হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
তৈমূর আলম খন্দকার : সাংবিধানিক নিয়মে আগামী ২০১৮ সাল হবে নির্বাচনী (জাতীয় নির্বাচন) বছর। রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের বিগত নির্বাচনী অভিজ্ঞতা সূখকর নয়। হোন্ডা, গুন্ডা, আর অর্থের প্রভাবে জনগণের আশা আখাঙ্খার প্রতিফলন বিগত নির্বাচনগুলিতে না হওয়ায় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবী উঠে; আওয়ামী লীগ, জামাতে ইসলাম এবং বামদের যুগপৎ আন্দোলনে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করে।
নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে দেশের দুটি প্রধান দল অর্থাৎ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পর্যাক্রমে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ২০০৭ সালের ২২শে ফেব্রæয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন ভেস্তে যায় নিন্মবর্ণিত কারণে
ক) সংবিধান মোতাবেক প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে বিচারপতি কে.এম. হাসানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অনাস্থাসহ তীব্র প্রতিবাদ এবং লগি বৈঠার তান্ডবসহ পথচারীকে দিগম্বর করার মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নেয়ার পরোক্ষ আমন্ত্রণ।
খ) অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের মত ব্যক্তিত্বহীন ও অদূরদর্শী রাষ্ট্রপতি, যিনি শেষব্দি সাংবিধানিক ভাবেই নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়ে ছিলেন।
গ) আনুষ্ঠানিকভাবে সিভিল সোসাইটির ছাদ্মরনে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ যা ১/১১ সরকার নামে বহুল প্রচারিত।
১/১১ সরকার গঠিত হওয়ার পর তারা জাতীয় নির্বাচন দেয়ার পরিবর্তে দেশকে রাজনীতি শূন্য করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়ে রাজনীতিবিদদের (দুই নেত্রীসহ) জেলখানায় অবরুদ্ধ রেখে দূর্ণীতি দমন কমিশন দিয়ে সিরিজ মামলায় জড়িত করে। ২০০৪ সালের কমিশন আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী দূদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হলেও একে একটি টাক্সফোর্স। এই টাক্সফোর্সের মাধ্যমে উচ্চবিলাসী সেনা কর্মকর্তারা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য “দূর্নীতিবাজ” শিরোনামে ২২২ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এর মধ্যে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনাসহ উভয় দলের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি ক্ষতিনামা ব্যবসায়ীদের নাম ছিল। কিন্তু মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের “দূর্নীতিবাজ” তালিকা থেকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রাজনীতিবিদদের আটক রেখে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে উচ্চবিলাসী সেনা অফিসারদের সমর্থনে একটি রাজণৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় যা কওঘএ চঅজঞণ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ড. ইউনুস, ড. কামাল, ড. ফেরদৌস আহামদ কোরেশীসহ আওয়ামী ও বিএনপি’র অনেক এম.পি/মন্ত্রী কওঘএ চঅজঞণ কে সংগঠিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে ট্রাক্সফোর্স তথা দুদকের মামলা থেকে বেচে যায়। মামলা থেকে বাঁচাই ছিল তখন প্রধান টার্গেট, পাশাপাশী কওঘএ চঅজঞণ এর বদৌলতে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু বাধ আসে জনগণ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী। যারা সেনা সমর্থিত সরকারকে সমর্থন করে ছিল তাদেরকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নাম দিয়েছিল “সংস্কারবাদী”। এই সংস্কারবাদীদের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জুতা পেটা করেছে ফলে কওঘএ চঅজঞণ গঠনের পক্রিয়া ঝখঙড গঙঞওঙঘ এ থেমে যায়। বর্তমানে সেই সংস্কারবাদীরা স্বস্ব অবস্থান ও মর্যাদা নিজ নিজ রাজনৈতিক দলে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু টাক্স ফোর্সের রিমান্ড ও দীর্ঘদিন যারা কারারুদ্ধ ছিল, তাদের কষ্ঠের দাগ মন থেকে মূছে যায় নি।
সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে, “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকর তাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।” “প্রত্যক্ষ নির্বাচন” সংবিধানে থাকলে বাস্তবে জনগণ এ দেখা পায় না। ২০১৪ ইং সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে প্রার্থী ভোটার দেখে নাই, ভোটারাও প্রার্থী দেখে নাই, যা ছিল প্রত্যক্ষ নির্বাচন নয় বরং স্বপ্নের নির্বাচন। মূলত: নির্বাচন হয়ে ছিল নির্বাসন।
শেখ হাসিনা টাক্সফোর্স দ্বারা কারারুদ্দ হলেও তিনিই বলেছিলেন যে, সেনা সরকার যা কিছু করে তার সব কিছুর তিনি বৈধতা দিবেন, এর ধারাবাহিকতায় সেনাদের সাথে আওয়ামী লীগ সমঝোতা করেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ২৮ তারিখের জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা সরকারে এসেই সংবিধান থেকে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের অনুচ্ছেদটি বাতিল করে তার (প্রধানমন্ত্রীর) অধীনে নির্বাচন দেয়ায় সাংবিধানিক সংশোধনী আনয়ন করেন। তখন থেকেই বিএনপি বলে আসছিল যে, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। বাম ও বহু নাটকীয়ভাবে জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধীদল বানিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য ২০ দল চেষ্টা করলেও তা সফল হয় নি। বরং সে মামলার ভারে এখন বিএনপি কঠিন অবস্থা পার করলেও সরকার বিএনপিকে কাংখিতভাবে ধ্বংস করতে পারে নি। সরকারের চলনে, বলনে, কথা-বার্তায় এটা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, বিএনপিই শেখ হাসিনার একমাত্র ‘মাথা ব্যাথা’।
বিএনপি মহাসচিবের ত্রাণ বিতরনের গাড়ী বহরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, দোষী ব্যক্তিদের খুজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু অদ্যবদি কোন গ্রেফতার বা সরকার কোন প্রকার প্রেস নোট জারী করে। অধিকন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকার জাতীয় সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদ বলেছেন যে, এটা বিএনপি’র একটা সাজানো নাটক। হাছান মাহমুদকে বেয়াদব টাইটেল বিএনপি থেকে দেয়া হয় নাই, বরং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেত্রী সরকার দলীয় উপনেতা সাজেদা চৌধুরী উক্ত এম.পি’কে বেয়াদব নামে অখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের বেয়াদব দেশে আরো আছে এবং প্রতি এলাকাতেই আছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এ ধরনের বেয়াদবদের দলের প্রয়োজন হয়; কিন্তু তাদের ভ‚মিকায় দলকে হতে হয় বির্তকিত। হাসান মাহমুদ এখানে মূখ্য বিষয় নয়। বিষয়টি হলো, সরকার প্রধান বা শেখ হাসিনা কি চান এটাই মূখ্য। তিনি যদি মনে করেন তার শাসন আমলে বিএনপি কোথাও গড়াব করতে পারবে না তবে তাই হবে; কারণ আমাদের দেশের প্রশাসন বিবেক দিয়ে চলে না, তাদের দায়িত্ব শুধুমাত্র কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিএনপি’র ইফতার সরকারী দল করতে দিচ্ছে না। কোথাও ১৪৪ ধারা জারী করে বা কোথাও ইফতার সামগ্রী লুট করে সভা পন্ড করে দেয়া হচ্ছে। এগুলি কিসের আলামত? আগামী জাতীয় নির্বাচন সূষ্ঠ হওয়ার জন্য এটাই কি পূর্বাভাস?
রাজনীতি তার নিজস্ব গতিতে চলছে না। কারনে দেশে অবাধ গণতন্ত্রের নামে চলছে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’। বিরোধী দল তাদের কার্যক্রম বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে কতটুকু যেতে পারবে এটাও নির্ভর করে সরকারী সিদ্ধান্তের উপর। গণতন্ত্র যখন নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে তখন সেখানে স্বৈরতন্ত্র বাসা বাধে, ঠিক মৌমাছির চাকের মত যাকে পাহারা দেয় বিষাক্ত হুল ফুটানোর ক্ষমতাসম্পন্ন মৌমাছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার কোন কারণেই ক্ষমতাচ্যুত হতে চায় না। তাই সুষ্ঠ নির্বাচন দেয়ার কথা অবান্তর এবং সুদুরপরাহত।
দেশে নাস্তিকদের প্রভাব, ইসলাম বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, সর্বপেরি ক্ষমতায় টিকে থাকার অনৈতিক কুটকৌশল সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রত্যক্ষ ভোটের কালচার দেশে বিদ্যমান থাকবে কি না বা এর প্রতিষ্ঠা লাভ করবে কিনা তা ঝরমহ ্ ঝরসঃড়স নেগেটিভই প্রতিয়মান হয়। সরকার প্রধান বা সরকার ঘরনার বুদ্দিজীবীরা বুঝতে সক্ষম হয়েছে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটি বির্তকিত নির্বাচন। কিন্তু সরকার পন্থীদের বিভিন্ন ভাষ্যে এটাও পরিষ্কার যে, নির্বাচনে জয়লাভ অর্থাৎ সরকার গঠন করতে না পারলে পাহাড় সম সম্পদের মালিক হয়েও দেশে তারা থাকতে পারবে না। কারণ তাদের নিজ নিজ কর্মই তাদেরকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এ চিন্তা থেকে সরকার দেশে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ নির্বাচন প্রত্যাশা করে না। আর একটি এতরফা নির্বাচনই সরকারের কাম্য। সরকার এমর্মে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যে, সুবিধামত পোষ্টিং ও প্রোমশন দিলে আমলাদের দিয়ে যে কোন কামলাগিরি করানো যায় এবং এ দেশের বুদ্দিজীবী এতোই সস্তা যে তাদের চেহারা এক দুবার প্রধানমন্ত্রীর পাশে টেলিভিশনে দেখালেই তারা খুশী এবং এ খুশীতে হক কথার পরিবর্তে সরকারের যে কোন ধরনের পদলেহন করতে পারলেই তারা বেজায় খুশী।
দোষেগুনে মানুষ। প্রতিটি মানুষেরই একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষ যখন খৈ হারিয়ে ফেলে তখন তার ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন কোন স্বপ্নে বিভোর থাকে তখনই তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতারা পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে এখন ‘খেই’ হারিয়ে ফেলেছেন। তার ক্ষমতায় যেতেই হবে এ মনবাসনায় বিএনপি’কে নিচিহ্ন করার মানসে তারা এখন মাঠে এবং তাদের বক্তৃতায় এ সব বক্তব্যই তুলে ধরছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের ব্যক্তিগত অফিসে পুলিশী তল্লাশি এবং ত্রান বিতরনে যাওয়ার সময় বিএনপি মহা সচিবের গাড়ী বহরে হামলা আওয়ামী লীগের ‘খেই’ হারিয়ে ফেলারই বহি:প্রকাশ; যার গন্তব্যস্থল জাতীয়বিপর্যয় অর্থাৎ আরেকটি ১/১১ সরকার নতুবা জাতীয় নির্বাচনের পরিবর্তে একটি অনাঙ্খাক্ষিত ‘গৃহযুদ্ধ’ (!)
লেখক : কলামিষ্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।