গুলিস্তানের বিস্ফোরণে নিহত ১৬ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে
রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজার এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এ
এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শুধু মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারকে শাস্তি না দিয়ে এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনাসহ ২৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
এছাড়া দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ আইন প্রণয়ন, টাকার পরিমাণ নির্ধারণ এবং দুর্ঘটনার জন্য দায়ী (নৌযান মালিক, মাস্টার, ড্রাইভার, সরকারি কর্মকর্তা) ব্যক্তিদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করারও সুপারিশ করা হয়েছ কমিটি।
আজ শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে নাগরিক তদন্ত কমিটির করা তদন্ত প্রতিবেদনে এমনটি জানানো হয়। ১৬টি সংগঠনের উদ্যোগে এ নাগরিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গত ২৩ ডিসেম্বর দিনগত রাত ৩টার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া আহত রয়েছেন শতাধিক যাত্রী, নিখোঁজও আছেন অনেকে। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নৌযানের নতুন অথবা উচ্চ গতিসম্পন্ন কোন ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন করলে ইঞ্জিনের অনুপাতে পাইপলাইন বা এগজস্ট পাইপ পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু অভিযান-১০ লঞ্চটিতে এগজস্ট পাইপ বড় করা হয়নি। ফলে ইঞ্জিন কক্ষের আশপাশের তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। যেহেতু ইঞ্জিনের কাছাকাছি থেকে তাপ ছড়িয়েছে সেজন্য ইঞ্জিনের ত্রæটির কারণে ভয়াবহ এ আগুনের ঘটনা ঘটে। এর জন্য লঞ্চের মালিক, সরকারি কর্মকর্তারাসহ ১২ জন দায়ী।
নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আশীষ কুমার দে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষের পোর্ট সাইডের প্রধান ইঞ্জিনের ৩ নম্বর ইউনিটের ইন্ডিকেটর কক খোলা ও লকিং নাট আলগা ছিল। ইন্ডিকেটর ককের লকিং নাট আলগা থাকায় ঝাঁকুনিতে আস্তে আস্তে ইন্ডিকেটরটি খুলে যায়। ফলে আগুনের ফুলকির সংস্পর্শে এসে চারপাশে বাতাসের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ইঞ্জিনকক্ষে কোন ড্রাইয়ার কিংবা গ্রিজার না থাকায় একপর্যায়ে সেখানে থাকা ডিজেল ট্যাংকারে সংস্পর্শে এসে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে লঞ্চে।
বিআইডবিøউটিএর তথ্য অনুযায়ী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি সর্বশেষ গত ২৬ অক্টোবর তারিখ চলার পর প্রায় তিন মাস চলাচল করেনি। এরপর ১৯ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা করে। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে অগ্নিকান্ডের শিকার হয়। কিন্তু সার্ভের মেয়াদ ও রুট পারমিট বহাল থাকা সত্তে¡ও একটি যাত্রীবাহী নৌ-যানের চলাচল কেনো এতদিন বন্ধ ছিল, সে বিষয়ে বিআইডবিøউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ( নৌনিট্রা) বিভাগ ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার খোঁজখবর নেননি এবং সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারকে জানাননি।
এ ছাড়া সদরঘাট টার্মিনালে অফিস হওয়া সত্তে¡ও সংশ্লিষ্ট শিপ সার্ভেয়ারও বিষয়টি জানার চেষ্টা করেননি। এ ক্ষেত্রে তারা সকলেই দায়িত্ব পালনে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। সুতরাং নাগরিক তদন্তকমিটি মনে করে, নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের ঢাকা (সদরঘাট) কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মাহবুবুর রশীদ ও পরিদর্শক মো. হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিøউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও পরিদর্শক দীনেশ দাস, লঞ্চটির চার মালিক মো. হামজালাল শেখ, মো. শামীম আহম্মেদ, মো. রাসেল আহাম্মেদ ও ফেরদৌস হাসান রাব্বি। এছাড়া প্রথম শ্রেণির মাস্টার মো. রিয়াজ সিকদার ও দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার মো. খলিলুর রহমান এবং প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার মো. মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় শ্রেণির ড্রাইভার আবুল কালাম এঘটনার জন্য দায়ী।
নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী যাত্রীদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, ওই লঞ্চের একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেছেন লঞ্চটিতে ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী ছিলেন। তাদের মতে, লঞ্চটিতে আনুমানিক ৮০০ যাত্রী ছিলেন। আগুন লাগার পর লঞ্চ কর্মচারীরা যাত্রীদের রক্ষায় এগিয়ে আসেননি। কোনো যাত্রীকে লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়নি। লঞ্চে আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না।
নাগরিক তদন্তকমিটির পর্যবেক্ষণ ও তথ্য-উপাত্তে লঞ্চের বেশ কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তিন তলা লঞ্চের প্রত্যেক তলায় অবকাঠামোর সঙ্গে চারটি করে মোট ১২টি ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকার কথা ছিল। কিন্তু ছিল মাত্র ৬টি। ৪২০ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি লঞ্চ ১৫০টি লাইফ বয়া থাকার কথা সেখানে ছিল মাত্র ৩৫টি। ৮১টি কেবিনের অনুমোদন থাকলেও ছিল ৮৭টি। অভিযান-১০ লঞ্চের বার্ষিক ফিটনেস পরীক্ষা কাগজে সেসব মাস্টার ও ড্রাইভারের নাম ছিলো অগ্নিকান্ডের দিন তারা ছিলেন না।
এদিকে নাগরিক তদন্তকমিটির নৌ দুর্ঘটনা রোধে ২৫ টি সুপারিশের কথা জানিয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দায়ী সকলকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে দায়িত্ব পালনে অবহেলার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাবে এবং দুর্ঘটনাও কমবে না। দুর্ঘটনায় নিহত পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন করতে হবে। যাত্রীবাহী নৌযানে আনসার/সিকিউরিটি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। লঞ্চের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। প্রত্যেক নাবিকের ইউনিফর্ম পরিধান বাধ্যতামূলক করতে হবে। নিবন্ধন ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে বিআইডবিøউটিএ ও নৌ অধিদপ্তরকে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, নাগরিক তদন্ত কমিটির আহŸায়ক আবু নাসের খান, কমিটির সদস্যসচিব আমিনুর রসুল বাবুল, কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আশীষ কুমার দে, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন সাবেক প্রধান নৌ প্রকৌশলী ভি শিপস, গøাসগো যুক্তরাজ্য মো. আব্দুল হামিদসহ প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।