পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারত থেকে আওয়ামী লীগের টিম বাংলাদেশে ফিরে আসার পর টিমের অন্যতম সিনিয়র সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ একটি ডেঞ্জারাস উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, যতদিন শেখ হাসিনা জীবিত এবং সক্ষম থাকবেন ততদিন তিনি থাকবেন এবং আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবে। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ইলেকশনে অলরেডি জিতে গেছে। এবছরের শেষের দিকে যে নির্বাচন হবে সেটি নেহায়েৎ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই দুটি উক্তি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে মাহবুবুল আলমের উক্তি। সাধারণ বাংলাদেশিদের মধ্যে একটি প্রবাদ আছে। আর সেটি হলো, ‘যার মনে যা লাফ দিয়ে ওঠে তা’। আওয়ামী লীগের মনের মধ্যে যা আছে সেটি অজান্তে বলে ফেলেছেন মাহবুবুল আলম হানিফ। তার এই কথার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতার অনেক কথাই প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে। আওয়ামী লীগ ২০২৪ সাল পর্যন্ত কী কী করবে, সে কথা একবার বলে। আবার ২০৪১ সাল পর্যন্ত কী কী করবে সেকথাও বলে।
শেখ হাসিনার বর্তমান বয়স ৭০। ২০৪১ সালে তার বয়স হবে ৯৪। অর্থাৎ তিনি আরো ২৪ বছর বাঁচবেন। হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। আল্লাহ চাইলে কি না পারেন। আমরা প্রার্থনা করি, তিনি শতায়ু হোন। আল্লাহ চাইলে সব কিছুই পারেন। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ ২০ বছর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার আমলেই মালয়েশিয়া সারা পৃথিবীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এখন আবার ৯২ বছর বয়সে তিনি অবসর ভেঙ্গে রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে এসেছেন। আগামী মে মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেই নির্বাচনে তিনি পুনরায় প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। যদি তার দল পরাজিত হয় তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু যদি তার দল জয়লাভ করে তাহলে ৯২ বছর বয়সে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাই বলছিলাম, আল্লাহ চাইলে সবই হতে পারে। আল্লাহ যদি শেখ হাসিনাকে লম্বা হায়াৎ দান করেন, তিনিও যদি ৯০ বছরের পরেও জীবিত থাকেন এবং কর্মক্ষম থাকেন তাহলে তার পক্ষে ৯০ বছরেও প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব। তাই আমরা হানিফ সাহেবের কথাকে সহজভাবেই নিচ্ছি।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের সংবিধান মোতাবেক প্রতি ৫ বছর অন্তর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে মেজরিটি নিয়ে পার্লামেন্টে এলে সরকার গঠন করা যায়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা যদি চলতি বছরে মেজরিটি লাভ করেন তাহলে তিনি অবশ্যই ৪র্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসবেন। এভাবে পরপর লাগাতার ৫টি মেয়াদে অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতায় আসতে হবে। হানিফ সাহেবের বক্তব্য মোতাবেক শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। সেটা তিনি থাকতেই পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আসতে হবে।
দেশের বর্তমান অবস্থা কী বলছে? এই সরকার কি এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আস্থাভাজন? আমরা বলবো না যে, এই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আস্থাভাজন নয়। আবার আমরা একথাও বলবো না যে, এই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আস্থাভাজন। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো বলছে যে, এই নির্বাচনে ৬ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দেয়নি। বিদেশি একাধিক জরিপ সংস্থা এবং গবেষণা সংস্থা বলছে যে, ওই নির্বাচনে কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে ২০ শতাংশ। অবশিষ্ট এলাকায় ভোট পড়েছে ২০ শতাংশের অনেক কম। ১৫৪ জন এমপি বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এটি অনেকে জানেন। তাই সেটির আর পুনরাবৃত্তি করছি না। সরকার বলছে উন্নয়নের জোয়ারে দেশ সয়লাব। মানুষ নাকি এই উন্নয়নে খুব তৃপ্ত এবং সরকারের প্রতি অত্যন্ত খুশি। খুব ভালো কথা। তাহলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে অসুবিধা কোথায়? নিরপেক্ষ সরকারের (কেয়ার টেকার) দাবি তো আওয়ামী লীগই করেছিল। এবং ৯৬ সালে রাজপথে প্রবল গণ আন্দোলন সৃষ্টি করে তারা বিএনপি সরকারকে সংবিধান সংশোধন করে কেয়ার টেকার সরকার দিতে বাধ্য করেছিল। সেই আওয়ামী লীগই আবার কেয়ার টেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। কেয়ার টেকার হোক বা নিরপেক্ষ সরকার হোক বা যে নামেই ডাকা হোক না কেন, একটি অবাধ নির্বাচন করতে ক্ষতি কোথায়? ২০০৯ সালের আগে কেয়ার টেকারের অধীনে যতগুলি ইলেকশন হয়েছে তার সব কটিতে সেনা মোতায়েনকে আওয়ামী সরকার অভিনন্দন জানিয়েছে। এখন তারা সেনা মোতায়েনের ঘোর বিরোধী কেন? বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ যত রকম সুযোগ সুবিধার দাবি জানায়, সরকারে গেলে তারা তার সবকটিরই খাড়া বিরোধিতা করে কেন? সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, All is not well with Awami League. Some thing is grossly wrong some where. ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।
\দুই\
ফিরে আসছি আওয়ামী লীগের আজীবন ক্ষমতায় থাকার প্রশ্নে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে কোনো দল যদি এক মেয়াদ, দুই মেয়াদ, তিন মেয়াদ এমনকি আজীবন ক্ষমতায় আসতে পারে, তাহলে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। কারণ এই পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসার অর্থ হলো জনগণ তাদেরকে ক্ষমতায় আনছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমরা আর কোনো কথা বলবো না। তবে যা কিছুই করা হোক না কেন সেটি সংবিধান , বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী যেন না হয়। বাংলাদেশে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু কত বছরের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন সেটি ওই সংশোধনীতে উল্লেখ নাই। এ সম্পর্কে ৪র্থ সংশোধনীর ৩৪ অনুচ্ছেদের (খ) উপ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।’
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আলোচ্য সংশোধনী মোতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি কত দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেন সেটি ওই সংশোধনীতেও নাই, আবার সরকারি ঘোষণাতেও নাই। এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। অর্থাৎ পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট থাকবেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে মাত্র কিছু দিন আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে। কিন্তু কতদিনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন সেটি চৈনিক সংবিধানে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় বিশ্ব মিডিয়াতে বলা হচ্ছে যে শি জিন পিং আজীবনের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন বাকশাল কায়েম হয় এবং ঐ সংশোধনীতে যখন শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ঐ সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ উল্লেখ না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত সচেতন মহলে গুঞ্জন ওঠে যে, শেখ মুজিব আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সাংবিধানিক অস্পষ্টতার জন্যই এমন একটি কথা পত্র পল্লবে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শেখ মুজিব বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার অধীনে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল। এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত থাকেন ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ এই পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন ৯ মাস ১ দিন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। এই পদে সমাসীন ছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ এই পদে তিনি সমাসীন ছিলেন ৩ বছর ১২ দিন। অতঃপর বাকশাল চালু হলে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। বাকশাল প্রেসিডেন্ট বা একদলীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ৬ মাস ২১ দিন।
\তিন\
১৫ আগস্টে যদি দৃশ্যপটের পরিবর্তন না ঘটতো তাহলে কতদিন তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতেন সেটি কারো পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। এখানে একটি বিষয় খুবই দুর্বোধ্য। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বলা হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যকালের মেয়াদ হবে ৫ বছর। বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। পাঁচ বছর মেয়াদী এই সংসদের আয়ুষ্কাল ছিল ১৯৭৮ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু ২ বছর ৪ মাস কার্যকর থাকার পর ৪র্থ সংশোধনী মোতাবেক জাতীয় সংসদের মেয়াদ আরো ৫ বছর বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ ৪র্থ সংশোধনী মোতাবেক ১ম জাতীয় সংসদের মেয়াদ হয় ৭ বছর ৪ মাস। এটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক এবং বেআইনি। কারণ ১ম সংবিধান মোতাবেক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছিল ৫ বছরের জন্য। সেটির মেয়াদ জাতীয় সংসদ নিজেই ২ বছর ৪ মাস বাড়াতে পারে না। এটি ছিল ১ম সংবিধানের চরম লঙ্ঘন।
এখন আবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছেন যে, শেখ হাসিনা আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু কোন পথে থাকবেন? ৪র্থ সংশোধনীর মতো আর একটি সংশোধনী করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে? নাকি আগামী ৪/৫টি নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লাগাতার জয়লাভ করবেন? যদি পরবর্তী কয়েকটি নির্বাচনে তিনি লাগাতার জয়লাভ করেন তাহলে কারো কিছু বলার নাই। আর যদি প্রথম পথ অনুসরণ করে সেটি ঘটানো হয় তাহলে সেটি শুধুমাত্র সংবিধান পরিপন্থীই হবে না, সেটি হবে চরম স্বৈরতান্ত্রিক পথ। আগামী ডিসেম্বরে যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জয়লাভ করবে তার গ্যারান্টি কে দিয়েছে? অবশ্য তাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনুযায়ী যদি কাজ হয় তাহলে বুক চাপড়ানো ছাড়া মানুষের আর কিছু করার থাকবে না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, আগামী নির্বাচনে ধরা যায় যে, আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। নির্বাচনটি নেহায়েৎ একটি আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। এই দুই নেতা যা বলেছেন তার পরেও দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ নির্বিকার। এটিই সবচেয়ে বিস্ময়ের। মনে হচ্ছে, এই জাতির মেরুদÐ ভেঙ্গে গেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।