Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাবকে ভালোবাসি কেন?

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২২, ১২:০৩ এএম

১৯৮৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ হলে বাবা আমায় মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। একাডেমিক কোনো সার্টিফিকেট আমার বাবার ছিলনা। তবে এলাকার কয়েকশ শিক্ষার্থী বাবার কাছে নিয়মিত লেখাপড়া করতো। সেই সুবাদে বাবাকে অনেকে মাস্টার বলে ডাকতো। ব্যক্তিগত জীবনে আমার বাবা খুব ধার্মিক ও সৎ হিসেবে পরিচিত। সেই সুবাদে আমার মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া। দেশের অধিকাংশ মাদ্রাসা তখন ছিল জরাজীর্ণে ভরপুর। আমার মাদ্রাসাটির অবকাঠামোগত অবস্থান ভালো ছিলনা। তবে লেখাপড়ার মান ছিল অনেক উন্নত। আমার সম্মানিত শিক্ষকগণ মনোমুগ্ধকর পাঠ দান করতেন। তবে আধুনিক ছোয়া থেকে মাদ্রাসাটি ছিল সম্পূর্ণ বঞ্চিত। মাদ্রাসাগুলোতে তখন পত্রিকা রাখা হতোনা। মাদ্রাসায় পত্রিকা রাখা ও পড়া নিষিদ্ধ ছিল। এখনও অনেক মাদ্রাসায় পত্রিকা রাখা হয়না। ১৯৮৯ সালের কথা। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন ও হাদীস পাঠ করে পাশের এক আন্টির বাসায় যেতাম। ঐ আন্টির একটা রেডিও ছিল। আমি প্রতিদিন সকাল ৭টার সংবাদ ও সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠান শুনতাম। এছাড়া সপ্তাহে একদিন ‘রেডিও বাংলাদেশ খুলনা’ কেন্দ্র হতে প্রচারিত হতো রম্য নাটিকা ‘আয়না’। সুরত আলী, ইজ্জত আলী আর ময়নাভাবি প্রণীত এ নাটিকাটি গ্রাম বাংলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল। নিয়মিত শুনতাম এটি। আর শুক্রবারের দিন জুম‘আর নামাজের পর প্রচারিত হতো নাটক। এসব অনুষ্ঠান ছিল মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ। এ অনুষ্ঠানগুলো আমার কাছে ছিল দারুণ উপভোগ্য। কিন্তু মাদ্রাসার পক্ষ থেকে রেডিও থেকে প্রচারিত এসব অনুষ্ঠান শ্রবনে ছিল নিষেধাজ্ঞা। পালিয়ে-লুকিয়ে এবং চুপিসারে এগুলো আমি শুনতাম। এ মাধ্যমিকের সময় থেকেই পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গল্প এবং উপন্যাসের প্রতি একটা ঝোঁক আমার কাজ করতো। ১৯৯০ সালের কথা। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীতে। এক বন্ধু আমায় শরৎচন্দ্রের দত্তা বইটি উপহার দেয়। দুই দিনেই পড়া শেষ করলাম। ভালো করে বুঝি নাই তবুও পড়লাম। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা বইটি এতই ভালো লেগেছিল যে, গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ নোট করে রেখেছিলাম। যা আজও আমার সংরক্ষণে আছে। এছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিবীণা, ইসমাঈল হোসেন সিরাজির অনলপ্রবাহ, মীর মশাররফের বিষাদসিন্ধু, গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত মাধ্যমিকে থাকতেই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সমস্ত মহামনীষীকে জীবনে কোনোদিন দেখিনি। তবে তাদের লেখা তাদেরকে চিনিয়েছে। চিনিয়েছে তাদের ব্যক্তিত্ব, মনুষত্ব, শ্রেষ্টত্ব ও পান্ডিত্য। তাদের লিখনিতে তাদের উদারতা ও উঁচু মানসিকতার প্রস্ফুটন ঘটেছে। প্রকাশিত হয়েছে তাদের মানবিকতা, সাহসিকতা ও জ্ঞানের গভীরতা। তাদের কোনো কোনো লেখা আমার কিশোর হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল। ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর অনলপ্রবাহ আমার রক্তে দ্রোহ জাগিয়েছিল। এ বইটি দেশের ইসলাম ও স্বাধীনতার প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলেছিল। আবেগাপ্লুত মনটিকে ধর্ম আর দেশ রক্ষার এক অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তৈরি করেছিল। এক কথায়, উল্লেখিত লেখকদের লিখনি আমাকে একজন উজ্জীবিত কিশোরে পরিণত করেছিল। পাশাপাশি লিখনির প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে তুলেছিল। মনীষীদের লেখা পড়ে ছোটবেলা থেকেই লেখক হবার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। আর এ আগ্রহের পালে বাতাস দিয়েছিল স্বাধীন দেশে জন্ম নেয়া দ্বিতীয় প্রধান পত্রিকা ‘দৈনিক ইনকিলাব’।

১৯৯২ সালের কথা। তখনও কোনো পত্রিকার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। কারণ আমি জন্মেছিলাম নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার এক অজপাড়া গাঁয়ে। আমার পড়াশুনা ছিল আমার গ্রাম থেকে তিন কিলেমিটার দূরে নিভৃত পল্লীর এক দাখিল মাদ্রাসায়। বিদ্যুৎবিহীন আমাদের পল্লীগুলোতে তখন লেখাপড়া চলতো কেরোসিন চালিত গ্রামীণ কুপি দিয়ে। গ্রামবাংলা থেকে যা আজ একবোরেই হারিয়ে গেছে এবং স্মৃতির পাতাতেই যার অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে।

আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাই গ্রাম থেকে জেলা শহরের মাদ্রাসায়। হঠাৎ করেই চায়ের দোকানে পরিচয় ঘটে ইনকিলাবের সাথে। তখনো পত্রিকা পড়া বুঝতাম না। তখনো পত্রিকার সাথে কোনো পরিচয়ও আমার ছিলনা। একজন চা পানকারীর হাতে পত্রিকাটি দেখে ইনকিলাব নামটা খুব পছন্দ হলো। এগিয়ে গেলাম পত্রিকার কাছে। চা পানকারী আমাকে ভিতরের পেজটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি পড়ছিলাম ‘বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ’। লেখক ছিলেন সাহাদাত হোসেন খান। লেখাটা ভীষণ পছন্দ হলো।

যাহোক এভাবেই দাখিল তথা মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া শেষ করলাম ১৯৯২ সালে। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য গ্রাম ছেড়ে আসলাম অপেক্ষাকৃত শহর এলাকার কামিল মাদ্রাসায়। মন আর চোখটা খুলে গেল আগের তুলনায়। এখানে এসেই দ্বিতীয়বার পরিচয় ঘটে দৈনিক ইনকিলাবের সাথে। মাদ্রাসার অফিস রুমে শোভা পেতো বড়ো অক্ষরে চকচকে লেখা ‘দৈনিক ইনকিলাব’। ইনকিলাব দেখেই মনে পড়ে গেলো ‘বিশ্বময় ইসলামী জাগরণ’ পড়া সেই কলামটি। আরো মনে পড়লো ‘ইনকিলাবের অস্ত্র মোদের লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামের একটি সংগীত। দর্শক ও পাঠক হিসেবে ইনকিলাবের প্রেমে পড়ে গেলাম। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মহোদয়কে দেখতাম, তিনি মনোযোগ সহকারে ইনকিলাব পড়ছেন। অফিস টাইম শেষে তিনি আছরের নামাজান্তে খোলা জায়গায় চেয়ারে বসতেন। হাতে থাকতো ঐ ইনকিলাব পত্রিকা। তিনি পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলাম গভীর মনোযোগের সাথে পড়তেন। ঠিক এ সময় এ পত্রিকার প্রতি আমার গভীর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। কিন্তু পত্রিকা পড়বার সুযোগ আমার হয়নি। এভাবে চলে যায় দুটি বছর। দেখতে দেখতে চলে আসে ১৯৯৪ সন। আলিম পাশ করে এ সনে আমি ভর্তি হই কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিয়মিত ক্লাস শেষে অভ্যাস ছিল লাইব্রেরী ওয়ার্ক করা। প্রথমদিন ক্লাস শেষে যখন লাইব্রেরীতে গেলাম, চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। বাংলা, ইংরেজেী ও আরবীতে লেখা কত বই! জীবনে এত বই কখনও দেখিনি। লাইব্রেরীতে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে দেখি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছে।

আমি সাগ্রহে ওদিকটায় এগিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেক পত্রিকা। দেখলাম সব দৈনিক পত্রিকাই সেখানে রাখা হয়। দীর্ঘ ১৮/১৯ বছর বয়সে নিজ হাতে স্পর্শ করলাম প্রাণের পত্রিকা ‘দৈনিক ইনকিলাব’। দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়লাম পত্রিকাটি। কিন্তু কোনোভাবেই যেন মনের ক্ষুধা নিবৃত হচ্ছিল না। যাহোক এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার পাশাপাশি পত্রিকা পড়ার কাজটি ভালোভাবে চলতো। ভবিষ্যতে লিখবো, এ আশায় ইনকিলাবের গুরুত্বপূর্ণ কলাম কেটে রেখে দিতাম। পুরাতন সুটকেস খুললে আজও হয়ত ১৯৯৪ সালের পেপার কাটিং, নিজের লেখা কিছু কবিতা ও প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে। যাহোক বইয়ের পাশাপাশি পত্রিকার কলাম পড়ার কাজটি চলতে থাকলো সমান তালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ড. মোঃ আব্দুর রব। এ সময় তিনি ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখতেন। দৈনিক ইনকিলাবে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তিনি তার লেখায় বাংলাদেশের প্রতি, ভারত, চীন ও মায়ানমারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। বিশেষত: পার্বত্য চট্রগ্রামের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে প্রায়ই লিখতেন। স্যারের এ লেখা কলাম নিয়মিত পড়তাম। তাঁর এ লিখনি থেকেই প্রিয় মাতৃভূমি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে। আর ইনকিলাবের প্রতি গভীর প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়।

এ বয়স থেকেই পত্রিকার কলাম পড়ার প্রতি আমার ভালো লাগা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে তাদের লেখা বেশী ভালো লাগে যারা নির্মোহভাবে লিখেন। তথ্যপূণর্, যুক্তিপূর্ণ আর অপরের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ লেখাটা আমার বেশী পছন্দ হতো। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও দেশের জন্য যারা লিখেন সেগুলোর প্রতি আমি ছিলাম অধিক যত্নশীল। বাংলাদেেেশর স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মুসলিম উম্মাহর সংকট ও সমাধানের পাথেয় যাদের লেখায় পেতাম সেগুলো পড়তাম আর ও সংরক্ষণ করতাম।

অধ্যাপক আব্দুর রব স্যারের সেই লেখাগুলো আজও আমার স্মৃতিপটে জ্বল জ্বল করে ভাসে। স্যারকে কখনও দেখিনি কিন্তু তাঁর লেখাগুলো আজও মনে পড়ে। শাহাদাত হোসেন খানকেও আমি চিনি না। কিন্তু তাঁর লেখা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি মুসলিম দুনিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে লিখতেন। বিশেষত: ইসলামিক রাজনৈতিক দলের উত্থান বিষয়ে লিখতেন। আরও লিখতেন অমুসলিম বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে। অমুসলিম বিশ্বে ইসলাম প্রচার, মসজিদ নির্মাণ ও মুসলিমদের জাগরণ নিয়ে লিখতেন। তাঁর লিখনি পড়ে চেচনিয়া, বসনিয়া, কসোভা, চীন, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, ভারত ও সুদানসহ সারা দুনিয়ার মুসলমান ও ইসলাম বিষয়ে জ্ঞানার্জন করি। পত্রিকাটিতে আরও লিখতেন ওবায়দুর রহমান খান নদভী, মোবায়েদুর রহমান, শাহ আহমেদ রেজা প্রমূখ। তাদের জন্য রয়েছে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা আর অকৃত্রিম ভক্তি।

ইনকিলাব একটি আরবি শব্দ। শব্দটির অর্থ বিপ্লব। সত্যিকার অর্থে ইনকিলাব তার প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে দেশে বিপ্লব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। আশির দশকের সংবাদপত্রের জগতে ইনকিলাব ছিল দিগন্ত উন্মোচনকারী অনন্য এক পত্রিকা। সাংবাদিকতার জগতে পত্রিকাটি এ সময় এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে। পাঠকের চিন্তা জগতে সৃষ্টি করে নব চেতনার নতুন আলোড়ন। মুসলিম মানসে জাগ্রত হয় জাতীয় চেতনার ঝড়।

১৯০ বছরের ঔপনিবেশক শাসনে শোষিত মুসলিম সমাজ একটি মূর্খ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। অনেকটা ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ। মুখ থুবড়ে পড়েছিল তাদের জাতীয় পরিচয়। স্বজাতীয় চেতনা তারা হারিয়ে বসেছিল। ম্রীয়মান হয়ে গিয়েছিল বাঙালি ও মুসলিম জাতি সত্তা। ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির জায়গায় স্থান পেয়েছিল শিরকের পঙ্কিলতা। বিদেশি সংস্কৃতির নগ্ন থাবায় লোপ পেয়েছিল দেশীয় সংস্কৃতি। বিদেশি সংস্কৃতির ভয়াবহ এ আগ্রাসনের ভিতরেই জন্ম নিয়েছিল ইনকিলাব। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:) ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। মহান এ মনীষী ছিলেন এক দূরদর্শী ধীমান নেতা। তিনি অপসংস্কৃতি রোধ, দেশজ সংস্কৃতির বিকাশ আর ইসলামী সংস্কৃতির প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনকিলাব।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১ হাজার ২৭৭ টি। এর মধ্যে জাতীয় দৈনিক বাংলা পত্রিকার সংখ্যা ২১৮টি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘দৈনিক আল আজাদী’ হলেও সময়ের ব্যবধানে সেটা দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার নাম হলো ‘দৈনিক ইনকিলাব’। প্রকাশের পর অতি দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ইসলাম বিকাশের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। ঘুমন্ত বাঙ্গালী মুসলিম সমাজকে ইনকিলাব জাগিয়ে তোলে। অচেতন ও অবহেলিত আলেম সমাজের কাছে ইনকিলাব নিয়ে আসে ভোরের লাল সূর্য। দেশের আলিয়া মাদ্রাসার উন্নতিতে ইনকিলাবের রয়েছে অসামান্য অবদান। ইনকিলাবপরিবারের নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফসল হলো আজকের ‘ফাজিল ইকিউভেলেন্ট ডিগ্রি’ আর ‘কামিল ইকিউভেলেন্ট মাস্টার্স’। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন জন্ম নেয় বাংলাদেশের বিখ্যাত এ জাতীয় দৈনিক পত্রিকা। জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই ইনকিলাব মিডিয়া জগতে নব চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। প্রতিবেদন প্রকাশে ইনকিলাব মিডিয়া জগতে এক অনন্য পেশাগত দক্ষতার প্রমান দেয়। ১৯৮০-এর দশকে পুরো পৃষ্ঠার ক্রীড়া বিভাগটি চালু করে ইনকিলাব। বিভিন্ন ঘটনার পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রবর্তনে মুন্সিয়ানার ছাপ রাখে এ ইনকিলাব। বৈদেশিক নীতিতে বাংলাদেশ সম্ভাব্য সব আনুকূল্য পেতে করণীয় নির্ধারণে ইনকিলাব সর্বপ্রথম আয়োজন করে এক গোলটেবিল বৈঠক। ইনকিলাব কর্তৃক বিন্যাসিত নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, মহানগর, প্রতিদিন, আন্তর্জাতিক, ইসলামী জীবন, অভ্যন্তরীণ, বিনোদন প্রতিদিন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও খেলাধূলা। মিডিয়া জগতে এ জাতীয় আয়োজনে ইনকিলাবের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। বর্তমান দেশের প্রসিদ্ধ পত্রিকাগুলো তাদের আয়োজন বিন্যাসে অনেক ক্ষেত্রে ইনকিলাবের রীতিকে অনুসরণ করতে দেখা যায়। সেই ক্ষেত্রে ইনকিলাব পত্রিকা যে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে এক অনন্য পথিকৃৎ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। তিনি ছিলেন একাধারে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক নেতা এবং রাজনীতিবিদ। ছিলেন এমপি, মন্ত্রী ও সমাজসংগঠক। তাই মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:) ও ইনকিলাব-পাশাপাশি দুটি মুখপাত্রের নাম।

বর্তমান পৃথিবী ডিজিটাল পৃথিবী। বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। দেশের অসংখ্য সোশ্যাল মিডিয়ার জন্ম হয়েছে। পত্রিকা পাঠের আগ্রহ অনেক কমে গেছে। তথাপিও ইনকিলাব স্বমহিমায় তার সেই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে। নানা চড়াই-উতরাই এবং সংকট মোকাবেলা করে পত্রিকাটি আজ পা রেখেছে ৩৭তম বছরে। অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার কারণে পাঠক ও গ্রাহক সংখ্যা নানা ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তথাপিও ইনকিলাবের অতীত পাঠকগণ তার অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। অতীতের সকল পাঠকের হৃদয়ে ইনকিলাব এখনো ঝড় তোলে। দেশের স্বাধীনতা, ইসলামী মূল্যবোধ এবং বিশ্বময় ইসলাম জাগরণের মুখপাত্র হিসেবে ইনকিলাবের পরিচয় এখনও স্বমহিমায় ভাস্কর; দেশপ্রেমিক তাওহীদী জনতার চেতনায় এখনো ইনকিলাব স্বরুপে দীপ্তমান।

ইনকিলাব দেশের কথা বলে, দেশের স্বাধীনতার কথা বলে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর সাম্যের গান গায় ইনকিলাব। ইনকিলাব ইসলামের কথা বলে, মুসলিম উম্মাহর সংকট নিয়ে সরব থাকে সারাক্ষণ। সংকট সমাধানের প্রয়াসে ইনকিলাব দায়িত্বশীল আচরণ করে। ইনকিলাব তাই আমার কিশোর ও যৌবনের ভালোবাসার পত্রিকা। কৈশোর ও যৌবনে আমি ইনকিলাবকে ভালোবেসেছি। আর বয়সের পড়ন্ত ভাটিতে ইনকিলাব আমাকেও ভালোবেসেছে। বয়স এখন আমার ৫০ ছুই ছুই। ছোটো বেলা ইনকিলাব পড়তাম আর ভাবতাম বড়ো বেলায় লিখবো। এই ভাবনা আমার শতভাগ স্বার্থক করে তুলেছে আমার ভালোবাসার পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব। ৫ নভেম্বর ২০২০। দিনটি ছিল নভেম্বর। দৈনিক ইনকিলাবের উপসম্পাদকীয়তে ‘ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং একজন অধ্যাপকের মূর্খতা’ শীর্ষক শিরোনামে সর্বপ্রথম আমার লেখা প্রকাশিত হয়। আর ২০ নভেম্বর শুক্রবারে ইনকিলাব আমার দ্বিতীয় লেখাটি প্রকাশ করে। সেই হতে ইনকিলাবে আমি নিয়মিত লেখা পাঠাই। আমার প্রেরিত প্রতিটি লেখাই ইনকিলাব প্রকাশ করেছে। ইনকিলাব আমার ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছে। আমি এখন ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক। আজ ইনকিলাবের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। আর ইনকিলাবের লেখক হিসেবে আমার বয়স মাত্র ১ বছর ৭ মাস। এ সময়ের মধ্যে ইনকিলাব আমার প্রেরিত প্রায় ৫০টি লেখা প্রকাশ করেছে। ৩৭তম জন্মদিনে ইনকিলাবের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নানের (রহ:) জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম কামনা করছি। সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। ইনকিলাব পরিবারের সম্মানিত সকল সদস্যদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি; তাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি। ইনকিলাবের হৃত গৌরব ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। ভালো থাকুক ইনকিলাব, ভালো থাকুক ইনকিলাব পরিবারের সকল সদস্য। ইনকিলাব এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে। ইনকিলাবের লক্ষ্য থাকুক অটুট।

লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দা‘ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।



 

Show all comments
  • শাহ ওয়ালীউল্লাহ আজমী ৪ জুন, ২০২২, ৯:৪১ এএম says : 0
    প্রফেসর ড.মো: কামরুজ্জামান স্যার আমার প্রিয় একজন শিক্ষক। সেই সাথে আমি দৈনিক ইনকিলাব সহ স্যারের লেখার নিয়মিত পাঠক। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি স্যারের ভালোবাসাকে সম্মান জানানোর জন্য ইনকিলাব পরিবারের সকল সদস্যদের জান্য র‌ইল আন্তরিক ভালোবাসা। আর প্রিয় স্যার দৈনিক ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক হিসেবে নির্বাচিত হ‌ওয়ায় স্যারকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
    Total Reply(0) Reply
  • শাহ ওয়ালীউল্লাহ আজমী ৪ জুন, ২০২২, ৯:৫৫ এএম says : 0
    প্রফেসর ড. মোঃ কামরুজ্জামান স্যার আমার প্রিয় একজন শিক্ষক। সেই সাথে আমি দৈনিক ইনকিলাব সহ স্যারের লেখার নিয়মিত একজন পাঠক। ইতিমধ্যেই স্যারের প্রায় অর্ধশত লিখনি বিভিন্ন সচেতন মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যার অধিকাংশ লেখা দৈনিক ইনকিলাবে দেখতে পেয়েছি। তাছাড়া দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি স্যারের ভালোবাসাকে সম্মান জানানোর জন্য ইনকিলাব পরিবারের সকল সদস্যদের জন্যে র‌ইল আন্তরিক ভালোবাসা। আর প্রিয় স্যার দৈনিক ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক নির্বাচিত হ‌ওয়ায় স্যারকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
    Total Reply(0) Reply
  • শাহ ওয়ালীউল্লাহ আজমী ৪ জুন, ২০২২, ৯:৫৬ এএম says : 0
    প্রফেসর ড. মোঃ কামরুজ্জামান স্যার আমার প্রিয় একজন শিক্ষক। সেই সাথে আমি দৈনিক ইনকিলাব সহ স্যারের লেখার নিয়মিত একজন পাঠক। ইতিমধ্যেই স্যারের প্রায় অর্ধশত লিখনি বিভিন্ন সচেতন মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যার অধিকাংশ লেখা দৈনিক ইনকিলাবে দেখতে পেয়েছি। তাছাড়া দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি স্যারের ভালোবাসাকে সম্মান জানানোর জন্য ইনকিলাব পরিবারের সকল সদস্যদের জন্যে র‌ইল আন্তরিক ভালোবাসা। আর প্রিয় স্যার দৈনিক ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক নির্বাচিত হ‌ওয়ায় স্যারকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আখতার হোসেন ৪ জুন, ২০২২, ৩:৫৬ পিএম says : 0
    উপস্থাপনা যে এত সুন্দর হতে পারে তা এই লেখা থেকে বুঝা যায়।ছালাম দোয়া ও শুভকামনা।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ মিরাজুল ইসলাম ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ৬:৫৬ পিএম says : 0
    শিক্ষকের প্রতিটি লেখাই অসাধারণ উপস্থাপন-শৈলী বিদ্যমান। দোয়া ও শুভকামনা রইলো প্রিয় স্যার ও ইনকিলাবের প্রতি। মিরাজ,আল কুরআন ১৮-১৯, ইবি।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইনকিলাব

২৭ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন