বই এবং পাঠাগার
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সেটাকেই বলে যে সমাজে কোনো বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যা হয় না। ভালমন্দ বিচারের বিভ্রাট
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে আলহিন্দ। প্রাচীন যুগের আরব পর্যটকদের বই-পত্রে আরব, পারস্যের পর আফগান জাতির বসবাসের কথা পাওয়া যায়, যাকে ব্যাপক অর্থে খোরাসান নামে চেনা যায়। এরপর পূর্ব দিকে খায়বার গিরিপথ থেকে সিয়াম বা বর্তমান মিয়ানমারের কিছু অংশ ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত যে অঞ্চলটি রয়েছে তার নাম ওয়াদিয়ে হিন্দ, ইংরেজরা যার সরাসরি তরজমা নিজেদের ভাষা ও উচ্চারণে করেছে ইন্দাজ ভ্যালি। আলবিলাদ আলহিন্দিয়া মানেই ইন্ডিয়া। পন্ডিতদের অনেক কিতাবে আলহিন্দ ওয়াসসিন্দ নামে এ অঞ্চলটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা পড়ে। তক্ষশিলা, এটি ইসলামাবাদের কাছে। হরপ্পা, এটি পাকিস্তানি পাঞ্জাবে। মহেঞ্জদারো, সেটিও সিন্ধুনদের তীরে। উত্তর থেকে নেমে আসা এ নদ এসে মিশেছে আরব সাগরে। করাচি বন্দর সিন্ধুতে। এর পূর্ব থেকে ঝিলাম, রাভী, যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র হয়ে কর্ণফুলি পর্যন্ত সবগুলো নদীর তীরে গড়ে উঠেছে হিন্দুস্তান।
এ জায়গাটিতে শুরুতে তাওহীদবাদী আসমানী ধর্মের অনুসারী মানুষের বসবাস ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, হযরত নূহ আ. এর সন্তানেরা প্রথম এসে এখানে ব্যাপক আকারে বসবাস শুরু করেন। অবশ্য কোনো কোনো বর্ণনায় এ কথাও বলা আছে যে, জান্নাত থেকে হযরত আদম আ.-কে দুনিয়ার বুকে পাঠানো হয়েছিল যে জায়গাটিতে সেটিই নাকি এই অঞ্চল। অনেকে তো সমুদ্র ও স্থলের সংযোগ-ভূমি শ্রীলঙ্কাকেই নির্দিষ্ট করে থাকেন। সেখানে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ একটি পর্বতকে হযরত আদম আ. এর প্রথম অবতরণ স্থান মনে করে। এখান থেকেই তিনি মানবজাতির কেন্দ্রভূমি ও প্রথম ইবাদতখানা কাবাগৃহের দিকে চলে যান। বলা হয়, আমাদের আদিমাতা হযরত হাওয়া আ.-কে সমুদ্র ও স্থলভাগের আরেক সংযোগ দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেন বন্দরে আল্লাহর ফেরেশতারা নামিয়ে দেন। সেখান থেকে তিনি উত্তরে হেঁটে হেঁটে চলে আসেন আরাফাতের ময়দানে। বাবা আদম শ্রীলঙ্কা থেকে সিন্ধু অববাহিকা ও পারস্য উপসাগর এবং জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেন সেই একই ময়দানে। সেখানে তাদের দুনিয়ার জীবনে আবার সাক্ষাৎ হয়। তারা মাশআরুল হারাম মুযদালিফা ও মিনা হয়ে পৌঁছেন মানবজাতির আদি ঠিকানা মক্কা শরীফের কাবাগৃহে, যা দুনিয়া সৃষ্টির সময় ফেরেশতারা নির্মাণ করেছিলেন বাইতুল মামুরের সমান ছায়ায়।
যতদূর জানা যায়, হযরত আদম আ. এর কবর মিনার মসজিদে খায়ফে। কেউ কেউ বলেন, কাবা প্রাঙ্গণ মাতাফে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা খুবই কঠিন। তবে উলামায়ে কেরামের মতে, কমপক্ষে আশি জন নবীর কবর রয়েছে বর্তমান মাতাফে। আর হযরত আদমের পর বিবি হাওয়াকে তার সন্তানরা মক্কা শরীফ থেকে ৫০/৬০ মাইল পশ্চিমে জেদ্দা শহরে দাফন করেন। জেদ্দার প্রধান কবরস্থানে যিয়ারত করার মতো সুবিধাসহ প্রায় ৪৫ হাত দীর্ঘ একটি কবর এখনো রয়ে গেছে, যা সৌদি সরকার কর্তৃকও স্বীকৃত। বড় আকারের ফলকে লিখিত আছে, ‘মাক্ববারাতু উম্মিনা হাওয়া আলাইহাস সালাম।’ কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, জেদ্দা শব্দটি জাদ্দাতুন-এর পরিবর্তিত রূপ। আদম আ. এর নাতি-নাতনিরা এই নিকটতম সমুদ্র তীরবর্তী শহরটিকে দাদির শহর নামে জানত।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হযরত নূহ আ. এবং তার সাথে বেঁচে যাওয়া সামান্য কিছু মানুষের বংশধরই নূহ-পরবর্তী পৃথিবীর বাসিন্দা। হযরত নূহের তিন সন্তানের নাম তাফসীরে পাওয়া যায়। হাম, সাম, ইয়াফেস। হামেরই দুই সন্তানের নাম সিন্দ ও হিন্দ। যে জন্য হিন্দ ও হিন্দা নামটি আরব দেশে বহুল প্রচলিত। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, হযরত আবু সুফিয়ান রাযি. এর স্ত্রী হিন্দা ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে এক আলোচিত নারী।
এই হিন্দ বা হিন্দুস্তানে প্রথম কে বা কারা শিরকের সূচনা করে, তা আলাদাভাবে বলার উপায় নেই। যেমন নূহ-পরবর্তী আরব উপত্যকায় ও ইরাক ভূমিতে কারা প্রথম শিরকের উৎপত্তি ঘটায় সেটাও স্পষ্ট নয়। তবে দুনিয়াতে শিরকের সূচনা সম্পর্কে ইতিহাস কিছু ইশারা দিয়েছে। তাওহীদপন্থীরা নিজেদের মধ্যকার নেক লোকেদের মৃত্যুর পর তাদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করে। দিনে দিনে এসব স্থায়ী রূপ লাভ করে। টেকসই হওয়ার জন্য গাছ, পাথর থেকে কাঠ, কাঠ থেকে ধাতু, কষ্টিপাথর ইত্যাদি চিত্র, ভাস্কর্য ও প্রতিমায় বিবর্তিত হয়। আগে ইবাদতখানার বাইরে অথবা মাঠে ময়দানে স্থাপিত হলেও প্রজন্ম পরিবর্তনে সেসব একসময় ইবাদতখানার ভেতরে প্রবেশ করায়। নতুন প্রজন্মের কল্যাণে সেসবই সেজদার স্থানে চলে যায়। মনে মনে এসবের সুন্দর ব্যাখ্যাও প্রতিটি প্রজন্ম দিতে থাকে। কঠিন মুশরিক পৌত্তলিক সমাজ যে নির্দোষ ও সুন্দরভাবে শিরকের ব্যাখ্যা দিত সেটি আল্লাহ তাআলা কোরআনে তুলে ধরেছেন এভাবে: যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য অভিভাবক গ্রহণ করেছে তারা বলে, এসব মূর্তিকে তো আমরা (খোদা মনে করি না; বরং এদের) ইবাদত করি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে। সূরা যুমার : ০৩। অপর জায়গায় আল্লাহ বলেছেন, মুশরিকদের যদি জিজ্ঞেস করো, আসমান ও জমিনের সৃষ্টি কে করেছেন এবং কে সূর্য ও চাঁদকে অনুগত করেছেন, জবাবে অবশ্যই তারা বলবে, ‘আল্লাহ।’ সূরা আনকাবুত : ৬১। এতে বোঝা গেল মনে মনে আল্লাহকে বিশ্বাস করার পরও যেকোনো নিয়তে মূর্তিকে অবলম্বন করাই শিরক।
ভারতেও জানা ইতিহাসে দেখা যায়, স্থানীয় মানুষদের ওপর বহিরাগত জাতি ও সম্প্রদায় এসে প্রভাব বিস্তার করে। এদের অন্যতম হচ্ছে বনী ইসরাইলের একটি পথভ্রষ্ট অংশ, যারা গরুকে শুরু থেকেই পূজা করত। নিজেদের তারা ব্রাহ্মণ বলে দাবি করে। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারী। এরাই কথিত সনাতন ধর্ম নিয়ে আসে, যা কিছুতেই সনাতন হতে পারে না। কারণ, মানুষের আদি পিতার ধর্ম ছিল একত্ববাদ। হযরত নূহ আ. এর ধর্ম ছিল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতভিত্তিক। হযরত ইবরাহীম আ. ছিলেন তাওহীদ বা একত্ববাদের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ। সেই ধারারই প্রবক্তা বনী ইসরাইলের সকল নবী-রাসূল। আমদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হযরত ইবরাহীম আ. এর উত্তর পুরুষ। নিজেদের ইবরাহীমের অনুসারী বা বারাহমান (ব্রাহ্মণ) দাবি-করা কোনো লোক নমরুদের ধর্ম ধারণ, চর্চা ও প্রচার করতে পারে, এটি কল্পনাও করা যায় না। অথচ এমন বড় একটি ডাকাতি ভারতে ব্রাহ্মণরা প্রায় তিন হাজার বছর যাবৎ করে আসছে। এমনকি তারা অন্যায়ভাবে তাদের এ কুসংস্কারে পরিপূর্ণ ধর্মটির নামও দিয়েছে হিন্দু ধর্ম, যার কোনো বৈধতা ও প্রামাণিকতা তাদের কারও হাতেই নেই। হিন্দু মূলত কোনো ধর্মের নাম নয়।
শ্রেষ্ঠ ও শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত ধর্ম ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই যথাসময়ে হিন্দুস্তানে প্রবেশ করে। কিছু প্রচারক ইসলামের বাণী এ দেশে নিয়ে আসে। মুসলিম ব্যবসায়ীরাও হিন্দ ও সিন্ধের বিশাল এলাকায় সমুদ্রপথে চলাচলের সুবাদে ইসলাম প্রচার করেন। এ অঞ্চলের মানুষ স্বেচ্ছায় সাগ্রহে ইসলাম গ্রহণ করে। স্থানীয় অত্যাচারী শাসকদের জুলুম থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তাদেরই আহবানে মুসলিম বাহিনী সিন্ধু উপত্যকায় আসে। এরপর একে একে বহু শাসক এ অঞ্চলে আসেন এবং সব দিক দিয়ে অঞ্চলটিকে এগিয়ে নেন। বিশ^সভায় ভারতের আজকের অবস্থান শুধু এর মুসলিম শাসকদেরই অবদান। কারণ, সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম রহ. থেকে বাহাদুর শাহ জাফর পর্যন্ত ৭/৮ শ বছর ভারত যেসব কারণে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছে এর সবই আরব, আফগান, তুর্কী, মোগল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শাসকেরই নজিরবিহীন অবদান। নিকট অতীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হিন্দুস্তানকে দখল করে নেওয়ার পর থেকে এর যত অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার জন্ম। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজ্যহারানো মুসলমানরা। মুসলমানদের অভিভাবক আলেম-উলামা ও পীর-মাশায়েখ। আযাদীর লড়াইয়ে জীবনদানে মুসলিমদের তুলনা নেই। যেসব শহীদের নাম হিন্দুস্তানের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে তাদের ৮০ ভাগই মুসলমান। মুসলমানরা কোনোদিন অন্য ধর্মের লোকেদের ওপর জুলুম করেনি। তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেনি। তাদের ধর্মস্থান ভাংচুর বা অবমাননা করেনি। এসব শিখিয়ে গিয়েছে ইংরেজরা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসা ব্রিটিশের দান। অমুসলিম পন্ডিতরা বলেছেন, যদি মুসলমানরা ইচ্ছা করত তাহলে ভারতে অন্য ধর্মের কোনো অস্তিত্বই থাকত না। কিন্তু প্রায় হাজার বছর দেশটি প্রবল প্রতাপ ও শক্তিমত্তার সাথে শাসন করার পরও এ অঞ্চলে অমুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা তাদের সকল কর্তৃত্ব, সুযোগ, সুবিধা ও বিপুল সম্পদ নিয়ে শুধু টিকে আছে বললেও হবে না; বরং গত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী যাবৎ নিজেরাই অঞ্চলটিকে শাসন করছে।
অবশ্য মুসলমানরা তাদের অভিজ্ঞতা ও সমাজবাস্তবতায় অমুসলিমদের হিংসা ও কূট-কৌশল থেকে অত্মরক্ষার জন্য নতুন একটি রাষ্ট্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে যেতে বাধ্য হন। এটিও অমুসলিমদেরই আগ্রহে। সে নতুন মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রটিও ২৩ বছরের ব্যবধানে দুই ভাগ হয়ে যায়। পূর্বপাকিস্তান রূপ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করে ৯ মাসের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এ দেশের মানুষ। ১৬ ডিসেম্বর হয় বিজয়। এটিই আমাদের বিজয় দিবস। এর বাইরে ভারতেই নিজেদের হাজার বছরের অধিকার নিয়ে, এর বিকাশ ও উন্নয়নে অবদানের দাবি নিয়ে, এর স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ রক্তদান ও ত্যাগ-তিতিক্ষার আত্মবিশ্বাস নিয়ে একাংশ মুসলমান স্বদেশেই থেকে যান। যদিও গত ৭৫ বছরে তাদের প্রতিদিন জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হয়েছে। চুক্তি ও অঙ্গীকার লঙ্ঘন করে অমুসলিমরা ভারতের স্বাধীন মুসলিম রাজ্য ও এলাকাগুলো দখল করে নিয়েছে। নিজামের হায়দারাবাদ এর একটি। ইচ্ছাকৃতভাবে নতুন রাষ্ট্রে যোগ না দিয়ে আসল ভূখন্ডের সঙ্গেই সামান্য কিছু অধিকার ও দাবি বজায় রাখার শর্তে স্বতন্ত্র পরিচয়ে বেঁচে থাকার ভদ্রোচিত অঙ্গীকারে জম্মু ও কাশ্মীর ইন্ডিয়াভুক্ত হয়। ছোট্ট এ ওয়াদাটিও, সংবিধানের এ আশ^াসটিও অমুসলিমদের একটি উগ্র শাসকশক্তি রক্ষা করতে পারেনি। ইতিহাসের নির্মম অমানবিক পন্থায় কাশ্মীরকে পদানত করা হয়েছে। ৮০ লক্ষ মানুষের পেছনে ৭৩ বছর যাবৎ কমবেশি ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ আর্মি লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
দুনিয়া এখন অমানবিক রীতি-নীতির দখলে। অন্তত গত ১০০ বছর ধরে দুনিয়া একচোখা নীতিতে চলছে। এই ১০০ বছরের ইতিহাসে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সাড়ে ১৩ শ বছরের মুসলিম খেলাফতের অবসান, ইন্ডিয়ায় তথা উপমহাদেশে হাজার বছরের মুসলিম সুশাসনের সমাপ্তি, মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে বাধা—এ সবই হচ্ছে চলমান সংকটের কারণ। মুসলমানদের ওপর সব অমুসলিম, হোক সে পূর্বের কিবা পশ্চিমের, ধর্মহীন অথবা ধর্মের অনুসারী—সব একজোট হয়ে উম্মতে মুহাম্মদীকে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে নেমেছে। মুসলিম দেশ ও জাতি নতুন যুগের মারণাস্ত্র, বিশ্বরাজনীতি ও অক্ষশক্তির অমানবিকতার চাপে ভীত, স্বন্ত্রস্ত। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মন-মানসিকতা ইসলামসম্মত ও স্বাধীন না হওয়ায় মুসলিম জাতিও এর সামান্য কিছু লোক ছাড়া বলতে গেলে সবটাই এখন অমুসলিমদের করায়ত্তে। অনেকগুলো রাষ্ট্র, সম্পদ, মেধা, জনশক্তি সত্ত্বেও মুসলমানরা দুনিয়ায় আছে বলে বোঝা যায় না। কারও বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না। শত অন্যায়, জুলুম ও অমানবিকতার পরেও কেউ আওয়াজ তোলে না। আগে যেখানে দুনিয়ার এক কোনায় যেকোনো মানুষ আর্তনাদ করলেই মুসলমানরা তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত, জালেম সে যত বড়ই হোক তাকে শায়েস্তা করত, মজলুম সে যে ধর্মেরই হোক তাকে উদ্ধার করত। মুসলমান আর তেমন নেই। থাকার উপায়ও নেই। এই সুযোগে দুনিয়ার কিছু অমুসলিম পশুর চেয়েও অধম এবং শয়তানের চেয়েও খারাপ চরিত্র ধারণ করেছে, যার নজির গড়ে দুই-আড়াই শ বছর, বিশেষ করে গত ১০০ বছরের ইতিহাসের পাঠক ও গবেষকরা একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন। তারা ইসলামের দেড় হাজার বছর একদিকে রাখুন, অপর দিকে ইসলামের দুর্যোগপূর্ণ সময় গত দেড় শ বছর। দেখবেন, মানবতা কত অসহায়।
গত ৭৫ বছরে দুনিয়া ভারতের মুসলমানের ওপর ছোট-বড় ৬০ হাজার দাঙ্গা হতে দেখেছে। ৫০০ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ একটি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন আরও কত শত মসজিদ যে ভাঙা ও দখল করা হয়েছে তার গণনাও কেউ রাখেনি। দেশটির সর্বোচ্চ আদালত নির্দ্বিধায় মসজিদের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। অথচ একটি উদ্ভট দাবি ছিল যে, এটি নাকি মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই অর্ধ সহস্র বছরের প্রাচীন মসজিদের ভিতের নিচে এমন কোনো আলামতই পাওয়া যায়নি, যাতে এই অলীক কথাটি প্রমাণিত হয়। সেখানে রাম মন্দির হবে। কিন্তু ৫ শ বছরের পুরোনো হাজার হাজার কবর এবং পূর্ণাঙ্গ প্রাসাদসম মজবুত ও মহান ভবনটি, যা উগ্র অমুসলিমরা হাতুড়ি, খুন্তি, সাবল, পাথর ও রড দিয়ে ভেঙেছিল, সেই চিত্রটি তারা কী করে মানব-ইতিহাসের পট থেকে মুছবেন? বাদশাহ বাবরের স্থানীয় শাসক মীর বাকী তার মসজিদটি পাঁচ শ বছর পর এভাবে শহীদ হবে তা হয়তো কল্পনাও করেননি। যদি এমন হবে তিনি ভাবতেন কিংবা তৈমুর ও বাবরের সন্তানরা এমন হিন্দুস্তানের কল্পনাও করতেন, তা হলে হয়তো এ দেশকে এত ভালোবাসতেন না। লালকেল্লা, জামে মসজিদ, ফতেপুর সিক্রি ও তাজমহল এই বংশের বাদশাহরা নির্মাণ করতেন না। দিল্লি শহরে ৪ শ বছর মোগলরা এত সব অবদান, জনকল্যাণ, ন্যায়বিচার, সুশাসন সর্বোপরি হিন্দুস্তানের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে ভালোবাসার বিনিময় একসময় এমন হবে তা ভাবতে পারলেও হয়তো এ অঞ্চলটিকে নিজেদের স্বদেশ মাতৃভূমি বলে মনে করতেন না। এত বড় দিল্লি শহরে একটিমাত্র আওরঙ্গজেব সড়ক। সেটিও নাম বদল করে এই শাসককে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি একাধারে ৫০ বছর এই বিশাল ভারতের দরবেশতুল্য ন্যায়বিচারক মহান বাদশাহ ছিলেন।
চিন্তাশীল মহল সব দিক বিবেচনায় এ কথা বলেন যে, সিন্ধ ও হিন্দের মুসলমানের এ সময়টি বেশি দিন এমন থাকবে না। সহসাই এই উগ্র ও অমানবিক ব্যবস্থার পতন হবে। মনুষ্যত্বের জয় হবে। শান্তি ও স্বস্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিবাচক কাজ, সদিচ্ছা ও মানবতার ওপর মেঘের আধার এসে থাকে। তবে তা স্থায়ী হয় না। মেঘ কেটে গেলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। এ অঞ্চলেও মজলুম মুসলমান ও মানবিক অমুসলিমসহ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মুক্তি অত্যাসন্ন। আবহমানকালের উপমহাদেশ হিমালয়ের মতোই তার গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। হিংসা, অমানবিকতা ও নির্মম আচরণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নয়। মনুষ্যত্ব ও সত্যের জোয়ারে অসুন্দরের আবর্জনা অবশ্যই ভেসে যাবে। দিল্লির মুসলমানদের শুধু নয়, ভারতের ৩০/৪০ কোটি মুসলমানকে আল্লাহ অবশ্যই রক্ষা করবেন।
লেখক : সাংবাদিক, ধর্ম ও সমাজতত্ত্ববিদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।