প্রাক্তন প্রেমিকের নির্যাতনের শিকার অভিনেত্রী
মালায়ালাম সিনেমার অভিনেত্রী আনিকা বিক্রমন। প্রাক্তন প্রেমিক অনুপ পিল্লাই তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ
এক মুসলিম যুবক ভারতীয় সমাজে নিজেকে হিন্দু হিসাবে উপস্থাপন করে এবং গাড়ির মেকানিক হিসাবে কাজ করে একটি শান্ত ঘরোয়া জীবন যাপন করছিল। কিন্তু যখন তার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান তাকে ফিরিয়ে নিতে আসে, তার হিন্দু স্ত্রী সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তার মুখোমুখি হয়। এ কারণে তার স্ত্রীকে জিহাদের নামে হত্যা করা হয়। অনতিবিলম্বে দেখা যায় যে, যুবকটি এবং অন্যান্য মুসলিম পুরুষরা প্রার্থনা করছে এবং সন্ত্রাসী আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওপরে বর্ণিত দৃশ্যগুলো সম্প্রতি ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সূর্যবংশী’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, যেটি এ মুহূর্তে দেশটির বক্স অফিসে রাজত্ব করছে। চলচ্চিত্রটি ভারতের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির বিপজ্জনক ‘লাভ জিহাদ’ ইস্যুকে উস্কে দিয়েছে, যা হিন্দু নারী বা মেয়েদের প্রলুব্ধ বা অপহরণ করে তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য মুসলিম পুরুষদের কথিত ষড়যন্ত্রকে চিত্রিত করে।
করোনা মহামারির লকডাউন শিথিল করার পর সূর্যবংশী হ’ল ভারতের অন্যতম সফল ছবি। এর সাফল্য ভারতের ঘৃণা এবং বৈষম্যমূলক পরিবেশে অবদান রাখছে, ভারতের আনুমানিক ২শ’ মিলিয়ন মুসলিমকে প্রতিদিন যার মুখোমুখি হতে হবে। চলচ্চিত্রের প্রতি তৃতীয় ফ্রেম একটি রক্তক্ষয়ী ইসলামবিদ্বেষকে প্রতিফলিত করে। এর প্রধান চরিত্রে রয়েছেন ভারতের অন্যতম বড় তারকা অক্ষয় কুমার, যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একজন বড় ভক্ত এবং যুদ্ধবাজ ও উগ্র দেশপ্রেমমূলক চলচ্চিত্রের জন্য খ্যাত।
সূর্যবংশীতে কুমার অভিনীত একটি উচ্চ-শ্রেণীর হিন্দু চরিত্র দেশপ্রেমের পাঠ দেয়। এর বিপরীতে, তার মুসলিম প্রতিপক্ষ ঘৃণা দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়; লম্বা দাড়ি আর টুপি নিয়ে সে দেশের প্রতি অকৃতজ্ঞ। চলচ্চিত্রটিতে প্রতিবার যখন নায়ককে সফলভাবে ভারতীয় মুসলিমদের মোকাবেলা করতে দেখা যায়, হলের হিন্দুবাদী দর্শকদের উচ্ছসিত হয়ে শিস এবং করতালি দিতে দেখা যায়।
সূর্যবংশীতে মোদি সরকারের ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী কার্যক্রমের সাথে একাত্মতা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করা হয়নি। এটি কাশ্মীরকে প্রদত্ত বিশেষ মর্যাদা বাতিলকে ন্যায্য বলে দাবি করে, যেখানে হাজার হাজার যুবককে আটক করা হয় এবং ২০১৯ সালে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট আরোপ করা হয়। মোদির সরকারের মতোই, চলচ্চিত্রটি যুক্তি দেখায় যে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে মুসলিমদের নাগরিকত্ব সংশোধনের আইনটি সন্ত্রাসবাদকে নিশ্চিহ্ন করেছে।
কুমারের নায়ক চরিত্রটি মুম্বাইতে ১৯৯৩ সালের বিস্ফোরণ সম্পর্কে কথা বলেছেন, কিন্তু সুবিধামত ১৯৯২ সালের মুসলিমবিরোধী হত্যাকাণ্ডকে উপেক্ষা করে গেছেন। চরিত্রটি সযত্নে গুজরাটের ২০০২ সালের দাঙ্গা, ২০০৬ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ, যা জুমার নামাজের পরে মুসলিমদের হত্যা করেছিল এবং ২০০৮ সালের মালেগাঁও বিস্ফোরণ, যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন, সেসব তথ্য উপেক্ষা করেছেন।
সূর্যবংশীতে একজন মুসলিম শিক্ষক এবং মাওলানাকে পাকিস্তানের অর্থায়নে একটি সন্ত্রাসী পরিকল্পনার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে দেখানো হয়েছে। নির্মাতাদের উচিত ছিল অন্তত মোদি ও তার সহযোগীদের চলচ্চিত্রটি লেখার কৃতিত্ব দেওয়া। দুঃখজনকভাবে, ছবিটি প্রযোজনা করেছেন প্রখ্যাত পরিচালক করন জোহর, যিনি ৯/১১-এর পর মুসলিমদের ওপর সংঘটিত পৈশাচিকতাকে চিত্রিত করে ‘মাই নেম ইজ খান’ চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেই ইতিহাস মোদির রাজত্বের আগের।
করন যদি কাশ্মীর নিয়ে কোনো খবর পড়তেন, তাহলে হয়তো বাস্তবতাটি পরিবেশন করতেও পারতেন। কিন্তু উদ্দেশ্য যখন অপপ্রচার, তখন কে বাস্তবতার কথা বলতে চায়? ইতোমধ্যেই, বিজেপি সরকার জোহরের এই নতুন বিশ্বদর্শনের পুরস্কার দিয়েছে। তিনি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার ক্ষমতাশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পেয়েছেন।
এদিকে, ভারতের পুলিশ সম্প্রতি ১০২টি টুইটার অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে, যার মধ্যে সাংবাদিক, আন্দোলন কর্মী এবং আইনজীবীরা রয়েছেন, যারা অক্টোবরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছিল এবং যারা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মসজিদ ভাঙচুর এবং মুসলিমদের বাড়িতে হামলা চালানোর প্রতিবাদ করেছে। ত্রিপুরা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে তাদের পিছু নিয়েছে।
এছাড়া, নয়াদিল্লিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মুসলিমদের জুমার নামাজে বাধা দিয়েছে এবং ভারতের মুসলিমরা অবশেষে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এরপর, ৫ নভেম্বর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন নেতার উপস্থিতিতে এক বিশাল হিন্দু প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়। সেইসাথে, ভারতে বিদেশী অর্থ ব্যবহার করে সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগে মোদি সরকার ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সূর্যবংশীর মতো একটি চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয়, এটি হিন্দু কট্টরপন্থীদের সহিংসতার অসংখ্য ঘটনাকে উপেক্ষা করে মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিবেশন করার একটি ষড়যন্ত্র। সূর্যবংশী দেখার পর নাৎসি জার্মানির কথা না ভাবা অসম্ভব, যেখানে হিটলার একটি চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে তুলেছিলেন, যা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল। বলিউড যদি হিন্দু জাতীয়তাবাদের লালন এবং মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার এই আক্রমণাত্মক উত্তরণ অব্যাহত রাখে, তাহলে এর হাতও রক্তে রঞ্জিত হবে। বক্স অফিসের কোনো রেকর্ডই তা মুছতে পারবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।