গুলিস্তানের বিস্ফোরণে নিহত ১৬ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে
রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজার এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এ
স্টাফ রিপোর্টার : শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের প্রায় ৪২ দশমিক ২ শতাংশ এখনও বেকার রয়ে গেছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘অবিস্মরণীয়, অমার্জনীয় : রানা প্লাজা’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজায় ভয়াবহ ধসে সেখানে থাকা পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ ১১০০ জনের বেশি প্রাণ হারায়। ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে গুরুতরভাবে আহত ও পঙ্গু হওয়ার পাশাপাশি নিখোঁজ হন অনেকেই। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত এক হাজার ৪০৩ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালায় সংস্থাটি। গবেষণায় ৬০৭ জন মৃত শ্রমিকের পরিবারকেও নমুনা হিসেবে নেয়া হয়। গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন একশনএইডের ব্যবস্থাপক নুজহাত জেবিন।
গবেষণায় দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ আহত শ্রমিক বিভিন্ন চাকরি বা আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে ৪২ দশমিক ২ শতাংশ এখনও বেকার। আহত বেকার এই শ্রমিকদের মধ্যে ২৬ শতাংশ জীবিকার জন্য কোনো পরিকল্পনা করতে পারছেন না। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ওই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পরে কাজে ফেরেন। ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেকার থেকে যান। পরের বছর ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ কাজে ফিরতে পারেন। ২০১৫ সালে কাজে ফেরা শ্রমিকদের হার দাঁড়ায় ৪৪ শতাংশ। এর দুই বছর পর ২০১৭ সালে এই হার হয় ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে ৪২ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক বেকার রয়েছেন।
গবেষণায় বলা হয়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত আহতদের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ শারীরিকভাবে সেরে উঠেছেন। মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে ১২ দশমিক ৪ শতাংশের অবস্থা। ১৩ দশমিক ১ শতাংশের শারীরিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এছাড়া আহতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ মানসিকভাবে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ৩০ দশমিক ৮ শতাংশের মানসিক আঘাত রয়ে গেছে। স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছেন ১২ শতাংশ মানুষ। শারীরিক ও মানসিক এই অবস্থাকে বেকারত্বের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গবেষণার প্রতিবেদন সম্পর্কে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, চার বছর পরও এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যদের চুইয়ে চুইয়ে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি, যা দেয়া হয়েছে তা আর্থিক সহযোগিতা।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ২০১৪ সালে বিদেশি ক্রেতা ও কয়েকটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন হতাহতদের পরিবারকে সহায়তা দিতে চার কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গঠিত ‘ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে’ এক কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান দেয় বিশ্বের বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, যার কিছু অংশ বিতরণও করা হয়েছে। আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী ওই ভবনের চার কারখানা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩১টি প্রতিষ্ঠান পোশাক নিত। তবে পুরো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগ ছিল আহত শ্রমিক ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের।
অনুষ্ঠানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত দুই শ্রমিক তাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে আহত শ্রমিক নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, চিকিৎসার জন্য এখন আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দুর্ঘটনার পর প্রথম ৬-৮ মাস আমাদের কিছু সহযোগিতা করেছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এখন আর আমাদের কেউ খোঁজ নেয় না। আমরা কিছুই না শুধু ভাল চিকিৎসা চাই। আমি আমার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ চাই। অনুকম্পা চাই না। ৫ হাজার অথবা ৫০০ টাকা এবং একটি বিরানীর প্যাকেট আমরা চাই না। আহত অন্য শ্রমিক বাকি বিল্লাহ বলেন, দেড় বছর হাসপাতালে ছিলাম। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কিছুটা সুস্থ হয়ে আমি একটি কারখানায় কাজ নিলাম। তবে শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় তারা আমাকে চাকরিচ্যুত করেছে। আমি এখন কিভাবে চলব?
শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিকরা এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি এটা সত্য ও সঠিক। হাই কোর্ট একটি প্যানেল গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকরা কে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার স্কেল তৈরি করে। কিন্তু এরপর আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এটা কোনোভাবেই ঠিক না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চার বছর পরও দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সময় সম্ভবত আমরা পার করে ফেলেছি। আহত শ্রমিকদের ভেঙে ভেঙে সহযোগিতা করা হয়েছে। যেটা তাদেরও কাজে আসেনি। যে হিসাব করে শ্রমিকদের টাকা দেয়া হয়েছে তা খুবই সমান্য। সমস্যা হলো আহত শ্রমিকদের ক্ষতির পরিমাণ ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সরকার যদি একটি স্বাস্থ্য কার্ডের ব্যবস্থা করে তাহলে আহতরা সেই কার্ড দেখিয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকার হাসপাতালে গিয়ে স্বল্প মূল্যে অথবা বিনামূল্যে চিকিৎসা নিতে পারবেন। ঢাকার বাইরে যারা চলে গেছেন তাদেরও এই কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক টো পোটিয়াইনেন বলেন, অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেখানে মনোসামাজিক সহায়তাও দিতে হবে। সরকারকে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা-পরিদর্শক ড. আনোয়ার উল্লাহ্ বলেন, এটা ঠিক যে দুর্ঘটনার পরে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল এবং আছে। সমস্যা আছে পরিকল্পনায়। আর রানা প্লাজা ক্ষতিগ্রস্তদের যে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কিনা তা চিন্তার বিষয়।
তিনি বলেন, সরকার কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বেশকিছু কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিছু কারখানাকে নোটিস দেয়া হয়েছে। ৬৪টি জেলায় সার্ভিলেইন্স ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার কাজ আমরা শুরু করেছি।
অ্যাকশন এইডের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন উদ্যোগেরও পর্যালোচনা করা হয়েছে এই গবেষণায়; যেখানে দেখা যায়, রানা প্লাজা ‘ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। যার অর্থ দাঁড়ায় সব ধরনের দেনা পরিশোধের কাজ শেষ। যদিও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে হাই কোর্টের দেয়া রায় এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যালায়েন্স ফর ওয়ার্কার্স সেফটির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর পল এলওয়ার্ড রিগবিও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।