Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের ভোটাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্ন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ অর্ধেকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। সংসদ পূর্ণমেয়াদে বহাল থাকলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বিগত দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হওয়ায় এসব নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, এখনো চলছে। বাংলাদেশ কখনোই পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের জরিপে তার সর্বোচ্চ অর্জন ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’। গত দেড় দশক ধরে ত্রুটিপূর্ণ গ্রণতন্ত্রের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে হাইব্রিড রিজিমে নেমে গেছে বাংলাদেশ। সেই থেকে উত্তরণের কোনো রাজনৈতিক আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। মূলত ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের অনীহা এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিরোধীদলগুলোর ব্যর্থতা এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিরোধীদলগুলোর পক্ষ থেকে এ প্রসঙ্গে বলা হয়, সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে এবং আইন-আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন করার কারণে তারা রাজপথে দাঁড়াতে পারেন না। এ পরিস্থিতি এ দেশে নতুন নয়। আজকের সরকার এবং বিরোধীদল বিএনপি প্রবল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার গণপ্রতিরোধ ও গণআন্দোলনের মাধ্যমে পতন ঘটিয়ে এ দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন ঘটিয়েছিল। আরো পিছনে গেলে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় ইতিহাসের প্রািতটি ধাপের সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতাসীনদের অনুগত সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিরোধ ও বিজয়ের ইতিহাস। আমাদের স্বাধীন সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিট হচ্ছে- গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমরা এখন একটি হাইব্রিড রিজিমে আটকে পড়েছি। এ থেকে উত্তরণের পথ দেখা যাচ্ছে না। একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেনাসমর্থিত একটি অস্বাভাবিক শাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সেই নির্বাচনে বিএনপি’র ভরাডুবি ঘটেছিল এবং পরবর্তিতে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে দেশি-বিদেশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের ভূমিকার কথা জানা যায়। আঞ্চলিক শক্তিগুলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় না। আধুনিক গণতন্ত্রের সোল এজেন্ট সেজে বসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর ভূমিকাও খুব ক্ষীণ ও সংশয়পূর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের চাইতে এ দেশে একটি বশংবদ শাসকশ্রেণী গড়ে তোলার মধ্যেই তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার একটি ব্যাপক অর্থের স্বার্থে এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি ফলপ্রসূ স্বার্থকতার প্রশ্ন জড়িত। পাঁচ বছর পর পর একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ ও ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ গণতন্ত্রের খণ্ডিত শর্ত মাত্র। নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো এই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য। তবে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুস্পষ্ট প্রতিফলন নিশ্চিত করার পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার, সুশাসন ও সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করা। পক্ষান্তরে, গত চারদশকে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ক্রমাগত গভীরতা লাভ করেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সময়ে এসে দেশে আইনের শাসন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে দেশটা আচ্ছাদিত। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে কটাক্ষ করে চল্লিশের দশকের শুরুতে মার্কিন উপন্যাসিক জর্জ অরওয়ের এনিমেল ফার্ম নামের রূপকাশ্রিত উপন্যাসটি লিখেছিলেন। যেখানে পশুরা মানুষের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই কথিত বিপ্লবের পর দেখা গেল, তাদের শাসকরা বলছে, এনিমেলস আর ইকুয়েল, সাম এনিমেলস আর মোর ইকুয়েল। আমাদের আজকের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যেন সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে এখনো দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বলে হীন স্বার্থে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকারের গণ্ডিকে নিয়ন্ত্রিত করার প্রবল প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মত সাংবিধারিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের যেকোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে জনস্বার্থে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনমতের প্রতিফলন না থাকা এবং জবরদখলের সংস্কৃতি চালু হওয়ায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণের অধিকারের প্রশ্নে অধিকার হরণকারিদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করার কথা, সেসব কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন অনেকটা ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক দলের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মত ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশেষত নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারণে এর প্রতি মানুষের অনাস্থা বার বার প্রমানিত হয়েছে। গত দুইটি জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি স্থানীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ও পক্ষপাতমূলক অবস্থান ধরা পড়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের দায়সারা ভূমিকা ও ব্যর্থতার কথা শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই বলছেন না, খোদ নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তর থেকেও একই বাস্তবতার কথা উচ্চারিত হচ্ছে। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে এবং পরে এক সময়ের তুখোড় আমলা, সব্যসাচী লেখক ও জেষ্ঠ্য নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের কণ্ঠে যে সত্য উচ্চারিত হয়েছে, তা যেন এ দেশের গণতন্ত্রকামী নাগরিক সমাজেরই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে রাতের বেলা সিল মেরে ব্যালটবাক্স বোঝাই করার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বলে দাবি করেছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সেই মতের বিরোধিতা করে এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন দাবি করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলা যায় না, জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে, সবার কর্মকাণ্ড জনতার চোখে পরিক্ষীত হতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের উপর গুরুত্বের কথা বলেন তিনি। সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সর্বশেষ ধাপে ৪৩ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় নির্বাচনের উদ্দেশ্যকে ম্লান করে দিয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নির্বাচিত বলা যায় কিনা, গণমাধ্যম কর্মী ও নাগরিকদের কাছে এই প্রশ্নও রেখেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

নির্বাচন বিশ্লেষক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং নির্বাচন কমিশনারের মত পদধারি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বাংলাদেশের বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন এবং হাজার হাজার স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তার কোনোটিই সরকারের সর্বোচ্চ মহলে তেমন গুরুত্ব পায়নি। একই ধরণের নামকা ওয়াস্তে নির্বাচনী রূপরেখার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন চলছে। এর জন্য প্রথমত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষমতাসীনদের অনীহা এবং যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকার সর্বাত্মক অপচেষ্টার দায় সর্বাধিক। অন্যদিকে, বিরোধীদলের জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি এবং দলের সাধারণ কর্মী ও জনসাধারণের প্রতি দলের নেতাদের কমিটমেন্টের অভাব থাকায় গণতন্ত্র সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সম্ভাবনা হারিয়েছে। দেশের মানুষের ভোটাধিকারের কমিটমেন্ট রক্ষায় তাদের ব্যর্থতার দায় তাদেরকেও এখন রাজনৈতিক ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। বিগত সময়ের মত এবারো বিরোধীদলের নেতাদের মুখে দায়সারা গতানুগতিক বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। কথাবার্তা ও আচরণে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরাও আবারো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার পরিকল্পনা আঁটছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে নব্বই পরবর্তী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম তিনটি (১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১সালের) জাতীয় নির্বাচনে। এরপরের সেনাসমর্থিত বিশেষ সরকার এবং ক্ষমতাসীনদের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে আদৌ গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যায় কিনা, তা নিয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা খুব কঠিন কিছু নয়। এ কারণেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আবারো প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী ঘরানার প্রবীণ কলামিস্ট, লন্ডন প্রবাসী আব্দুল গাফফার চৌধুরী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘আওয়ামী লীগ কি আরও একবার ‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল’ ভক্ষণ করবে’ শিরোনামে তাঁর লেখা একটি কলাম গত ৪ অক্টোবর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নিবন্ধের পরতে পরতে তিনি পুরনো কাসুন্দি ঘেঁেট বিএনপি’র ম্যানিপুলেশন সম্পর্কে আওয়ামী লীগকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক জোট ও দলগুলোর সম্ভাব্য ভাঙাগড়া এবং দেশি-বিদেশি শক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি জোটের আন্দোলনের হুমকি কোনো কাজে আসবে না। তাদের কথায় নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মত ভুল করবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পালাবদল সবচেয়ে বাস্তব ও কাক্সিক্ষত বিষয়। তিনটি প্রশ্নবোধক নির্বাচনের পর একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাব্য পথরেখা তুলে দেয়ার বদলে দেশের প্রবীণ একজন কলামিস্ট ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসির দেশ বৃটেনে বসে নিজের পসন্দের দলকে বিরোধী পক্ষের সব দাবি উপেক্ষা করে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার একতরফা নির্বাচনী ব্যবস্থার কথাই প্রকারান্তরে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বিশ্বের বহুদেশেই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ইতিহাস আছে। আমাদের মত হাইব্রিড রিজিম প্রভাবিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে নির্বাচনের পর হেরে যাওয়া দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা উঠবেই। কিন্তু বাংলাদেশে বিগত দুইটি নির্বাচনের প্রকৃতিকে ত্রুটিপূর্ণ বললে খুব কম বলা হবে, এসব নির্বাচন নির্বাচনের আইনগত গ্রহণযোগ্যতার নৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের জন্য গণতন্ত্র হত্যার অপবাদ এবং ভোটারবিহীন ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় থাকার চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্রহণযোগ্য পন্থায় বিরোধীদলের আসনে বসা অনেক বেশি গৌরবের। এখন যদি কোনো অনলাইন গণমাধ্যম নেটিজেনদের মধ্যে ভোট করে জানতে চায়, নির্দলীয় ত্বত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচন নাকি আরো একটি ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জাতীয় নির্বাচন, এই দুয়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের জন্য কোনটি নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল? আমার বিশ্বাস, শতকরা ৭০ভাগ মানুষ একতরফা দখলবাজির নির্বাচনকেই ‘নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল’ বলে রায় দিবে।

গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে দেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তির ব্যানানা রিপাবলিক বানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দখলদারিত্বের জায়গায় নিয়ে আসার ধারাবাহিকতা থেকে এবার বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাপ থাকুক বা না থাকুক, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এসে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা এবং ভোটের রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে আসার কার্যকর আইনগত ও রাজনৈতিক রোডম্যাপ ছাড়া গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করতে পারে না। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, নির্বাচন ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন, সব রাজনৈতিক দল নিজস্ব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন নিয়ে কোনো রকম বৈষম্য ব্যতীত ও প্রতিবন্ধকতামুক্তভাবে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির হওয়ার সুযোগ এবং সব মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিট বা লক্ষ্যই ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থার যে হাল দেখা যাচ্ছে, তা শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষকে হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। এদেশের সব রাজনৈতিক শক্তি এবং জনসাধারণকেই এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইউনিভার্সিটি অব মেসাচুসেটস-এর এমিরেটাস প্রফেসর, ড. রিচার্ড ডি উল্ফ’র লেখা ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য বেসিক্স অব টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ডেমোক্রেসি, অটোক্রেসি অ্যান্ড ক্যাপিটালিজম’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধের শুরুতেই তিনি লিখেছেন, ডেমোক্রেসি এক্সিস্টস ইফ অ্যঠহু হোয়েন এ কমিউনিটি অর্গানাইজেজ ইটসেল্ফ-গর্ভনেন্স অ্যারাউন্ড দ্য ফুল পার্টিসিপেশন, অন ইকোয়েল বেসিস, অব অল দি মেম্বার্স অব দি কমিউনিটি। জনগণ তথা সমাজের সব অংশের মানুষের সমতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ অংশগ্রহণ করার সুযোগ এবং রাষ্ট্র ও সমাজের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই গণতন্ত্রের অবস্থান। অন্যদিকে অটোক্রেসি হচ্ছে, যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ গোষ্ঠী বা ঘরানার মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তিনি বলেছেন, ‘ইটস আদার, অটোক্রেসি, এক্সিস্টস হোয়েন এ কমিউনিটি অর্গানাইজেস ইটস গর্ভানেন্স বাই অ্যান ইন্ডিভিজুয়াল অর সাবগ্রুপ অব দ্যাট কমিউনিটি, এ রুলার। মোদ্দা কথা হচ্ছে, জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার সামগ্রিক পরিবেশ, সাম্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে, গণতন্ত্রের সার্বজনীন শর্ত। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে এ লক্ষ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনগত নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একাদশ জাতীয় সংসদ

১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
১৮ জানুয়ারি, ২০২১
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন