Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধ্যপ্রাচ্যে কৃত্রিম সঙ্কট এবং ইরান বিপ্লবের চার দশক

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মহাযুদ্ধোত্তর সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে মূলধারার বিশ্বরাজনীতি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে এক ধরনের টান টান উত্তেজনা বিরাজ করলেও পারমানবিক শক্তিধর দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের ঘটনা না ঘটলেও মধ্যপ্রাচ্যে আারব-ইসরাইল সংঘাতের মধ্য দিয়ে দুই প্রতিপক্ষ দুইদিকে তাদের বাহু বিস্তার করে মূলত অস্ত্র ব্যবসায় ও অর্থনৈতিক ফায়দা লুটেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক বিশ্ব রাজনীতির তিনটি অধ্যায় পরিলক্ষিত হয়। এর প্রথম পর্বে আছে, প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান অ্যাম্পায়ার ভেঙ্গে দেয়া, দ্বিতীয় পর্বে ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তেলসম্পদের উপর একচ্ছত্র পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বশেষ পর্বটি শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব এবং ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। শেষ পর্বের প্রথম ধাপে আফগান মুজাহিদদের প্রতিরোধের মুখে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হলেও ইরানের ইসলামি বিপ্লব ব্যর্থ করে দিয়ে সেখানে রিজিম চেঞ্জ’র পশ্চিমা ও আঞ্চলিক মহাপরিকল্পনার পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমে আট বছর ব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধ, অত:পর প্রায় চারদশক ধরে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মধ্যেও ইরান নিজস্ব সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিকে এগিয়েছে। আরব-ইসরাইল সংঘাতে পরাশক্তিগুলোর ভাগাভাগি ভ‚মিকার এখন শেষ পর্ব চলছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর থেকে গত প্রায় দেড়যুগ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ধ্বংস ও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে এখন তার এক চ‚ৃড়ান্ত পরিণতি প্রত্যক্ষ করছি আমরা। সিরিয়ায় পশ্চিমা প্রক্সিবাহিনীর পর্যুদস্তু‘ অবস্থা এবং ফিলিস্তিন নিয়ে জায়নবাদি ইসরাইল এবং মার্কিন উগ্রবাদি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন গেমপ্লান মধ্যপ্রাচ্যে মানবিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরী করেছে। সিরিয়াযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভ‚মিকা বিশ্বমানবতাকে স্তম্ভিত করেছে। যুদ্ধের বিভীষকার চ‚ড়ান্ত রূপ উন্মোচিত করার পাশাপাশি ডাবল স্ট্যার্ন্ডাড রোল প্লে করার পরও যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নিয়ে পশ্চাদপসারণে বাধ্য হচ্ছে, ঠিক তখনি সিরিয়া, ইরাক ও তুরস্ক সীমান্তে পশ্চিমা মদদপুষ্ট আইএস সন্ত্রাসী ও মার্কিন বাহিনী মরণ কামড় বসাতে চাইছে। গত ৫ বছরের অব্যাহত ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ পেরিয়ে রাশিয়া ও ইরানের হস্তক্ষেপে সিরিয়া যুদ্ধের শেষ পর্বে এসেও যখন আসাদ সরকারকে সরানো যাচ্ছেনা তখন তা যেন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের জন্য চরম মর্যাদার লড়াই হয়ে দাড়িয়েছে। যদিও চলমান বাস্তবতা হচ্ছে, সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিনীদের রাজনৈতিক বিজয় অর্জন প্রায় অসম্ভব। সিরিয়ায় রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে আঞ্চলিক ও সা¤্রাজ্যবাদি শক্তিগুলোর মধ্যে নানামাত্রিক মেরুকরণের শেষ মুহুর্তে তুর্কি সেনাবাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণ যুদ্ধে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সিরিয়ায় এতদিন রাশিয়া এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের ভ‚মিকায় পরস্পরের মধ্যে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর কৌশল দেখা গেলেও এখন তুর্কি বাহিনী সরাসরি মার্কিন বাহিনীর ভ‚মিকা সিরিয়া ও ইরাকে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরী করেছে। আইএস, দায়েশসহ সন্ত্রাসী বাহিনী মোকাবেলার নামে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি পুরো অঞ্চলের জন্য একটি বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে সিরিয়ার সাথে ইরাণ, রাশিয়া ও চীনের সামরিক, ক‚টনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগে তা উত্তরণের একটি পথরেখা দেখা গেলেও তুরস্কের সাম্প্রতিক ভ‚মিকা পরিস্থিতিকে একটি জটিল আবর্তে ঠেলে দিতে শুরু করেছে। সিরিয়া, ইরান ও রাশিয়ার পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় না করে হঠাৎ করেই সিরিয়ার মানবিজ ও আফরিনে তুর্কি বাহিনীর সামরিক অভিযান নানামাত্রিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত সপ্তাহে তুর্কি বাহিনী সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে রক্তক্ষয়ী অভিযান পরিচালনার পর সিরিয়ার পক্ষ থেকে সিরিয় ভ‚মিতে আগ্রাসন ও দখলবাজির অভিযোগ তুলেছে সিরিয়া। তবে সর্বশেষ গত রবিবার তুর্কি বাহিনী আফরিনে কথিত কুর্দি বাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং পাল্টা আক্রমনে অন্তত ৭জন তুর্কি সেনা সদস্য নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সিরিয়া,রাশিয়া, হেজবুল্লাহ ও ইরানের যৌথ ও সমন্বিত আক্রমণে পশ্চিমা মদদপুষ্ট আইএস, কুর্দিশ বাহিনীর চরম পরাজয়ের পর এখন তুর্কি বাহিনীর বিতর্কিত অভিযান সিরিয়ায় একটি শান্তি প্রক্রিয়ার সম্ভাবনায় নানামুখী আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে।
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুর্কি সামরিক অভিযানের পর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কারো পক্ষ থেকে তেমন কোন সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে মানবিজ অভিযানের এক পর্যায়ে সেখানে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংর্ঘষের আশঙ্কা দেখা দিলে তুরস্কের পক্ষ থেকে তাদেরকে সরে যাওয়ার আহŸান জানানো হলেও মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের তরফ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তুর্কি বাহিনী এরপর সম্ভবত তাদের অভিযানের গতিপথ পরিবর্তন করে আফরিনের দিকে মনোনিবেশ করে, সেখানেও তারা তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। একই সময়ে সিরিয়ার পক্ষ থেকে যখন জাতিসংঘে তুর্কিদের বিরুদ্ধে সিরীয় ভ‚খন্ড দখলের প্রকাশ্য অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়’। সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বাস্তবতায় তুর্কিদের ভ‚মিকা ও অবস্থান এক জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। অন্যতম আঞ্চলিক অনুঘটক ইরান যখন মার্কিন ও পশ্চিমাদের বিপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে রাশিয়ার সাথে একটি সমঝোতামূলক কৌশলগত ঐক্য গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সিরিয়া যুদ্ধে জায়নবাদিদের গেমপ্লান ব্যর্থ করে দিয়েছে তখন অন্যতম আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের অনেক কিছুই করনীয় আছে। সিরিয়া, রাশিয়া ও ইরানের আইএস বিরোধি অভিযানের রণকৌশলে তুরস্কের সাথেও একটি বোঝাপড়া ছিল বলেই তা ফলপ্রসু হয়েছিল। সেখানে এখন একটি স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর বদলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়াই একটি একপাক্ষিক সামরিক আগ্রাসন কারো জন্যই হয়তো শুভ ফল বয়ে আনবেনা। তবে পরিস্থিতি আবারো জটিল আকার ধারণ করলে আইএস এবং তার নেপথ্যের কুশীলবদেরই লাভ হবে। আইএস’র ¯্রষ্টা ও মদদদাতা এবং আইএস বিরোধি অভিযানের নামে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা, অস্ত্রবাণিজ্য ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি তৈরীর পেছনে মূলত একই শক্তি সক্রিয় রয়েছে। এদিকে মিশরের সেনা শাসক সিসি আল ফাত্তাহ তার দেশে আইএস সন্ত্রাসীদের দমনে ব্যর্থ হয়ে ইসরাইলের সহায়তা চাইলে ইসরাইলী বাহিনী শতাধিকবার মিশর সীমান্তে বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে, সামরিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একসময়ের সবচে শক্তিশালী দেশ মিশরকে তার সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের সহযোগিতা চাইতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও ইসরাইল যে মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্রোহী, আইএস, দায়েশের প্রতি গোপণ সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা, অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিল তা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সেই আইএস দমনে ব্যর্থ হয়ে মিশরের মত দেশ যখন ইসরাইলের সহায়তা চাইতে শুরু করেছে। তাহলে বলতে হয়, শত শত কোটি ডলার এসব সন্ত্রাসী ও প্রক্সি বাহিনীর পেছনে ব্যয় করার মধ্য দিয়ে ইসরাইলকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি নতুন কৌশলগত উচ্চতায় পৌছে দিয়েছে।
আঞ্চলিক ও অবস্থানগত কারণে রাশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরানকে ন্যাচারাল এলি বলে আখ্যায়িত করা হয়। সাবেক অটোমান সা¤্রাজ্যের উত্তরাধিকার এবং ইউরেশিয়ার অন্যতম ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক অনেক আগেই ন্যাটোর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য হলেও শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠির দেশ হওয়ার পাশাপাশি তুর্কি শাসকরা আরব মিত্রদের মত পশ্চিমা বশংবদ না হওয়ায় ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হওয়া সত্তে¡ও তারা এখনো ইইউ’র সদস্যপদ পায়নি। অন্যদিকে সিরিয়া,ইরান বা রাশিয়ার সাথেও তারা স্থায়ী কোন কৌশলগত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কুর্দি ওয়াইপিজি বাহিনী তুর্কি বাহিনীর অন্যতম টার্গেট আর এই বাহিনীর শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা, সমর্থন ও সশস্ত্র করেছে ইসরাইলী ও মার্কিনীরা। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ডি-স্ট্যাবিলাইজেশন, বলকানাইজেশনের চুড়ান্ত টার্গেট হচ্ছে ইরান। অথচ ইরানের সাথে মার্কিনী ও পশ্চিমাদের সুসম্পর্কের পুরনো ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইরানের শাহ অক্ষশক্তির প্রতি অনুগত হওয়ায় মিত্রশক্তি ইরানের তৎকালীন শাহকে বন্দি করে দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে তার পুত্র মোহাম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে দেয়, তবে ইরানের উপর নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির হাতেই থাকে। যুদ্ধের আগেও পরে ইরানের রাজা রেজাশাহ পাহলবির ইরান ইঙ্গ-মার্কিন বøকের অন্যতম বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কৌশলগত মিত্র ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমাদের ইচ্ছানুসারে ইরানের জনগণ শাহের শাসনকে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত করে ইরানকে পশ্চিমা ধাঁচের একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনৈতিক প্রয়াসে প্রাথমিকভাবে সফল হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে অনুষ্ঠিত ইরানের তথা মধ্যপ্রাচ্যের কোন মুসলিম দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জেনারেল মোসাদ্দেক প্রথম জনগনের ভোটে নির্বাচিত শাসকে পরিণত হন। মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শাহের ক্ষমতা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। নির্বাচনী ওয়াদা হিসেবে মোসাদ্দেক ইরানের তেলসম্পদকে জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণে কাজে লাগানোর মনোনিবেশ করেন। অ্যাংলো ইরানিয়ান তেল কোম্পানীর নামে ইরানী তেলসম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছিল বৃটিশদের হাতে। তেল রাজস্ব হিসেবে ইরান সরকার মাত্র ১৬ ভাগের মালিক ছিল। গণদাবীর প্রেক্ষিতে মোসাদ্দেক অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানীকে জাতীয়করণ করে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের চক্ষুশুল হয়ে পড়েন। নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২ বছরের মাথায় ইঙ্গ-মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর (বিশেষত সিআইএ) সমন্বিত উদ্যোগে ইরানে একটি সামরিক ও রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে ১৯৫৩ সালের আগস্টে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৫৩ সালের মার্চে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট জন ফস্টার ডালি মোসাদ্দেক বিরোধি অভ্যুত্থান সফল করতে তার ছোটভাই, সিআইএ প্রধান এলেন ডালিকে দায়িত্ব দেন। অপারেশন এজাক্স কোডনেমের এই গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়। মোসাদ্দেক উৎখাতের গোয়েন্দা তৎপরতায় ইরানের শাহ রাজবংশ, সেনাবাহিনী ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্য ভ‚মিকা পালন করে সিআইএ এবং বৃটিশ গোয়েন্দারা। মোসাদ্দেককে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বরখাস্ত করতে রেজাশাহ কে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনে সিআইএ। অপারেশন এজাক্স সফল হওয়ার মধ্য দিয়ে ইরানে আবারো পাহলবি শাহের নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়। একচ্ছত্র রাজতান্ত্রিক শাসনের স্থলে গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে ইরান যে নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দিকে যাত্রা করেছিল পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে তা শুরুতেই হোঁচট খেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যেখানে সা¤্রাজ্যবাদি ষড়যন্ত্রের কাছে জনগণের রায় ও গণতন্ত্র পদদলিত হয় সেখানে গণজাগরণ ও বিপ্লবই ইরানীদের জন্য একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়।
পশ্চিমারা রেজাশাহকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনরায় দন্ডমুন্ডের কর্তা বানিয়ে দেয়ার পর রেজাশাহ পাহলবির কর্তৃত্ববাদি শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে রুখে দাড়ানোর একমাত্র প্লাটফর্ম হয়ে দাড়ায় শিয়া ইসলামের ধর্মীয় ঐতিহ্যের নেতৃত্ব। বিশেষত: ১৯৬১ সালের মার্চমাসে তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হোসাইন বেরুজার্দির ইন্তেকালের পর তার উত্তরসুরী হিসেবে আলী খোমেইনীর উত্থানের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে ধর্মীয় চেতনা নতুন শক্তি সঞ্চার করে। কোম নগরীতে একটি বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে ইতিমধ্যেই খামেনীর চিন্তাধারা তৎকালীন ইরানী যুব সমাজের মধ্যে সুগভীর প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। কোরান ও হাদীসের উপর গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর খোমেনির লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে তরুণনদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বাষট্টি সালে শাহের পাস করা স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিল এবং তথাকথিত স্বেত বিপ্লব পরিকল্পনার আওতায় পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনে বেশকিছু আইনগত সংস্কারের বিলও খোমেনির নেতৃত্বে পরিচালিত রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে যায়। পশ্চিমা স্বার্থে এবং প্রেসক্রিপশনে গৃহিত কোন পদক্ষেপই খোমেনির যৌক্তিক ও সুশৃঙ্খল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কারনে সফল হচ্ছিলনা। অবশেষে খোমেনিকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হলে প্রথমে ইরাকে, তুরস্কে অত:পর ফ্রান্সে সব মিলিয়ে ১৩ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৭৯ সালের ১লা ফেব্রæয়ারী দেশে ফিরে বিপ্লবের চুড়ান্ত মুহুর্তের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। খোমেনীর নির্বাসিত জীবনের আগে ও পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া লেকচার ও লেখালেখির মধ্যেই ছিল ইসলামী বিপ্লবের কর্মপরিকল্পনা ও কর্মীদের পথনির্দেশনা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ বিশ্বকে আন্দোলিত করেছিল তার ফলে পূর্ব ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, কিউবা, ভেনিজুয়েলা অত:পর চীনের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রচিত হয়। মাত্র ৭০ বছরের মাথায় বিংশ শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে আবারো ইউনিপোলার পশ্চিমা পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বলয়ের অন্যান্ন দেশগুলো পুঁজিবাদের মূলধারার সাথে আপস করলেও সম্পুর্ন ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার ইরানকে অঙ্কুরেই নির্মূলের যে চক্রান্ত সক্রিয় ছিল তা এখনো বহাল রয়েছে। বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ইরানী ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়ে বেশকিছু মার্কিন ক‚টনীতিককে জিম্মি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটনে ইরান বিরোধি বিক্ষোভ র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। ইরান-ইরাক যুদ্ধ থেকে শুরু করে গত মাসে ইরানে সংঘটিত সরকার বিরোধি গণবিক্ষোভ পর্যন্ত প্রতিটি ইরান বিরোধি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘটনার সাথেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে। তাদের মূল টার্গেট ইরানের ইসলামি বিপ্লব ব্যর্থ করে সেখানে শাহের মত বা আরব রাজাদের মত পশ্চিমা ও ইসরাইলের বশংবদ শাসক বসিয়ে দেয়া। এক প্রবল বিশ্বশক্তির সাথে লড়াই করেই ইরানীরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে শক্তির বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলেছে। এই ফেব্রæয়ারীতে ইরানের বিপ্লব ৪০ বছরে পদার্পণ করছে। ইরাক, আফগানিস্তান,লিবিয়া ও সিরিয়ার পর ইরানই হচ্ছে পশ্চিমা রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনার চুড়ান্ত টার্গেট। পশ্চিমা জায়নবাদি ষড়যন্ত্রে ইরানের বিপ্লব ব্যর্থ হলে জেরুজালেম ও আল আকসা পুনরুদ্ধারসহ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনাই সবচে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইরান


আরও
আরও পড়ুন