পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের ইতিহাসে নদীতে চলন্ত লঞ্চে প্রথমবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। সাধারণত ঝড়ের কবলে পড়ে কিংবা অন্য যানের সাথে ধাক্কা লেগে লঞ্চডুবি এবং হতাহতের ঘটনা ঘটলেও আগুন লেগে এমন মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, এ ঘটনা রহস্যজনক এবং তা নাশকতা কিনা, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটি যাত্রা শুরু করে। রাত আড়াইটার দিকে ঝালকাঠি শহরের কাছাকাছি পৌঁছার পর সুগন্ধা নদীর মাঝামাঝি থাকাবস্থায় লঞ্চটিতে হঠাৎ আগুন ছড়িয়ে পড়ে। খুব দ্রুত আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। শীতের রাতে বেশিরভাগ যাত্রী ঘুমিয়ে ছিল। এতে অনেকে জেগে উঠে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করে। অনেকে আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যায়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ৪১ জন পুড়ে মারা যায়। অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে এবং প্রায় শতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, লঞ্চটিতে আগুন লাগার পরও তা এক ঘন্টা চালিয়ে নেয়া হয়। লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কেউ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি। বরং তারা লঞ্চ ছেড়ে চলে যায় বলে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। অভিযোগ উঠেছে, লঞ্চটিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা তিন শতাধিক হলেও তাতে প্রায় সাত-আটশ’ যাত্রী নেয়া হয়। দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামত করছিল। এজন্য পুরো গতিতে ইঞ্চিন চালিয়ে ট্রায়াল দেয়া হচ্ছিল। এতে ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য যাত্রীদের কেউ বলছেন, লঞ্চের রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। কারণ যেটাই হোক না কেন, আগুন লাগার এ ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা জরুরি।
ঝড়ের কবলে পড়ে প্রতিবছরই লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নৌপরিবহন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ৬০২টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ‘ডোমেস্টিক ফেরি সেফটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারণের মধ্যে ৪৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে। ২৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে অতিরিক্ত যাত্রী বহন এবং ২৩ শতাংশ ঘটেছে বৈরী আবহাওয়ার কারণে। তবে গত বৃহস্পতিবার লঞ্চে আগুন লেগে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, এমন আশ্চর্যজনক ও অচিন্তনীয় দুর্ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল বলে বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লঞ্চটির যথাযথ ফিটনেস ছিল বলে মনে হয় না। এর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, আগুন শনাক্তের যন্ত্র ও সতর্কীকরণ পদ্ধতিও দুর্বল ছিল। আগুন নেভানোর লোকজনের অভাব ছিল এবং কেউ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি। ফলে লোকজন দগ্ধ হয়ে ও ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এছাড়া, ইঞ্জিন রুমে তেল রাখার নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চটিতে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যাপারে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ উদাসীন ছিল, এ থেকে তা স্পষ্ট হয়। বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনার পেছনে নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, বিগত কয়েক মাস ধরে দেশে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। গত বুধবার পর্যটনের ভর মৌসুমে কক্সবাজারে এক পর্যটকের গণধর্ষণের ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। তার পরের দিনই লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। একটি অস্বাভাবিক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি ঘটছে। ফলে এ নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। লঞ্চে অগ্নিকান্ডের পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এখানে কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তা বলতে পারছি না। দেশে নাশকতা এবং রহস্যজনক দুর্ঘটনার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন লাগার সাথে সাথে লঞ্চটি নদীর তীরে ভেড়ানো যেত। তা না করে কেন এক ঘন্টা চালিয়ে নেয়া হলো কিংবা আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা করা হলো না, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।
এ পর্যন্ত সংঘটিত লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রতিটিতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটির কোনো কোনোটি প্রতিবেদন দিয়েছে, কোনোটি দেয়নি। জমা দেয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বরাবরই বিভিন্ন সুপারিশ থাকে। এসব সুপারিশ বাস্তবে কার্যকর করা হয় না। ফলে দুর্ঘটনার কারণ জানা যায় না এবং দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যায়। আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ, ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর ৫৬ ধারায় বিস্ফোরণ, আগুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। অভিযান-১০ লঞ্চে যে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, অধ্যাদেশ অনুযায়ী তার ব্যত্যয় ঘটেছে। এর পাশাপাশি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়টিও সুস্পষ্ট। আমরা মনে করি, লঞ্চের ত্রুটি কিংবা রহস্যজনক, যে কারণেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটুক না কেন, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তা উদ্ঘাটন করতে হবে। দ্রুততম সময়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। আগুনে পুড়ে এত মানুষের মৃত্যু এবং আহত ও নিখোঁজ হওয়া কতটা মর্মান্তিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা নিহত ও আহতদের পরিবার-পরিজননের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
যে কারণেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটুক না কেন, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে তা উদ্ঘাটন করতে হবে। দ্রুততম সময়ে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।