পৃথিবীর এক ঘৃণ্য তথাকথিত রাষ্ট্রের নাম ইসরাইল। হিটলারের কাছ থেকে নিপীড়িত হয়ে ১৯৩৩ সালে ইহুদিরা পালিয়ে ফিলিস্তিনে আসে। পরজীবীর বিশ্বাসঘাতকতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই জাতি। যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেই জাতির বিরুদ্ধে চালাচ্ছে নিদারুন নির্যাতন।
ফিলিস্তিনির পক্ষে আওয়াজে, শ্লোগানে বিশ্বের মুসলমান ভাইয়েরা থাকলেও, কাগজে কলমে নেই। যে কারণে হয়তো ইসরাইলের কোনও কাজ না থাকলেই গিয়ে বিমান হামলা চালিয়ে আসে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, রোজার সময় এটা বেড়ে যায়।
ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী ,গত ৪০ ঘন্টায় ১০৪৫ খানা রকেট ছুড়েছে হামাস এবং ইসরাইলের বিখ্যাত Iron Dome মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম রীতিমত ওভারলোডেড হয়ে গিয়েছে সেগুলো সামলাতে গিয়ে। ব্যাপারটা কিন্তু কিছুটা অভুতপূর্ব। আগেও হামাস রকেট ছুড়তো অল্প সল্প কিন্তু এই পরিমাণে কল্পনারও বাইরে। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসিন মারা গেলেও ডজন খানেক রকেট ছুড়েছে। কিন্তু এর বেশি সক্ষমতা কখনোই ছিল না। বিশেষ করে চল্লিশ ঘন্টায় ১০৪৫! এটা কল্পনার বাইরে।
কারণ কিছু বিষয় হিসেবে নিয়ে এরপর আমরা চিন্তা করি । গাজা স্ট্রিপ মাত্র ৪১ কিমি লম্বা আর ৬ থেকে ১২ কিমি চওড়া, আয়তন সব মিলিয়ে ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার যা বাংলাদেশের গাজীপুরের চেয়ে কিছুটা বড়। ইসরাইলের Merkava Tank এক ঘন্টারও কম সময়ে গাজার এ মাথা থেকে ও মাথা যেতে পারে। এই সামান্য জায়গা আর দুই পাশে ইসরাইলি সীমানা। আরেক পাশে সাগর, যেটাতে ব্লকেড দিয়ে রাখা হয়। আর আরেক পাশে মিশরীয় বর্ডার যেখানে মিশর রীতিমত কাটাতাড়ের দেয়াল তুলে দিয়েছে যাতে কোনো মানুষ গাজা থেকে মিশরে ঢুকতে না পারে। অর্থাৎ রীতিমত জেলখানা।
এতকিছুর ভেতরেও হামাস এতো বিশাল অস্ত্রের মজুদ হঠাৎ বানিয়ে ফেললো ব্যাপারটা নিয়ে ইসরাইলি সরকার সম্ভবত ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী Shin bet এর পরিচালক'দের প্রশ্নের মুখোমুখি করবে। এটা ইসরাইলিদের জন্য অবশ্যই গোয়েন্দা ব্যর্থতা।
অবশ্য কাতারের আল জাজিরা টেলিভিশন ছয় মাস আগেই একটা ডকুমেন্টরি ছবি বানিয়েছিলো। সেখানে এরুপ অস্ত্র মজুদ ও সংগ্রহের বিষয়ে ভিডিও প্রতিবেদন পর্যন্ত ছিল। তো সেসব সত্য কিছুটা প্রমানিত হয়ে গেল । লিঙ্কটি দেয়া হলো - https://www.youtube.com/watch?v=od0KzQN4TpQ&t=1529s
মুলত ,সাপ্লাই ও লজিস্টিক এসেছে ইরান থেকে। চোরাই পথে। এতো নজরদারির ভেতরেও এই কাজটি কিভাবে করেছে, ডকুমেন্টরিতে কিছু ভিডিও আলামতও আছে। এছাড়া, পানির মোটা পাইপ কেটে সেগুলোরে রকেট বানিয়ে ফেলেছে ইমপ্রোভাইজ করে। হামাস অবশ্য ইরানের হেল্প নেয়ার ব্যাপারটা কখনোই অস্বীকার করে না।
একটা বিষয়ই কিন্ত বোধগম্য না। যে জিনিস ছয় মাস আগে আল জাজিরা ডকুমেন্টরিতে দেখিয়ে দিলো, সেই জিনিস ইসরাইলের দুইখানা কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনী Shin bet আর মোসাদ জানবে না, এটা তো হতেই পারে না। যাই হোক। পশ্চিমা মিডিয়া দেখলে বোঝাই যাচ্ছে, এখন ইরানকে টার্গেট করে নিউজ প্রচার করা হচ্ছে।
এদিকে ফক্স নিউজ দেখলে মনে হবে, হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইল প্রায় শেষ হবার পথে ।কিভাবে ইসরাইলিদের ভিক্টিম হিসেবে দেখিয়ে সেন্টিমেন্ট বাড়াতে হয়, ফক্স নিউজ দেখলে বোঝা যায়। ইসরাইলিরা যে F-16 বোমারু বিমান দিয়ে সব তছনছ করে দিচ্ছে, সেইটা দেখালেও এমনভাবে দেখাবে, যেন কিছু তেমন হয়নি।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি দেখলাম সাংবাদিকদের বলছেন, De-escalation এর জন্য বাইডেন প্রশাসন ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইনের সাথে কথা বলছে। এখন প্রশ্ন হল, কোন প্যালেস্টাইনি? ফাতাহ? ফাতাহ কন্ট্রোল করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর হামাস কন্ট্রোল করে গাজা স্ট্রিপ। হামাস আমেরিকার চোখে ঠিক হিজবুল্লাহর মতই একটা সংগঠন। তাই হামাসের সাথে কথা বলবে না তারা। ওদিকে শুধু মানুষকে বুঝ দেবার জন্য বলতেছে, প্যালেস্টাইনিদের সাথে কথা বলতেছি।
তবে, End game is easily predictable! এখন হয়ত ইসরাইল পশ্চিমাদের কাছে বলবে, দেখুন, গাজায় কি পরিমাণ রকেট আছে। এই রকেট উদ্ধার করতে হলে গাজায় ফুল স্কেল গ্রাউন্ডফোর্স নামাতে হবে। ট্যাঙ্ক নামাতে হবে
ইত্যাদি ইত্যাদি। বাইডেন প্রশাসন ও বলবে, ঠিক ঠিক। এরপর গ্রাউন্ড ফোর্স নামাবে। তবে, প্যালেস্টাইনের জন্য যদি কেউকিছু সত্যিকার অর্থে করতে পারতো, সেটা মিশর। সেই মিশর এখন নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। রোহিঙ্গাদের যেমন মিয়ানমার রাখাইন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে জায়গা খালি করেছে, ইসরাইল গাজাতে তেমন করলে মিশর রিফিউজিও এখন আর ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ।আমরা তো তাও ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা ঢুকতে দিয়েছি চাপে পড়ে।
এছাড়া, গাজা স্ট্রিপে ২০ লক্ষ মানুষ থাকে। ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। বাংলাদেশের গাজীপুর মেট্রো এরিয়ার চেয়ে কিছুটা বড়। মিশর সাহায্য করা তো দুরে থাক, বর্ডারে দেয়াল তুলে দিছে। বহুকিছু করেছে যাতে টানেল কেটেও গাজা থেকে মানুষ মিশরে ঢুকতে না পারে। আর এসব armed struggle করতে গেলে নিকটবর্তী শক্তিশালি দেশের ব্যাকিং + সেল্টার দুইটাই লাগে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক ভাল পলিটিক্যাল লবিং চালানো লাগে। প্যালেস্টাইনীদের আগে যতটুকু এসব ছিল, দিনকে দিন আরো কমতেছে। যেমন এবারের ঘটনাতে ইসরাইলিরা পশ্চিমাতে এটা বোঝাতে সক্ষম হবে যে হামাস ইরানের কাছ থেকে এসব অস্ত্রসস্ত্র পাচ্ছে। তাই কোনোকিছুতে ইরানকে জড়ানো মানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য আরব দেশগুলোরে জুজু দেখানো।
ফিলিস্তিন বললে আমাদের সামনে ভেসে আসে দুটি ছবি।
১. ইয়াসির আরাফাত এবং ২. রক্তাক্ত মানুষের মুখ।
আজ, ইয়াসির আরাফাত বেঁচে নেই। তিনি মারা গেছেন একেবারে। মানুষগুলো বেঁচে আছে। বারবার মরার জন্য। তথাকথিত ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের আঘাতে বছরের পর বছর মরছে তারা।
এই জাতি নিজেদের অবস্থানগত জায়গা পৃথিবীর বুকে এতো সংহত করে ফেলেছে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নাই। এমন কী আরব রাষ্ট্রগুলোর বন্ধুত্বও চোখে পড়বার মতো।ফিলিস্তিনিদের জন্য আমাদের আসলে কিছু করার নেই। দুঃখ পাওয়া ছাড়া। দোয়া করা ছাড়া। মিছিলে প্রতিবাদ করা ছাড়া।
ফিলিস্তিনি প্রতিটি ছবি এই পৃথিবীর জন্য, এই সময়কালে মানবতার জন্য লজ্জার। ট্যাংকের সামনে যে তরুণ বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায়, যে মানুষ হুইল চেয়ারে বসে বিমান হামলার বিপরীতে ঢিল ছোড়ে, যে কিশোর আধুনিক রাইফেলের সামনে তার গুলতি নিয়ে তাক করে তারা শুধু ইসরাইলের দিকে এসব তাক করে না, পৃথিবীর মানবতাবাদী দুই শতাধিক রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, আমরা বছরের পর বছর নিজেরাই নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে গেলাম। আর তোমাদের মানবতাবিষয়ক সেমিনার চালিয়ে গেলে। পৃথিবীর বুকে ফিলিস্তিনিদের রক্ত দিয়ে মানবতার যে মূল প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে সেটা একদিন এই পৃথিবীর উত্তর প্রজন্ম পড়বে এবং হাসবে। কত ভীতু কাপুরুষের ভরা ছিলো একেকটি রাষ্ট্র।
তাই আমরা দোয়া করি যেন আল্লাহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহায় হোন।
লেখক-মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ৪৭তম ব্যাচ, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি।