ফাঁদ।
জনাব ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য যে সত্য নয়, তার প্রমাণ জাতীয় সংসদে প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের খিস্তিখেউর শূনতে হচ্ছে না। বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্য যাদের কাছে খিস্তিখেউর মনে হয়, তাদের কাছে গণতন্ত্রের মূল্য যে কত কম তা সহজেই অনুমেয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আওয়ামী লীগ


আরও
আরও পড়ুন