তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
আমাদের দেশের মন্ত্রী-নেতারা কাজে বড় না হয়ে কথায় বড় হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অন্যের জন্য তাঁরা যে উপদেশ বাণী আওড়ান, সেই বাণী নিজেরাই বিশ্বাস করেন না। মন্ত্রী থাকতে তাঁরা বড় বড় কথা বলেন। ভাবেন, তাঁরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সব সমস্যা রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে।
নিত্যপণ্যের সঙ্গে কথার চাতুরী ও মুখপাণ্ডিত্যের বাজারও আবার গরম। চড়ছে তো চড়ছেই। অভিধানও পাল্টে যাওয়ার দশা। একই বিষয়ে আজ এক কথা, কাল আরেক কথার চাতুরী। এই চাতুরী এখন একটা স্মার্টনেস। মিথ্যাচারীর প্রতিশব্দ ‘সুবক্তা’। এদিকে-সেদিকে ঢু মারলে আগে বলা হতো, ডিগবাজি। হাল আমলে তাকে বলা হচ্ছে, চমক-ক্যারিশমা। এক একটি ঘটনায় মানুষের কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কথার তীর আসছে এই চমক ও স্মার্টনেসধারীদের কাছ থেকে। কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না তেল-চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের কষ্টের সময়টাতেও। সাধারণত মানুষ এই অতি কথনে এক প্রকার ত্যক্ত-রিরক্ত।
বারবার সিঙ্গাপুর-লন্ডন থেকে মেডিকেল চেকআপ করে ফিরে মাননীয়রা মানুষকে চিকিৎসার জন্য বাইরে না গিয়ে দেশপ্রেমের সাক্ষর রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। কোথাও থেকে প্রশ্ন আসছে না, এ মশকরার বিপরীতে। মাননীয়দের জন্য কথার মাঠ ফাঁকা। তারা যেন এক একটা কথার মেশিন। বলা মাত্রই প্রচার। গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়ে চলে আসছে গণমাধ্যমে। এ যেন জাতীয় সাথে মশকরার মহোৎসব!
মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো অবারিত সুযোগ-অধিকার তাদের। বিশেষ করে, গত প্রায় সোয়া এক যুগে এই মান্যবরদের বচনগুলো নিয়ে একটি বই সংকলন করলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুখপাঠ্য হতো এবং তারা জানতে পারতো, এ দেশটিতে একদা কিছু মান্যবরের জন্ম হয়েছিল, যাদের ছিল অনেক কদর-আদর। রাজ্যের কেউ কখনো তাদের ভুল ধরার সাহস পায়নি। তাদের সতর্ক করেননি তাদের সিনিয়ররাও। এমনকি সংশোধনের তাগিদ আসতে দেখা যায়নি হাইকমান্ড থেকেও। বরং ধন্য ধন্য বলে সাহস-প্রণোদনা জোগানো হয়েছে। দেওয়া হয়েছে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ, স্মার্ট, লয়েল, করিৎকর্মা, অরিজিনাল, পিওর, পরীক্ষিত, সাহসী ইত্যাদি কতো অভিধা!
এমন আশকারাতেই তারা এই সময়ে এসে বলে দিতে পারেন, সয়াবিন তেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেউ জানতেও চাইলো না, এতদিন এই ক্ষতিকর পণ্যটি তাহলে খাওয়ালেন কেন মহোদয়রা? নানা বদনাম দিয়ে সরিষার তেলকে ধাওয়ালেন আবার চালের কুঁড়া থেকে তৈরি বিপুল সম্ভাবনার রাইস বার্ন অয়েলকে নিরুৎসাহিত করলেন, এখন আবার বলছেন, এই তেল ভালো! ড্রাইভারদের মানুষ চেনার দরকার নেই, গরু-ছাগল চিনলেই চলে, এমন কথা একজন মাননীয় কি বলতে পারেন? জ্বি পারেন। পারেন বলেই বলেছেন। বলে আসছেন। সমস্যা হয়েছে কখনো? কিংবা সমস্যা হবে?
যে কারণে কাউকে ডুবানো-চুবানো, দিগম্বর করে দেওয়াও দোষের কিছু বলে বিবেচিত হয় না। দু-চারটা কথায় মানুষের মনে কষ্ট লাগলেই বা কী? দেশে চালের কোনো সংকট নেই, মানুষ ভাত বেশি খায় বলে চালের দাম বাড়ছে, ডায়াবেটিসও বাড়ছে। গরুও এখন ভাত খায়, গরু কচুরিপানা খেতে পারলে মানুষ কেন তা খেতে পারবে না, ধরনের কথা কি এমনি এমনি বলছেন মহোদয়রা? এমন বচনের যাবতীয় সমর্থন-বাস্তবতা আছে বলেই তো বলেছেন বা বলতে পারছেন!
আইনের শাসনের বদলে শাসনের আইন কায়েম হলে মহোদয়রা যা ইচ্ছা করতেই পারেন! বলতে তো পারেনই। পারছেন বলেই তো এই কঠিন সময়ও বলে চলছেন, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হবেই। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে গেছে। সকালে ঘুম থকে উঠেই মানুষ দেখে তার মাথাপিছু আয় বেড়ে গেছে। ঢাকার টয়লেটগুলো ফাইভ স্টার হোটেলের মতো। হাতিরঝিল গেলে মনে হয় প্যারিস শহর, আকাশ থেকে ঢাকা শহরকে মনে হয়, লস অ্যাঞ্জেলস। আগামীতে টেমস নদী দেখতে লন্ডন নয়, বুড়িগঙ্গা গেলেই হবে।
বহু দেশের মানুষেরই উড়োজাহাজে চড়ার সামর্থ্য নেই, সেখানে আমরা প্লেনে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসি! মানুষ চাইলে তিন বেলা মাংস খেতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় আমরা দ্বিগুণ চাল খাই। এই অধিক পরিমাণ চাল তথা ভাত খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেলেই আমাদের চাল সংকট আর থাকবে না, কম খানসহ সময় সময় জনগণকে বহু আলোচিত বয়ান দিতে ছাড়েননি মাননীয়রা। বিদেশের মন্ত্রীরা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য বসে থাকে-এই গর্ব পর্যন্ত জানান দিয়েছেন এক মন্ত্রী মহোদয়!
অবিরাম এ ধরনের বচন-বয়ান সরবরাহ করা মান্যবররা কি শুধু একা? তাদের এ ধরনের কথায় সরকারের বা দলের কোনো পর্যায়ের কেউ আপত্তি করছেন? নাকি সমর্থন দিচ্ছেন? দৃশ্যত এর বাইরেও প্রচুর সমর্থক তাদের। বলার সঙ্গে সঙ্গে হাজারে হাজার ঝাঁপিয়ে পড়ছেন বাহ্-বাহ্ দিয়ে। শামিল হচ্ছেন এসব বচনকে প্রতিষ্ঠিত করতে আয়োজিত সেমিনার-গোলটেবিলে আর টিভি টক’শোতে।
গোটা আবহটিই মুখপাণ্ডিত্য এবং নোংরা বচনের বাম্পার ফলনের অনুকূলে। এ কর্মে যে যতো পারঙ্গম ও সাহসের সাক্ষর রাখছেন তার প্রাপ্তি ততো বেশি। মুখ জোরের এ কার্যকারিতার সঙ্গে চাতুরীর গুণ যোগে দু›এক জন ছিটকে পড়লেও বেশীরভাগ আগুয়ানকে আর পেছনে তাকাতে হচ্ছে না। ফলে সরকারে, দলে, পদ-পদবিতে তার সাফল্যের নিশ্চয়তা মিলছে অবলীলায়!
মেধা-শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সততার এখানে কোনো প্রশ্ন নেই। সিনিয়র-জুনিয়রও বিষয় নয়। রাষ্ট্রের বেতন ভুক্ত দলকানা আমলা বা দলীয় সিনিয়ররাও জুনিয়রদের সঙ্গে পেরে উঠতে নামছেন এ প্রতিযোগিতায়। সুফলও পাচ্ছেন। এক এক ঘটনায় হাতেনাতে প্রমাণ হচ্ছে মুখের জোরের বরকত। ব্যক্তিত্ব বা শিক্ষার বদলে নিম্নমানের কথার বিষে কেউ কষ্ট পাচ্ছে বা পাবে, এটি মোটেই এখন আর ভাবনার বিষয় নয়। বরংচ সফলতার এক একটা উদাহরণ। কিন্তু বিষয়-আসয় আসলে অন্যখানে।
মুখ বা থোঁতার জোরের এই সংস্কৃতি রাজনীতির মাঠ গড়িয়ে এখন ভাইরাসের মতো অন্যদেরও পেয়ে বসেছে। অবস্থাটা দিনে দিনে এমন জায়গায় ধেয়ে চলছে, ফুটপাথের ফেরিওয়ালা-দোকানদার থেকে শুরু করে শিক্ষক, উকিল, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম-খতিব পর্যন্ত কাজের চেয়ে মুখপাণ্ডিত্য রপ্ত করতে এখন মনোযোগী বেশি। যে যেখানে যা পারছেন করে ছাড়ছেন। সত্য-মিথ্যা, ভদ্রতা-চাতুরী, বিনয়-অসভ্যতা, মমতা-নিষ্ঠুরতাসহ প্রায় সবই এখন আপেক্ষিকতায় ঠাসা। মুখের সঙ্গে তাদের শরীরী ভাষাও সেই বার্তাই দিয়ে চলছে।
তারা বিশেষ আদর-সমাদর, আদাব-সালাম, তোয়াজ-কুর্নিশ, যত্ন-আত্তি আদায় করে নিচ্ছেন। ঘুষকে স্পিড মানি, দুর্নীতির সঙ্গে যানজটকে উন্নয়নের প্রমাণ, জনভোগান্তিকে উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো বচনে জায়েজ করার আর বাকি রাখেননি। সুবক্তা প্রমাণের নানা যুক্তি ও কথামালার বিবিধ রতনও আছে তাদের ভাণ্ডারে।
মন্ত্রীরা প্রতিদিন রাজনীতি নিয়ে কথা বললেও নিজের মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার বিষয়ে কথা বলাতো দুরে থাক স্বীকার করতেও চান না। এর একটি কারণ হতে পারে, মন্ত্রণালয়ে কীভাবে চলছে, তা তাঁরা জানেন না অথবা মন্ত্রণালয় এমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি, যা জনগণকে জানানো যায়।
একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী এই বলে বড়াই করেছিলেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা নাকি বাংলাদেশের মন্ত্রীদের উপদেশ নিতে মুখিয়ে আছেন। আমাদের মন্ত্রীদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য তাঁরা দীর্ঘ লাইন দিয়ে থাকেন। অথচ, যেসব মন্ত্রী এ রকম অতি আত্মগরিমায় ভোগেন, তাঁদের মন্ত্রণালয়ে কোনো সাফল্য দেখা যায় না। তাঁরা যদি বিদেশের দিকে তাকিয়ে না থেকে একবার দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন, বুঝতে পারতেন, মন্ত্রীদের সম্পর্কে তাঁদের মনোভাবটা কী।
একজন মন্ত্রী সফল না বিফল, তা জানা যায় মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পরও যদি মানুষ কাজের জন্য তাঁকে স্মরণ করে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি জনগণের সেবা করেছেন। তিনি অন্যায়-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি কিংবা ব্যক্তিগত সুবিধা নেননি। কিন্তু আমাদের দেশে সে রকম সৌভাগ্যবান মন্ত্রী হাতে গোনা দু-চারজনের বেশি পাওয়া মুশকিল! বরং সব আমলেই দেখতে পাই, যাঁরা মন্ত্রীর মসনদে বসে জল ও স্থল ও অন্তরিক্ষ দাপিয়ে বেড়ান, অথচ মন্ত্রিত্ব হারানোর পর কেউ তাঁদের খোঁজও নেয় না। এ রকম একাধিক সাবেক মন্ত্রী আছেন, যাদের নিজের জেলার নেতা-কর্মীরাই তাঁদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।
বিদ্যমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করে এটাই মনে হওয়া সঙ্গত যে, কবি জীবনানন্দ দাসের মা কবি কুসুম কুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি আবার নতুন করে পড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যপুস্তকে নয়, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়, সর্বস্তরেই কবিতায় বর্ণিত ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ লাইনগুলো অবশ্য পাঠ্য ও আত্মস্থ করা জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবির মতোই, সবারই প্রত্যাশা এখন এমনই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।