শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
‘দাদু, তোমার জন্যও একটি টকটকে লালগোলাপ।’
আয়নাল সাহেবের ষোড়শী নাতনি একটি গোলাপফুল হাতে তুলে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বন্ধুর সাথে গেটের বাইরে চলে যায়।
আয়নাল সাহেব গোলাপটি হাতে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যায়। ফুলটি কুড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করেন হাতটি কেমন অবশ হয়ে আসছে- তেমন জোর পাচ্ছেন না। ভালো করে আঙুলগুলো টিপে দেখেন কোথাও ব্যথা নেই।
গোলাপটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে নাকে ধরতেই তিনি অতীতে হারিয়ে যান। তার জীবনে প্রায় ৭৫টি ভালোবাসা দিবস পেরিয়ে গেছে কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ভালোবেসে ফুল দেওয়া তো দূরের কথা দুটো ভালো কথাও বলেন নি কোনোদিন। ছাত্রজীবনে একটি মেয়ে তাকে ফুল দিয়েছিল- ঠিক এমনি টকটকে লালফুল। বিনিময়ে তিনি তাকে দিয়েছিলেন লজ্জা। তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন তার সম্ভ্রম। পরে মেয়েটি লজ্জায় আত্মহত্যা করেছিল।
নেতা হবার পর সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়েছে লোক-লস্কর নিয়ে। তার দল যখন ক্ষমতাসীন ছিল তখন তো নিঃশ্বাস ফেলানোর সময় ছিল না। কত কোন্দল-বিবাদ, কত রকমের সমস্যা মেটাতে হয়েছে তাকে। এর পর ছিল উঠতি নেতা আরিফের সাথে দ্ব›দ্ব। খুন-গুম, উপড়ি টাকার লেন-দেন কত কিছুই না করেছেন এই হাত দিয়ে।
আজ থেকে অনেক আগে ঠিক এই দিনে মিষ্টি আর ফুলের তোড়া নিয়ে কোন্দল মেটাতে এসেছিল ছাত্রনেতা আরিফ। মিষ্টি ফুল গ্রহণ করে সেদিন ওর সাথে বুকে বুক মিলিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু আরিফ চলে যেতেই ড্রয়ার খুলে তিনি পিস্তল তুলে দিলেন আজ্ঞাবহ স্বপনের হাতে। স্বপন দলবল নিয়ে সে রাতেই আরিফসহ ওদের গ্রæপের ৯ জনকে ফেলে দেয়। এটা করে আগামী ভোটের বিজয় নিশ্চিত করেন আয়নাল হক।
এমন মনে হতেই মনটা কেমন হাহাকার করে ওঠে। এই ৭৫ বছরের কোনো একদিন এমনটি হয় নি তার। তিনি বর্তমানে ধর্ম-কর্মে মন দিয়েও এসব দুঃস্মৃতি ভুলে যেতে পারেন নি। তিনি অতীতের যত খারাপ স্মৃতি সব ভুলে যেতে চান।
আয়নাল সাহেব ফুলটি টেবিলের ’পর রেখে অজু করতে যান কলতলায়। হাত ধৌত করার সময় ভালো করে দৃষ্টিগোচর হয়- হাতের আঙুলগুলো কেমন ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে। পানি-টানি লেগেছে নাকি? আয়নাল সাহেব দ্রুত অজু শেষ করে জায়নামাজের ’পর গিয়ে বসেন।
আয়নাল সাহেব নামাজ শেষ করে মোনাজাতের জন্য হাত তোলেন। দু’হাতের দশ আঙুল একত্রিত হয়। হাতের ফোলা আঙুলগুলোর দিকে চোখ পড়তেই মনে হয় ওগুলো যেন দশটি মানুষের মুখ; কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
চাদর
শফিক সাহেব গা থেকে চাদরটি খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন, কই; আমার স্যুট-কোট দাও শিগগির!
স্ত্রী রহিমা ওয়ারড্রোব থেকে কোট-প্যান্ট বের করে নিয়ে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়ায়। কোট-প্যান্ট শফিক সাহেবের হাতে দেয়ার পর দেখে- চাদরটি মেঝেয় পড়ে রয়েছে। চাদরটি হাতে তুলে নিতে নিতে বলে, এভাবে মেঝেতে চাদর ফেলে দিতে হয়? গুছিয়ে বিছানার কোণে রাখলেই পারতে। বেশি শীতে তো চাদরই কাজে লাগে।
- রাখো, আজকাল ভদ্রলোকেরা চাদর পড়ে নাকি! স্যুট-কোট আছে না?
- স্যুটকোটে সবসময় শীত যায় না। চাদরের ওম আরামদায়ক। এটা গায়ে চড়ালে একটা আলাদা মজা অনুভব করা য়ায়। মৃদু হাসে রহিমা।
-রাখো তোমার মজা। চাদর পড়লে কেমন ক্ষ্যাত-ক্ষ্যাত লাগে।
- যাই বলো, এ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি; এর ওমের মধ্যে একটা দেশীয় প্রেম আছে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে রহিমা পেছন থেকে স্বামীর বাহু জড়িয়ে ধরে বলে।
- কি যে বলো! গেঁয়ো কোথাকার। শেষের কথাটা মনে মনে বলে শফিক সাহেব। কিছুটা বিরক্তি ভরে রহিমাকে ঠেলে দিয়ে স্যুটকোট পরা শফিক সাহেব গটমট করে ঘর হতে বের হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
শফিক ও রহিমার একই গ্রামে বাড়ি। এস এস সি পাস করার পর পরই শফিকের সাথে রহিমার বিয়ে হয়ে যায়। শফিক তখন ইংরেজিতে এম এ পড়তো। শ্বশুরের খরচেই পড়াশোনা শেষ করে সে। এম এ পাস করার পর বছর দুয়েক এক বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে শফিক। এরপর হঠাৎ করেই বি সি এস পরীক্ষায় টিকে যায়। সে থেকেই একটি সরকারি মহিলা কলেজে আছে।
মাঘ মাসের এক প্রচন্ড শীতে বিয়ে হয়েছিল ওদের। শ্বশুর সাহেব নতুন একটি চাদর জামাইয়ের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের দেশীয় শাল- খুব ওম, শীত গেলেও যত্ন করে রেখো। রহিমা চাদরটি ওয়ারড্রোবের ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে চোখ থেকে দু’ফোটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
সরকারি কলেজে স্যার হবার পরই কি শফিকের অহংকার বেড়ে গেছে? কিন্তু গত শীতেও তো ও এই চাদর পড়েই কলেজে গিয়েছে। এই স্যুটও তো সে গত শীতে কিনেছে কিন্তু পরে নি। হঠাৎ এমন পরিবর্তন হলো কি করে? রহিমা কোনো হিসেব মেলাতে পারে না।
শফিক সাহেব ক্লাসে ঢোকা মাত্রই ছাত্রীরা অবাক নয়নে তাকায় তার দিকে। যে স্যারকে চাদর গায়ে ছাড়া কলেজে আসতে দেখা যায় নি কোনোদিন, সে কি না স্যুট-কোট পরে কলেজে এসেছে? অবাক কান্ড! মুখরা এক ছাত্রী বলেই ফেলল, স্যারের বয়স কমে গেছে দশ বছর।
আরেকজন বলল, স্যার, আপনাকে না শাকিব খানের মতো লাগছে।
শফিক সাহেব কী জবাব দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় আলট্রা মডার্ন এক সুদর্শন ছাত্রী বলে উঠল, ওয়াও! সো হ্যান্ডসাম! স্মার্ট বয়! ভেরি নাইস! আমার দেওয়া গিফটটা না স্যা...
- না-মা-নে, হ্যাঁ। শফিক সাহেবের কথা জড়িয়ে যায়। এই আলট্রা মডার্ন ছাত্রী মারিয়া কথা বললে শফিক সাহেব কেমন যেন নার্ভাস ফিল করেন। হৃদয়ের মধ্যেখানে কেমন ভাঙচুর শুরু হয়। ছাত্রজীবনের হাওয়া এসে লাগে গায়ে।
- কি ভাবছেন স্যা’। এবারের জন্মোৎসবটা কিন্তু আপনার বাসায় হবে স্যা’।
- হ্যাঁ। কথাটা বলেই চিন্তায় পড়ে যান শফিক সাহেব। গত বছর ছাত্রীরা কলেজে তার জন্মোৎসব পালন করেছিল। আড়ালে-আবডালে করলেও স্যারদের মধ্যে কানা-ঘুসা হয়েছে। অধ্যক্ষ স্যারের কানেও গিয়েছে কথাটা। তিনি মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ফুঁসছেন। যা হোক, বাড়িতেই এবার জন্মোৎসব হবে। ছাত্রীরা যখন ধরেছে। বিশেষ করে মারিয়ার কথা ফেলবে সে কী করে।
বাড়ি এসে শফিক সাহেব কৌশলে রহিমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বলেন, পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে নাইয়রে যাও, আমি ছুটি নিয়ে কদিন পরেই তোমাকে নিয়ে আসব। রহিমা স্বামীর কথার কোনো উচ্চ-বাচ্য করে না; বরং মনে মনে একটু খুশিই হয়- বহুদিন পর বাপের বাড়ি যেতে পেরে।
দু’দিন পরেই শফিক সাহেবের জন্মদিন। কলেজ থেকে তিনি তিন দিনের ছুটি নেন। ঘরের আয়োজনটা ছোট হলেও হৃদয়ের গহনে চলে বড় রকমের আয়োজন।
উচ্চ ভলিউমে ক্যাসেটের গান আর ছাত্রীদের নাচের মধ্য দিয়ে রাত দশটা পর্যন্ত জন্মোৎসব চলে। মারিয়া ছাড়া সবাই বাসায় চলে যায়। মারিয়া বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে বলে, তোরা যা, আমার একটু মাথা ধরছে। স্যার একটু পরে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন।
পরদিন পাড়াময় খবর হয়ে যায় মহিলা কলেজের ইংরেজি স্যার স্ত্রীর অবর্তমানে ছাত্রীর সাথে বাসায় রাত কাটিয়েছে। খবরটি কলেজে সবার মধ্যে প্রচার হয়ে যায়। অধ্যক্ষ স্যার তদন্ত কমিটি গঠন করে শফিক সাহেবকে ৬ মাসের সাময়িক বরখাস্ত করেন।
খবরটি রহিমাদের গ্রামেও পৌঁছায়। শুনে কাঠ হয়ে যায় রহিমা। এমন সাধু-সন্ত স্বামী; সে কি না...
৬ মাস পর শফিক সাহেব চাকুরি ফিরে পায়। পরদিনই শ্বশুর বাড়ির দিকে ছোটেন রহিমাকে ফিরিয়ে আনতে। গায়ে তার শ্বশুরের দেওয়া সেই পুরনো চাদর। প্রচন্ড গরমেও তিনি জড়োসড়ো হয়ে রহিমার সামনে দাঁড়ান। কোমল স্বরে বলেন, স্যুট-কোট ফেলে দিয়েছি: ওগুলা আমাকে মানায় না। ভেবেছি বাকী জীবনটা চাদর পরেই কাটিয়ে দেবো।
রহিমা স্তব্ধ হয়ে থাকে; কোনো উত্তর দিতে পারে না।
৬ মাস পর শফিক সাহেব চাকুরি ফিরে পায়। পরদিনই শ্বশুর বাড়ির দিকে ছোটেন রহিমাকে ফিরিয়ে আনতে। গায়ে তার শ্বশুরের দেওয়া সেই পুরনো চাদর। প্রচন্ড গরমেও তিনি জড়োসড়ো হয়ে রহিমার সামনে দাঁড়ান। কোমল স্বরে বলেন, স্যুট-কোট ফেলে দিয়েছি: ওগুলা আমাকে মানায় না। ভেবেছি বাকী জীবনটা চাদর পরেই কাটিয়ে দেবো।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।