তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
বিচিত্র এবং বিপুল লোকসংগীতে ভরা বাংলার প্রতিটি অঞ্চল। আর এই লোকসংগীতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় দখল করে রেখেছে ‘ভাওয়াইয়া’ গান। এটি বাংলাদেশে উত্তর জনপদ তথা রংপুর অঞ্চলের গান হিসেবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গের কোচ রাজবংশীয়রাই এই গানের স্রষ্টা বলে জানা যায়। ভারতের কোচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, আসামের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলা এবং বাংলাদেশের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর জেলায় এই গান প্রচলিত ও জনপ্রিয়। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয় বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলে। আসামের গোয়ালপাড়া হলো ভাওয়াইয়া গানের আদিভূমি। আর রংপুর অঞ্চল হলো ভাওয়াইয়া গানের উর্বরভূমি বা চর্চাভূমি। ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। তাই রংপুর অঞ্চলে রচিত ও গীত ‘ভাওয়াইয়া’ গানকে অনেকে রংপুরিয়া ভাওয়াইয়া গান বলে থাকেন। ‘ভাওয়াইয়া’ মুলত রংপুর অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচায়ক।
‘ভাওয়াইয়া’ শব্দের উৎপত্তি এবং ভাবার্থ সম্পর্কে একাধিক মতান্তর আছে। তবে ‘ভাব’ থেকেই ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দটির উৎপত্তি মর্মে বেশিরভাগ তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকের মতে, ‘ভাও’ অর্থ ‘ভাব’ আর সংস্কৃত ‘আওয়াই’ অর্থ জনরব। এই দু’টি শব্দের সমীকরনে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দ এসেছে। আবার অনেকের মতে, রংপুর অঞ্চলের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ভাষার ক্ষেত্রে ‘ইয়া’ প্রত্যয় যোগ করার রীতি চালুু রয়েছে। যেমন- ‘বাওদিয়া’ ‘খাওয়াইয়া’, ‘দেওয়াইয়া’, ‘নেওয়াইয়া’ ইত্যাদি। দোতরা নিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো লোকদের ‘বাওদিয়া’ বলা হয়ে থাকে। যে বেশি খায় তাকে ‘খাওয়াইয়া’, যে দেয় তাকে ‘দেওয়াইয়া’, যে নেয় তাকে ‘নেওয়াইয়া’Ñ এরকম বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে এই ‘ভাব’ বা ‘ভাও’ সম্বলিত গানগুলোকেও ‘ভাওয়াইয়া’ বলা হয়ে থাকে। ভাব শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রেম, প্রীতি, প্রণয়, প্রকৃতি, ভক্তি, আবেগ, প্রভৃতি। এই ‘ভাব’ শব্দের সাথে ইয়া প্রত্যয় যুক্ত করে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যাহোক, এই ‘ভাওয়াইয়া’ গান বাংলা লোকসঙ্গীতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি শাখা। ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গের অতি-গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যে সংস্কৃতির মধ্যে অবিভক্ত উত্তরবঙ্গ ও নিম্ন-অসমের সমাজ, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলের গাড়িয়াল, দফাদার মৈষাল, মাহুতের কথা যেমন ভাওয়াইয়া গানে জড়িয়ে আছে, তেমনই স্থান পেয়েছে তিস্তা, ধরলা, যমুনার উথাল-পাথাল ঢেউয়ের কথাও। গাছগাছালি আর অরণ্যভূমি যেমন ধরা পড়েছে, তেমনই ধরা পড়েছে শস্য শ্যামলা কৃষিভূমিও, যেখানে তৈরি হয় গামছা বান্ধা দই, বিন্নিধানের চিঁড়ে। কৃষিফসলের বিস্তৃত ভাণ্ডারের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ভাওয়াইয়া গানের বাণীতে। ভাওয়াইয়া গান মূলত নারী, নদী ও প্রকৃতি নির্ভর। এ গানে উত্তর জনপদের গ্রামীণ নর-নারীর জীবন-জীবিকা, আশা আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহসহ খেটে খাওয়া সাধারণ বা শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। এই গানে নদ-নদী এবং প্রকৃতির কথাও উঠে এসেছে অত্যন্ত সুনীপুণভাবে।
‘ভাওয়াইয়া’ গানের সঙ্গে বিশেষ ছন্দে বাজানো হয় দোতারা, তবলা, সারিন্দা, ঢোল ও বাঁশি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলোকে সঙ্গত করে সঙ্গীতের এক মধুময় মূর্ছনা ও আবেগ সৃষ্টি করা হয়। অন্তরের আবেগ মিশ্রিত সুমধুর ধ্বনি ভাওয়াইয়া গানের প্রাণ। নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ, ভাষার সাথে এ গানের ভাব-ভাষা ও সুরের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। প্রিয় মানুষের গরুগাড়ির চাকার শব্দ নারীমনকে ভালবাসায় আন্দোলিত করে। নারী মনের উপচে পড়া ভালবাসার নিরাভরণ প্রকাশ ভাওয়াইয়া গানে ফুটে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা ভাওয়াইয়া গানগুলোকে সাধারণত ৫টি ভাগে ভাগ করেছেন।
এক. চিতান ভাওয়াইয়া: এই গান বিচ্ছেদ বেদনায় ভেঙ্গে পড়ার গান।
দুই. ক্ষীরোল ভাওয়াইয়া: এই শ্রেণীর গানে দোতারা বাজানোর একটি বিশেষ ধরন আছে। এভাবে দোতারা বাজানোর পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ক্ষীরোল ডাং’।
তিন. দরিয়া ও দীঘলনাসা ভাওয়াইয়া: উভয় গানই দীর্ঘ প্রসারিত দম সাপেক্ষ সুর, যেন স্রোতের টানে বিলিয়ে দেয়ার সুর।
চার. গড়ান ভাওয়াইয়া: এই গানের সুর এতই করুণ হয় যে বিরহ বেদনায় কাতর নারী যেন ধুলোয় গড়াগড়ি যায়।
পাঁচ. মইষালী ভাওয়াইয়া: এই ভাওয়াইয়া অন্যান্য ভাওয়াইয়ার মতোই কিন্তু চাল ভিন্ন ধরনের। এই গান গাইবার সময় মনে হয় যেন গায়ক কোন কিছুর উপর সোয়ার হয়ে চলছে। চলার ছন্দ গানের ছন্দে প্রকাশ পায়।
ভাওয়াইয়া গানের প্রসঙ্গ আসলে যে বিষয় প্রসঙ্গগুলো আসে তা হলো হাতি. মাহুত, মহিষ, বাথান, মহিষাল, গরু, গরুরগাড়ি, গাড়িয়াল, গ্রাম্যবধুর বাবার বাড়ি যাওয়া, (যা রংপুরের ভাষায় ‘নাইওর’ বলা হয়ে থাকে), গ্রামের আঁকাবাঁকা মঠোপথ, নিথুয়া পাথার (দিগন্ত মাঠ বা ফসলের ক্ষেত) এর কথা। আগে গ্রামীণ বধুদের বাবার বাড়ি যাওয়া বা বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি আসা, পণ্য পরিবহনের একমাত্র বাহনই ছিল গরু ও মহিষের গাড়ি। সোয়ামীর বাড়ি (স্বামীর বাড়ি) ফেরার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে পথপানে চেয়ে থাকতো গ্রামীণ বধূ। সোয়ামীর (স্বামীর) বিরহে বিরহিনী নারীর করুণ আর্তি:
‘পতিধন মোর দূর দ্যাশে
মৈলাম পৈল কালা চিকন ক্যাশে রে’
আবার গরুর গাড়িতে করে বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথে:
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত কান্দিম মুই নিধুয়া পাথারে’,
বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথে আপন-জনদের ছেড়ে যাওয়ার ব্যাকুলতায় ব্যাকুলিনী বধুর মুখে উচ্চারিত:
‘আস্তে বোলাও গাড়ি রে গাড়িয়াল
ধিরে বোলাও গাড়ি
আরেক নজর দ্যাখিয়া নেও মুই
দয়াল বাবার বাড়ি---’
এই গানটিতে গ্রামীণ বধুর বাবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার, আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার হৃদয়গ্রাহী মর্মস্পর্শী কথা তুলে ধরা হয়েছে। বাবার বাড়ি ও আপনজনদের ছেড়ে যাওয়ার যে ব্যাথা, যে মায়া, যে ব্যাকুলতা তা অত্যন্ত সুনিপূণভাবে উঠে এসেছে।
আবার নববধুকে খুশি করতে স্বামীর মুখে উচ্চারিত:
‘কন্যা ভাবনা করিস কি
কন্যা চিন্তা করিস কি
এবার পাট বেচায়া আনিয়া দিম তোক
ফুল তোলা শাড়ি---’
এই গানটিতে মন খারাপ করে থাকা নববধুকে উদ্দেশ্য করে স্বামীর মনের কথাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
আবার গ্রামীণ নারীর হাতে লাগানো আকালি (মরিচ) গাছে আকালি এবং তার সাথে বথুয়া শাকের দৃষ্টিনন্দন ফলন নিয়ে উল্লাসিত নারীর মনের তুলে ধরা হয়েছে এই গানে:
‘কাঞ্চাত গাড়িনু আকাশি আকালি
আকালি ঝুন ঝুন করে রে বন্ধুয়া
বথুয়া হলফল করে’-
জলপাই গাছে জলপাই দেখে গ্রামীণ নারীর কণ্ঠে উঠে আসা হৃদয়গ্রাহী কথা:
‘বাপুই চেংড়া রে
গাছোত চড়িয়া দুইটা হা
ও মোক জলপই পাড়িয়া দে।
তুইও দুইটা নেনে বাপুই মোকো দুইটা দে
আরো দুইটা দেরে বাপুই ছাওয়া দুইটার বাদে---’।
জলপাই গাছে জলপাই দেখে গ্রামীণ নারীর জলপাই খাওয়ার আকাঙ্খা এবং তা পাড়িয়ে নেয়ার ব্যাকুলতার পাশাপাশি বাড়িতে থাকা সন্তানদের জন্যও নিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষার কথা উঠে এসেছে এই গানে। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গান এখনও কানে ভাসে এবং মুখেও উচ্চারিত অঞ্চলের প্রবীনদের।
গো-চারণ ভূমিতে গরু-মহিষ চরাতে গিয়ে রাখাল, মৈষালরা অবসর বা অলস মুহূর্তগুলোতে গান বাঁধে, সুরারোপ করে- গেয়ে ওঠে আপন মনে। কিংবা রাখালরা মহিষ চরাতে গিয়ে মহিষের পিঠে চড়ে আপন মনে ভাওয়াইয়া গান গাইতে থাকে।
নদীর উপর্যুপরি ভাঙনের ফলে নদীগুলো বার বার আঁকাবাঁকা পথে খরস্রোত ধারায় প্রবাহিত হয়। নদীর এই ঘন ঘন ভাঙন ও বাঁক পরিবর্তনের প্রভাব এসে নদীর তীরের মানুষের ওপর পড়ে। এতে নদী তীরের মানুষ নিঃস থেকে নিঃস হয়। তাদের জীবনেও চলতে থাকে ভাঙা-গড়ার খেলা। এই ভাঙ্গা-গড়া আর ঐসব মানুষের দুঃখের কথাগুলোও অত্যান্ত সাবলিলভাবে উঠে এসেছে ভাওয়াইয়া গানের কথায় ও সুরে।
ভাওয়াইয়া গানের জগতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে সুর সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের কথা। তিনি প্রাচীন এই ভাওয়াইয়া গান গ্রামোফোন রেকর্ডের মাধ্যমে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে আরও যে সব শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার এ ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা হলেন: ধীরেন চন্দ্র সরকার, কেশব চন্দ্র বর্মণ, নায়েব আলী টেপু, কেদার চক্রবর্তী, গঙ্গাধর দাস, পেরি মোহন দাস, চিন্তাহরণ রায়, সুরেন্দ্রনাথ বসুনিয়া, গোপাল চন্দ্র দে, হেম লতা, আশালতা, আব্দুল করিম, কানাই লাল শীল এবং পরবর্তীতে কাজী মকবুল হোসেন, একেএম আব্দুল আজিজ, মহেশচন্দ্র রায়, হরলাল রায়, মো. কছিম উদ্দিন, মো. মকবুল আলী, কে এস এম আশরাফুজ্জামান সাজু মিয়া, শমসের আলী প্রধান, নীনা হামিদ, নূরুল ইসলাম জাহিদ প্রমুখ এবং বর্তমানে মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, রথীন্দ্রনাথ রায়, নাদিরা বেগম, ড. সুখ বিলাস বর্মা, রফিকুল হক (দাদুভাই), শরীফা রানী, বেগম সুরাইয়া, ড. নাশিদ কামাল, আয়েষা সরকার, রহিমা কলিতা, অনন্ত কুমার দেব, আজিজার রহমান আজিজ, খন্দকার মোহাম্মদ আলী সরকার, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, নীল কমল মিশ্র, ভূপতি ভূষণ বর্মা, রেজেকা সুলতানা ফ্যান্সি, পঞ্চানন রায়, নূর মোহাম্মদ, নূরুল ইসলাম দেওয়ান, সফিউল আলম রাজা, সাজু আহমেদ, পূর্ণচন্দ্র রায়, রণজিৎ কুমার, শফিকুল ইসলাম, সাহস মোস্তাফিজসহ সহস্রাধিক ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার এ গানের কল্যাণে অবদান অব্যাহত রেখেছেন।
তবে নতুন ও বর্তমান প্রজন্ম ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এই গান, গানের সুর ও গানের মর্মকথা থেকে অনেক দূরে সরে আছে। এর মূল কারণ, কালের বিবর্তনে প্রযুক্তির উন্নয়ন আর আকাশ সংস্কৃতির কবলে পড়ে ভাওয়াইয়া গান এখন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। তবে এখনো এই গানের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বৃহত্তর রংপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ। এখনও এই গানগুলো উত্তরাঞ্চলের মানুষের হাসি-কান্নাকে ধারণ করে আছে। শহুরে জীবনে গুটি কতক শিল্পী ও অনুরাগী এ গানের চর্চা এখনও অব্যাহত রেখেছেন। করছেন প্রতিযোগিতার আয়োজন, ভাওয়াইয়া উৎসব। তবে তা অতি ক্ষুদ্র ও নগন্য আয়োজনের মাধ্যমে। এসব গান শুধু রংপুর বা দিনাজপুর নয়, ভারতের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার অঞ্চলে অন্যতম প্রধান লোকসংগীত হিসেবে এখনও বেঁচে আছে।
লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব, রংপুর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।