Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আলজেরিয়দের গণহত্যার খবর যেভাবে গোপন করে ফ্রান্স

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০২২, ২:২৭ পিএম

১৯৬২ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে আলজেরিয়া স্বাধীন হয়। তার আগে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলার সময় ১৯৬১ সালের ১৭ অক্টোবর প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফরাসি পুলিশ - চালিয়েছিল নির্মম গণহত্যা।

সে সময় ফ্রান্সে আলজেরিয়রা প্রতিদিন ভয়ভীতি, হয়রানি আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আলজেরিয়ান স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলনও চলছে পুরোদমে। সেই পটভূমিতে প্যারিসে শুধু আলজেরিয় মুসলিমদের টার্গেট করে প্রশাসন রাত্রিকালীন কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানাতে ১৭ অক্টোবর ৩০ হাজার ফরাসি আলজেরিয় জড়ো হন প্যারিসের কেন্দ্রে।

ওই সমাবেশের দিনকয়েক আগেই আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামী দল এফএলএন-এর সদস্যদের হাতে নিহত হয় ১১জন ফরাসি পুলিশ। এর জবাবে প্যারিসে শুধুমাত্র আলজেরিয়ান মুসলিমদের ওপরই রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়। আলজেরিয়ায় ১৩০ বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের দাবিতে এফএলএন গোষ্ঠীর লড়াই তখন সাত বছরে পড়েছে। ফ্রন্ট দ্য লিবারেশিওঁ ন্যাশিওনাল বা এফএলএন স্বাধীনতার দাবিতে আলজেরিয়ায় যে আন্দোলন চালাচ্ছিল তার ঢেউ তখন ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডেও পৌঁছে গেছে এবং ফ্রান্সে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু পুলিশ।

কিন্তু প্যারিসে শুধু আলজেরিয়দের টার্গেট করে কারফিউ জারির পর এফএলএন প্যারিসে তাদের আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে। ফ্রান্সের আলজেরিয় পরিবারগুলোকে তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেবার আহ্বান জানায়। তাদের ধারণা ছিল প্রতিবাদে নারী ও শিশুরা অংশ নিলে পুলিশ সহিংসতা বর্জন করবে। ঐতিহাসিক জঁ লুক ইনওডি বলছেন, ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভের আগে থেকেই ফরাসি পুলিশ নিয়মিতভাবে আলজেরিয়দের হত্যা করছিল।

সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে প্রায়ই জঙ্গলে, নদীতে, খালবিলে আলজেরিয়দের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছিল। এরপর সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে আর অক্টোবরেও পুলিশ প্যারিসে আলজেরিয়দের ধরপাকড় করতে থাকে। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো স্যেন নদীর পাড়ে। সেখানে তাদের অজ্ঞান করে, হাত বেঁধে রাতের বেলা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো আর সবসময় সেটা করা হতো রাতের অন্ধকারে।

জঁ লুক ইনওডি অনেক বছর ধরে কী ঘটেছে সেই সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা থেকে তাকে তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়া হয়নি। তারপরেও তিনি ১৯৯১ সালে ওই গণহত্যার ওপর তার একটি বই প্রকাশ করেন। তার বইতে তিনি সেই সময়ের কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিস্তারিত সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। প্রতিবাদ সমাবেশের পরদিন ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানায়, সেদিনের ঘটনায় মারা গেছে দুজন আলজেরিয়। কিন্তু জঁ লুকেই নওডির গবেষণায় বেরিয়ে আসে যে শুধু প্রতিবাদের রাতেই মারা গেছে দুশ' মানুষ। এছাড়াও সমাবেশের আগে ও পরে পুলিশের হাতে প্রাণ হারায় আরও বহু মানুষ।

ঐতিহাসিক ইনওডি বিবিসিকে জানান, ঘটনার দিন প্রতিবাদকারীরা প্যারিসের কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছিল সন্ধ্যেবেলা। "শান্তিপূর্ণ আর ভাবগম্ভীর একটা সমাবেশে যোগ দেবার জন্য তারা বেড়াতে যাবার সুন্দর পোশাকে সেজে এসেছিল। তারপরও পুলিশ তাদের অনেককে আটক করে এবং তাদের সঙ্গে খুবই সহিংস আচরণ করে। কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় আটক কেন্দ্রে," বলেন ইনওডি। এরপরেও বহু পুরুষ, নারী ও শিশু মূল সড়কের ওপর কোনরকম ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল।

"পুলিশ আচমকাই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়, তাদের হত্যা করে। কাছেই আরেকটি সেতুর ওপরেও বিক্ষোভ সমাবেশ করছিল কয়েক হাজার মানুষ। তাদের ওপরেও চলে গুলিবর্ষণ। সেখানে শুরু হয় নদীতে লাশ ফেলার ঘটনা। পুলিশ অনেকগুলো ব্রিজ থেকে বিক্ষোভকারীদের লাশ স্যেন নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।" একটা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রূপ নেয় গণহত্যায়। ধারণা করা হয় পুলিশ অন্তত একশ' প্রতিবাদকারীকে হত্যা করে।

ঘটনাচক্রে এই গণহত্যার হোতা ছিলেন সেসময় প্যারিসের পুলিশ প্রধান মরিস প্যাপঁ। কয়েক দশক পর এই ঘটনার কথা ফ্রান্সের বিচার বিভাগের সামনে তাকেই তুলে ধরতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের ইহুদিদের নাৎসী মৃত্যু শিবিরে পাঠানোর দায়ে প্যাপঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয় ১৯৯৭ সালে। ওই মামলা চলার সময় জঁ লুক ইনওডি সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে ১৯৬১ সালে প্যারিসে আলজেরিয় বংশোদ্ভুতদের গণহত্যার জন্য তিনি মি. প্যাপঁ-র বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ আনেন। মরিস প্যাপঁ ইনওডির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন এবং হেরে যান।

"সাবেক পুলিশ প্রধান মরিস প্যাপঁ আমার বিরুদ্ধে মামলা লড়ে হেরে যান ১৯৯৯ সালে, কারণ আমি সংবাদপত্র লেমঁন্ড-এ লিখেছিলাম প্যাপঁ-র নির্দেশে পুলিশ আলজেরিয় মুসলিমদের ব্যাপকহারে হত্যা করেছিল। সরাসরি জড়িত ছিলেন, এমন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম যাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। "আমি অনেক দলিলপত্র উপস্থাপন করেছিলাম। কৌঁসুলিকে মানতে হয়েছিল যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। গণহত্যা যে সংঘটিত হয়েছিল সেই প্রথম তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হয়," বলেন ঐতিহাসিক জঁ লুক ইনওডি।

উনিশশ নব্বইয়ের দশকের শেষে ফরাসি কর্তৃপক্ষ অবশেষে আলজেরিয় মুসলিমদের ওই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল বলে স্বীকার করে।

কিন্তু এরপরেও তারা বলে যে ঘটনায় মারা গিয়েছিল মাত্র ৪৮ জন। আসলে পুলিশ কতজনকে হত্যা করেছিল তার সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন ওই একদিনে ২০০ থেকে ৩০০ আলজেরিয়কে হত্যা করা হয়। ঐতিহাসিকরা বলেন ১৭ অক্টোবরের সমাবেশের পরের কয়েক দিনে এবং কয়েক সপ্তাহে স্যেন নদীর তীরে ভেসে এসেছিল ১১০টি লাশ। গুলি করে হত্যা করার পর কারও কারও লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

আহতদেরও নদীর ঠাণ্ডা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। নদীতে ডুবে তাদের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন ফাতেমা বেদার। নদীতে ফেলে দেয়া নিহত বহু ফরাসি আলজেরিয়র স্মৃতিতে ২০০১ সালে প্যারিসে স্যেন নদীর ওপর শেন মিশেল ব্রিজে একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়। প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এই গণহত্যার নিন্দা জানান, কিন্তু ফরাসি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই হত্যাযজ্ঞের জন্য কোন দু:খ প্রকাশ তিনি করেননি। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফ্রান্স


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ