Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

২০ সেকেন্ডে শেষ কিলিং মিশন

আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ও কলেজছাত্রী প্রীতি খুন টিপুর স্ত্রীর মামলা : হত্যার হুমকি ছিল ৪-৫ দিন আগে খুনীদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে পুলিশ, র‌্যাব-গোয়েন্দাদের একাধিক টিম মাঠে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

হুমকির সপ্তাহ না পেরোতেই রাজধানীর ব্যস্তসড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। চার-পাঁচদিন আগে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়। এ সময় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি (২২)। গত বৃৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের সামনে এ কিলিং মিশনে অংশ নেন দুজন। মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরে তারা মোটরসাইকেলে আসে। তাদের একজন চালক, অন্যজন পিস্তলধারী।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, মাত্র ২০ সেকেন্ডে কিলিং মিশন শেষে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় খুনীরা। তবে গতকাল পর্যন্ত হত্যার রহস্য উদঘাটন বা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মিল্কি হত্যামামলার আসামি ছিলেন নিহত জাহিদুল।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মুলত মতিঝিল এলাকার টেন্ডারবাজি, মার্কেট নিয়ন্ত্রণ ও বাড়ি নির্মানের চাঁদাবাজির পুরোটাই একক নিয়ন্ত্রণ করতেন টিপু। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাট, যুবলীগ নেতা খালেদ ও ঠিকাদার জিকে শামীম গ্রেফতার হওয়ার পর একক নিয়ন্ত্রন চলে আসে টিপুর হাতে। এর পাশাপাশি মতিঝিল ও পল্টন এলাকার দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ এবং আবুল হোসেনের সঙ্গে টিপু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডারবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়ে, কমলাপুর আইসিডি ডিপো, বিদ্যুৎ ভবন ও গণপূর্তের টেন্ডারবাজির একটি কমিশন বিদেশে আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিককে দিতে হত। গত ৩ বছর ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে এইসব টেন্ডারবাজির কোনো কমিশন দেয়া হয়নি। এর জের ধরে টিপুর প্রতিপক্ষরা শক্তিশালী হয়। ওই শক্তিশালী গ্রুপটিকে দিয়ে জিসান ও ফ্রিডম মানিকের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয় টিপু।
পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, যে ব্যক্তি গুলি করেছে, সে পেশাদারের চেয়েও পেশাদার। প্রকাশ্যে ব্যস্ত সড়কে এত কম সময়ে এতগুলো গুলি ছোড়া খুব সহজ ব্যাপার না। হত্যাকারীর ছোড়া ১২ রাউন্ড গুলির ৮টি টিপুর গলা, বুক, পেট, কাঁধ, পিঠ, কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, টিপুকে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের ঠিক সামনে থেকে গুলি করা হলেও আগে থেকে তাকে নজরদারি করছিল আরও কয়েকজন। প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট যে, এটি পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির নম্বর প্লেট ও মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়া নম্বরের সূত্র ধরে এখন তদন্ত চলছে। এছাড়া ঘটনায় বেশকিছু ফুটপ্রিন্ট, আলামত ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ডিএমপির একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, ঘটনাস্থলের পাশের একটি বহুতল ভবনের সিসিটিভি থেকে ফুটেজ নেয়া হয়েছে। ওই ফুটেজে টিপু হত্যা মিশনের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২১ মিনিট ২০ সেকেন্ড। আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুর ব্যক্তিগত সাদা রঙের নোয়াহ মাইক্রোবাসটি যানজটে আটকা পড়ে শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের ঠিক সামনে। এটি খিলগাঁও রেলগেট অভিমুখে যাওয়ার রাস্তা। এর ১০ সেকেন্ড আগে বিপরীত দিকের রাস্তা ধরে উল্টোপথে একটি মোটরসাইকেল আসে।
মোটরসাইকেলটি শাহজাহানপুর রেলওয়ে হাফেজিয়া সুন্নীয়া আলিম মাদরাসা ও এতিমখানার সামনে এসে ঘুরিয়ে আবার রাজারবাগ অভিমুখে দাঁড় করান চালক। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা অস্ত্রধারী সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার মাঝখানে অবস্থান নেন। এসময় রাস্তায় খুব ধীরগতিতে গাড়ি চলছিল। ১০টা ২১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে টিপুর গাড়ির বাম দিক দিয়ে একেবারে কাছে গিয়ে প্রথম গুলি ছোড়া হয়। আচমকা আক্রমণ দেখে টিপুর গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন চালক মুন্না।
তবে সামনেই রিকশার জট থাকায় গাড়িটি বেশি দূর এগোতে পারেনি। গাড়ি থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় হামলাকারী দৌঁড়ে সামনে এসে খুব কাছ থেকে গাড়ির সামনের আসনে বসে থাকা টিপুকে লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। ওইসময় গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে গুলিবিদ্ধ হন টিপু। এরপর আশপাশে এলোপাতাড়ি কয়েকটি গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পরে টিপুর গাড়ির সামনে দিয়ে আবার সড়ক বিভাজক পার হয়ে রাস্তার উল্টো পাশে মাদরাসার সামনে দাঁড়ানো মোটরসাইকেলের দিকে চলে যায় হত্যাকারী। রাত ১০টা ২২ মিনিট ১০সেকেন্ডে দেখা যায়, মাইক্রোবাসের পেছনের আসনে বসে থাকা দুজন গেট খুলে বাইরে এসে মোটরসাইকেলটিকে ধাওয়া দিলে হত্যাকারীরা পালিয়ে যায়।
জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত ১১, ১২, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি। তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমার মোবাইল ফোনে কল আসে। জানানো হয়, কে বা কারা আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। ওর (টিপু) সঙ্গে ছিল মেরাজ, আবুল কালাম ও গারিচালক মনির হোসেন মুন্না। গাড়িটা আমাদের নিজেদের। মতিঝিল এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্টের কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরছিল সবাই।
টিপুর স্ত্রী জানান, তার স্বামী গত ১০ বছর ধরে বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে দলীয় কোন্দল ছিল। পাশাপাশি গত ৫ বছর ধরে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গর্ভানিং বডির সদস্য ছিলেন টিপু। মতিঝিল কাঁচাবাজারে গ্র্যান্ড সুলতান নামে তাদের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। তিনি ওই রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা করতেন। চার-পাঁচদিন আগে টিপুকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।
খুনিদের শনাক্তে কাজ করছে র‌্যাব : র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশকিছু ফুটপ্রিন্ট, আলামত ও সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি। এছাড়া বেশকিছু মোটিভ র‌্যাবের কাছে এসেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করছি। যিনি গুলি করেছেন, তাকেও সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। র‌্যাব ছাড়াও পুলিশের একাধিক ইউনিট কাজ করছে।
ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের ডিসি আ. আহাদ বলেন, নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি। এ ঘটনায় রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি নামের ২২ বছরের একজন তরুণীও নিহত হয়েছেন। তার পরিবারে এখনো থানায় আসেনি। টিপুর স্ত্রীর করা মামলায় প্রীতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা খুনিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।



 

Show all comments
  • Enamul Shahin ২৬ মার্চ, ২০২২, ৬:১৪ এএম says : 0
    Crime petrol সতর্ক তে এরকম একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা দেখা যায়। জনবহুল বাজারে খুনী হাটতে হাটতে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করার পর লোকজন ডাকে। অতঃপর নিজেই পুলিশকে ফোন দেয় এবং সুযোগ বুঝে সটকে পরে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jashim Chowdhury ২৬ মার্চ, ২০২২, ৬:১৪ এএম says : 0
    দশ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনা! যা সিনেমায় বা নাটকে সম্ভব ছিল। এখন তো পুরোপুরি বাস্তবে!
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Didarul Alam ২৬ মার্চ, ২০২২, ৬:১৪ এএম says : 0
    প্রকৃতপক্ষে 420 লোকরাই নিরপরাধ লোকদের 420 বানিয়ে নিজেরা সাধু সাজছে এবং ভূমিদস্যুতায় লিপ্ত হচ্ছে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Anowar ২৬ মার্চ, ২০২২, ৬:১৫ এএম says : 0
    রাজনৈতিক নেতা মরছে তাতে আফসোস নেই আফসোস শুধু ওই নিরপরাধ শিক্ষার্থীর জন্য। রাজনৈতিক খারাপ মানুষদের কারনে অরাজনৈতিক মানুষগুলো বলি হচ্ছে।। সকলের কাছে অনুরোধ আসুন সবাই পেট নিতি করি,।। নোংরা রাজনিতি ২০ বছর আগেও ছিলো এখনোও আছে,, এবং চলবেই,।।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdullah Chowdhury Royal ২৬ মার্চ, ২০২২, ৬:১৬ এএম says : 0
    বিস্ময় প্রকাশ করার কিছু নেই আওয়ামী দুঃশাসন এর ফল সবাই ভোগ করবে আজকে দেশের কেউ নিরাপদ নেই মায়ের পেটে সন্তান নিরাপদ নেই স্কুলে ছাত্র নিরাপদ নেই পথে ঘাটে ঘরে বাইরে আজকে মানুষ চরম নিরাপত্তাহীন আর এর জন্য দায়ী কেবল একমাত্র অবৈধ অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কারণ এই সরকারের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই নেই কোনো জবাবদিহিতা।
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২৬ মার্চ, ২০২২, ১২:৩৬ পিএম says : 0
    আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করছে এবং আমাদেরকে সংবিধান দিয়ে দিয়েছে [Al-Quran] এবং আল্লাহর সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তি জীবন পারিবারিক জীবন সামাজিক জীবন রাষ্ট্রীয় জীবন পরারাষ্ট্র জীবন আল্লাহর আইন দিয়ে চলবে আজকে যদি আল্লাহর আইন দিয়ে দেশ শাসন করা হতো তাহলে এই ধরনের খুনাখুনি হতো না কিসের জন্য মুসলিমরা একে অপরের ভাই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছে মুসলিম উম্মাহ একটা শরীরের মতো তাহলে মানুষ কিভাবে নিজেই নিজের শরীরকে হত্যা করে.......আমাদের দেশটা এখন জ্বলন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে শান্তি নাই জীবনের সুরক্ষা নাই খাদ্য সুরক্ষা নাই বাসস্থান নাই চিকিৎসা নয় মানুষের নীতি-নৈতিকতা নাই মানুষ হয়ে গেছে বেহায়া বেলাজ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুন

৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ