ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
সত্য-মিথ্যার দ্ব›েদ্বর ইতিহাস অতি পুরানো। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে সত্য তার আপন মহিমায় অন্যায়-অবিচার জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্ভাসিত হয়েছে। মিথ্যা সত্যের আলোকে নিভিয়ে ক্ষণিকের জয় পেলেও পরাজয়ের গ্লানি হতে মুক্তি পায়নি, এটাও ইতিহাসে প্রমাণিত। তারপরেও মজলুম মানুষের আর্তনাদে আসমান জমিন প্রকম্পিত। সর্বত্র জালিমের দাপট আর হুংকারে মানবতা আজ ভূলন্ঠিত। ফিলিস্তিনের নিরীহ মুসলমানের উপর আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর জুলুম নির্যাতনের নিষ্ঠুরতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। উগ্র ইহুদিরা একজোট হয়ে নিরীহ শান্তিকামী মুসলমানদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করলেও একশ্রেণির মুসলিম শাসক টু-শব্দটিও করছে না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? মানবতা আজ মর্মান্তিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার। কিন্তু এ জুলুম একদিন অবশ্যই শেষ হবে। মজলুমের আর্তনাদ ব্যর্থ হবে না। তাদেরকে মহান আরশের মালিক অবশ্যই সাহায্য করবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে নবী জালেমরা আজ যা করছে সে সম্পর্কে আপনি আল্লাহকে উদাসীন মনে করবেন না; বরং তিনি তাদের সেদিন পর্যন্ত ঢিল দিচ্ছেন, যেদিন সবার চক্ষু শাস্তির ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে বিস্ফোরিত হবে (সূরা ইবরাহিম: ৪২)। মজলুম মানুষের ফরিয়াদ আল্লাহ কবুল করেন। এছাড়া কারও প্রতি জুলুম করা হাদিসের পরিভাষায় কবিরা গোনাহ। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, তুমি মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা তার ফরিয়াদের মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না (বোখারি ২২৮৬)।
মানব ইতিহাসে যদি কোনো গোষ্ঠীর ওপর জুলুম হয়ে থাকে তাহলে সেটা হয়েছে ফিলিস্তিনীর নিরীহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে, যার নজির সমকালীন ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির কার্যক্রমকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় না। ইতিহাস সাক্ষী, ইহুদিরা অদ্যাবধি প্রায় ৪০ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে নিজ ঘর থেকে বিতাড়িত করেছে। মসজিদুল হারাম শরীফে ইহুদিরা বহুবার হামলা করেও ক্ষান্ত হতে পারেনি বিধায় ১৯৬৯ সালে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। একটি অবৈধ দখলদারিত্ব ব্যতীত আর কোন ভিত্তি যে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের নেই, তারাই আজ মধ্যপ্রাচ্য তথা সারা বিশ্বের সকল অশান্তির বীজ রোপন করেছে। ইসরাইলের অনুসারীদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে, তারা মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করেই পৃথিবীর বিভিন্ন পরিমন্ডলে আধিপত্য বিস্তার করেছে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা শত বছর ধরে ফিলিস্তিনের উপর নারকীয় হামলা চালিয়ে গেলেও বিশ্বশান্তির ফেরিওয়ালা ইঙ্গ-মার্কিনির মুখ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সমগ্র জেরুজালেম নগরীকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মার্কিনী দূতাবাস ইসরাইলের বর্তমান রাজধানী তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার সুনামি হলেও ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। ক্ষমতার এক বছর পূর্ণ করার আগেই ট্রাম্প এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যা তাঁর পূর্বের কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট করেননি। গোটা মুসলিম বিশ্ব, ইউরোপ, এমনকি ইসরাইল ছাড়াও খোদ খ্রিস্টান সম্প্রদায় সবাই ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছেন। আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশও এখন পর্যন্ত মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়নি। এমনকি ইসরাইলের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৬টি দেশ ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি রাশিয়া এবং উদীয়মান পরাশক্তি চীনও জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিন্ধান্তকে সমর্থন জানায়নি। তারপরও আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের লজ্জা হয়নি।
মহান আরশের অধিপতির কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া যে, জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনে সত্যেয় জয় হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের স্বীকৃতি নাকচ করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি বৈঠকে অনুষ্ঠিত ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণাকে বাতিল ও প্রত্যাখ্যান করে রেজ্যুলেশন পাস হয়েছে। ঐ রেজ্যুলেশন পাস হওয়ায় ফিলিস্তিনের পক্ষাবলম্বনকারী দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আধুনিক তুরস্কের রূপকার মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ের স্পন্দন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। রাশিয়া বলেছে, এটা আমেরিকার জন্য বড় পরাজয়। তবে মার্কিন প্রশাসন এখন কী পদক্ষেপ নেয় তা দেখার জন্য বিশ্ববাসীকে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করা লাগতে পারে। ট্রাম্পের প্রস্তাব বাতিল চেয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ১২৮টি দেশ ভোট দিয়েছে। বিপরীতে ট্রাম্পের প্রস্তাবের পক্ষে মাত্র ৯টি দেশ ভোট দিয়েছে। ভোটদান থেকে ৩৫টি দেশ বিরত ছিল। আর অনুপস্থিত ছিল ২১ দেশের প্রতিনিধিগণ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে তুমুল নিন্দা ও প্রতিবাদ জারি রয়েছে। সাধারণ পরিষদ বৈঠক শুরুর আগে ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, প্রস্তাবের পক্ষে যেসব দেশ ভোট দেবে তাদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, যারা লাখ লাখ কোটি কোটি ডলার আমাদের নিকট থেকে সাহায্য নিচ্ছে তারা কীভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ভোট দিতে যাচ্ছে? কারা এ ভোট দেয় তা আমরা দেখব। এমনকি সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটির আগে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিকি হ্যালি বলেন, এখানে ‘না’ ভোট দেয়া হলেও তার কোনো মানে নেই। তবে দিনটি যুক্তরাষ্ট্র মনে রাখবে, জাতিসংঘে যারা যুক্তরাষ্ট্রকে হেনস্তা করে, তাদের মনে রাখবে। শুধু কি তাই? সাহায্য বন্ধে মার্কিন হুমকির তোয়াক্কা না করে ওইসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষেভোট দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের প্রায় সবাইকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছিল। ট্রাম্পের এই হুমকি কার্যত মেনে নেয়নি আন্তর্জাতিক বিশ্ব। অন্যদিকে ইসরাইল অত্যন্ত উদ্ধত মনোভাব প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত বলেন, সাধারণ পরিষদের কোনো প্রস্তাবই আমাদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করতে পারবে না। এর আগে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, জাতিসংঘ স্বীকার করুক বা না করুক, জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী। যুক্তরাষ্ট্রের এত হুমকি-ধমকি সত্ত্বেও ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পক্ষে যারা সৎ সাহস দেখিয়েছে তারা সত্যিই মানবতার বিজয়ের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটির এত দুঃসাহস হতো না মুসলমানদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত করার। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও জেরুজালেম প্রশ্নে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই পারত ইসরাইলকে থামাতে। কিন্তু তা না করে উল্টো দেশটি একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা অন্যায় ও অযৌক্তিক। জেরুজালেম নিয়ে মার্কিন ঘোষণার শুরুতেই উদ্বেগ উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছিল চীন। এমনকি পোপ ফ্রান্সিসও জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুসারে জেরুজালেমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের কোন দেশ এর আগে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেয়নি। সবার দূতাবাস তেল আবিবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এই সিদ্ধান্তে কার্যত আর কোন দ্বিতীয় দেশ সাড়া দেয়নি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হটকারী সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে শুধু ব্যাহতই করবে না, ওই অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতার জন্ম দেবে। এমনটি অনুমান করেই ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক ও সৌদি আরবসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্ররাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বারণ করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প কারও কথায় কর্ণপাত না করে উল্টো ইসরাইলকে খুশি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোন বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। অথচ বিশ্বযুদ্ধ না হলেও বিশ্বে শান্তি আসেনি। বরং পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে যুদ্ধ বাঁধিয়ে আমেরিকা তার আন্তর্জাতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৭৩ সালের পর আর কোনো আরব-ইসরাইল যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং ইসরাইলি দখলদারদের নির্মম নির্যাতন বেড়েই চলেছে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য না থাকার কারণে ইহুদিবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে কোনো এজেন্ডা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও তার তথাকথিত দোসরা মুসলমানদের ঐক্য যাতে না হয় সে জন্য ষড়যন্ত্রের ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে। মহান আরশের মালিকের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন সারা বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের ইহুদিদের নির্মম নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে জাতিসংঘের রেজ্যুলেশনের সিদ্ধান্তে আর যাই হোক সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।