Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ওমর আলী মা মাটি বাঙলার বাউল ...

সাইফুদ্দিন সাইফুল

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশপ্রেম মানবপ্রেম প্রকৃতিপ্রেমের পাশাপাশি মহান ভাষা-আন্দোলন ও স্বাধীনতার পক্ষে অজস্র সুন্দর সুন্দর মহান কবিতা লিখে যিনি আজ বাঙালী পাঠক সমাজে বাঙলা কাব্যজগতে ও সাধারণ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের হৃদকুঠিরে নিজেকে অনেক বড়ো জায়গা করে নিয়েছেন তিনি আর আমাদের অপরিচিত কেউ নয়, আমাদের অতিব আপনজন কাছের মানুষ মা মাটি বাঙলার বাউল কবি ওমর আলী। যদিও অনেক দেরি করে দিলেও (মরণোত্তর) একুশে পদকে (২০১৭) ভূষিত করে চির মা মাটির সাথে মিশে থাকা প্রিয় এই কবিকে দেশ রাষ্ট্র জাতি যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন। একথা ঠিক যে, কোনো পুরস্কার বা পদক মেধা প্রতিভা সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ণ করার অবশ্যই চাবিকাঠি না তবুও একজন কবির জন্যে এটা কম কিসের। গুনিজনকে সম্মান দেখানোটাও একটা সম্মানের কাজ। 

কবি ওমর আলীর কবিতায় সমকালের আধুনিকতার চেতনার ইতিহাস ঐতিহ্য ও জীবনবোধের মহান শিল্পের এবং আগামীর স্বপ্নের যে আবেদন সুর ছোঁয়া পাওয়া যায় তা নতুনত্বের নবধারার নবসৃষ্টির অন্য এক ভিন্নতর জগৎ কথা ঢেউ ছন্দ ভাষা ভাব আলাদা রঙে ঢঙে রূপে আঙ্গিকে সতত দেখতে পাওয়া যায়। তার কবিতায় গ্রাম মায়ের সুরেলা সুর ফুটে উঠেছে। যদিও সাহিত্যে আধুনিকতা অনাধুনিকতা বলে আদৌ কিছু আছে কিনা তা অনেক আলোচনার বিষয়। এছাড়া তার কবিতায় মূর্ত বিমূর্ত ইত্যাদি শিল্প-নান্দনিক বিষয়ক কবিকে অনেক ক্ষেত্রে জীবন প্রকৃতি মাটির কবি সত্বেও তাকে একজন বিপ্লবী বিদ্রোহী করে তুলেছে। তিনি তার বৈচিত্রময় সৃষ্টিশীলতার অবস্থান থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ভিন্নতর ভবের মননশীল কবি। আর তাই ষাট দশকের কবি ওমর আলীর হাত ধরেই আজকের বাঙলা কবিতা পেয়েছে নতুন এক পথের ঠিকানা। তরুন প্রতিভাবান চিত্রপরিচালক দেওয়ান বাদল কবি ওমর আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- ‘‘কবি ওমর আলী দলনিরপেক্ষ এবং খুবই একজন সাদামাটা মানুষ। তার ভেতরে নেই কোনো ইজম প্রবণতা লেখা প্রকাশই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। তাইতো যে কোনো পত্র-পত্রিকায় নির্দ্ধিধায় লিখতেন তিনি। তার কবিতার মূল উপজীব্য নারী নিঃস্বর্গ ও দেশপ্রেম। এসব বিষয় নিয়ে জীবনানন্দ দাস, জসীমউদ্দিন ও বন্দে আলী মিয়াও কবিতা লিখেছেন; তবে বিষয় এক হলেও তাদের থেকে ওমর আলীর কবিতার আঙ্গিক উপমা প্রয়োগে ভিন্নতার পরিচয় পাওয়া যায়।’’
পাশাপাশি ওমর আলীর কবিতায় একদিকে যেমন- গ্রীক পুরাণ, মুসলিম পুরাণ, রোমান পুরাণ ও ভারতীয় পুরাণের ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়; তেমনি আবার আরবের রূপকাহিনী আলিফ লায়লার গল্পগাথা, হাসির রাজা গোপাল ভাড়ের গল্প এবং শিক্ষামূলক ঈশপের গল্পের ইত্যাদির প্রভাব কিংবা উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়া ওমর আলীর কবিতায় আবহমান বাঙলার হাজার বছরের লোকজ গ্রামীণ সংস্কৃতি লোককাহিনী রূপকথার ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপমা উপাদানের ব্যবহার অত্যান্ত দক্ষতার সহিত স্থান পেয়েছে। আর এব্যাপারে ড. আশরাফ পিন্টু সঠিক মূল্যায়ন করেছেন এভাবে যে- ‘‘ওমর আলী জীবনবাস্তবতাকে সুনিপুনভাবে রূপায়িত করেছেন তার কবিতায়। তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে আবহমান বাঙলার শাশ্বত রূপ নারী ও নিসর্গের পাশাপাশি লোকজ-ঐতিহ্যের চেতনা। লোক ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান প্রবাদ ও বাগধারার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধরা পড়েছে তার কবিতায়....।’’ এছাড়া ওমর আলীর কবিতায় মা মাটি বাঙলার খেটে খাওয়া অতিব সাধারণ আমজনতার একান্তে মুখের কথাকে ভাষাকে ভাবকে এবং বিশ্বাসকে কবিতার পরতে পরতে সাবলিলভাবে নান্দনিকতার পরশের ছোয়ায় শব্দে শব্দে উঠে এসেছে এভাবে.....
‘‘লোকটা সুতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’’
একথা আর বলার অপেক্ষা থাকে না যে, কবি ওমর আলী তিনি নারীকে মায়ের সাথে মাকে দেশের সাথে কতোটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে কবিতার পঙক্তিকে প্রশংসা মূলক কথা দিয়ে নারী জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। গ্রাম বাঙলার স্বপ্ন দেখা মায়া মমতা ¯েœহ পরায়না নারী স্বামী সংসার সন্তানের প্রতি প্রেম ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা কোনো মমতাময়ী মা নারীর হাসিমাখা সুন্দর নিস্পাপ নির্লভ মুখ কবি তার কবিতায় শব্দে শব্দে পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছন্দের ঢেউয়ে নির্মলভাবে তুলে ধরেছেন। আর এসব চরিত্রের অধিকারী নারীদের তিনি তাই কতো সহজে আইভি লতার সাথে এক করে দেখেছেন। এখানেই কবি ওমর আলী একজন স্বার্থক ও অনন্য কবি। এই জগত সংসারে নারী কখনো মাতা, কন্যা, ভগ্নি, প্রিয়তমা আবার নারী কখনো পূর্ণিমা, মাতৃভূমি সমতূল্য আর প্রকৃতিরূপ ইত্যাদি। এমনি করেই কবি ওমর আলী তার কবিতায় নারীদের স্বপক্ষে প্রশংসায় বলে উঠেছেন.....
‘‘এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসিমাখা;
সে নাকি ¯œানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেনো পটে আঁকা.......।’’
‘আমি কিন্তু যামুগা’ এই কবিতাটি ওমর আলীর আরও অনেক সেরা সৃষ্টি কবিতার মধ্যে একটি এবং অন্যতম। তবে যে বিষয়টি অবাক করার মতো তাহলো, এই কবিতাটি কবি তিনি তার এক প্রিয় বন্ধুর অনুরোধে লিখেছিলেন। এখানে তার এক বন্ধুর বিবাহের পরবর্তী জীবনে অর্থাৎ নবদম্পত্তির সাংসারিক জীবনের যতো মধুর সংলাপই এই কবিতায় ফুটে উঠেছে এবং তা ভাষার শব্দে ছন্দে রঙে নতুনত্বের রূপ পেয়েছে। অথচ বন্ধুর অনুরোধে লেখা আজ এই কবিতাটিই বিখ্যাত হয়ে গেছে। আসলে প্রকৃত শিল্পকর্ম সৃষ্টিরূপ একদিন কালকে জগতকে সমাজকে নিজের করে প্রকাশ হয়। কবি তার ‘আমি কিন্তু যামুগা’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-
‘‘আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হু, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতোই কও তোতা পাখি, চান, মনি সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো....।’’
চলমান পাতা-০১
কবিতা শুধু কবিতা নয়! কবিতা একমাত্র শিল্পের প্রকাশ নয়। কবিতা মানে অনেককিছু। কবিতা আকাশের মতো উদার, সাগরের মতো বিশাল আরো কতো কি। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে কবিতার জন্ম হয়। কেননা, কবিতা জীবন সংসারের কথা বলে, স্বপ্নের কথা বলে, বিশ্বাসের কথা বলে, দেশপ্রেমের কথা বলে, মানবতার কথা বলে, মানবপ্রেমের কথা বলে, প্রকৃতির কথা বলে, সুন্দরের কথা বলে, ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে, চেতনার কথা বলে, জাতীয়তাবাদের কথা বলে সর্বপরি কবিতা ছন্দ সুর ভাষা ভাব আক্ষরিকার্থে নান্দনিক শিল্পের কারুকার্যময়তার কথা দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করে। কবি ওমর আলীর কবিতা এসব চিত্রকল্প উপমা স্বগর্বে বহন করে চলেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, কবি ওমর আলীর কবিতায় ভাষা-আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সচেতনভাবে বার বার উঠে এসেছে। ভাষা শহীদদের প্রতি তার আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা এতোটুকু ঘাটতি নেই। যদিও বয়সের তুলনায় তিনি ভাষা-আন্দোলনের সময়ে অষ্টম শ্রেণীর একজন ছাত্র ছিলেন, আর তাই বায়ান্নতে বাঙলা ভাষার দাবীতে আন্দোলনে মিছিলে সভাতে যোগ দেওয়া তার জন্যে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে শহীদ হওয়ার তীব্র আকাঙ্খা তার হৃদমাঝারে একান্তে রয়ে গেছে। তিনি তার ‘‘শহীদ হতে পারতাম’’ কবিতায় আপন আকাঙ্খা এভাবে তুলে ধরেছেন......
‘‘ আমিও শহীদ হতে পারতাম যদি বায়ান্ন সালে / আমার বয়স চার বছর বেশি হতো আমি
তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি আমার কপালে / জোটেনি কলেজে পড়া হয়নি ছাত্র অতো দামী
হয়তো মিছিলে যোগ দিতাম তুমুল শ্লোগানে / কাঁপিয়ে দিতাম চারদিক বাংলা রাষ্ট্র ভাষা চাই.....।’’ (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাটি


আরও
আরও পড়ুন