Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভূমির মালিকানা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

মহানবী স. ইক্তারূপে আবু বকর, উমর, আলী, বিলাল ও জুবায়ের রা. প্রমুখ সাহাবীকে ভূমি দান করেছিলেন। “ইমাম আবূ ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, বৈরূত : দারুল মায়ারিফাহ, তা.বি., পৃ. ৬১” এভাবে খুলাফায়ে রাশেদীনও একাধিক ব্যক্তিকে ইক্তারূপে ভূমি দান করেছেন। ‘কিতাবুল খারাজা’-এ উল্লেখ রয়েছে, “যদি ইক্তার উদ্দেশ্য সাধিত না হয় অথবা যদি অন্যায়ভাবে বা অসদুদ্দেশ্যে ইক্তা প্রদান করা হয়, তবে এই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।” “প্রাগুক্ত” উমর রা. মহাবী স. কর্তৃক প্রদত্ত বিলাল ইবনে হারিস আল-মুযানীর রা. ইকতার একাংশ এ জন্যই ফেরত নিয়েছিলেন যে, তিনি এই ভূমি যথাযথভাবে আবাদ করতে সক্ষম হননি। অনুরূপভাবে খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয র. আপন পরিবারের জন্য প্রাপ্ত লাখেরাজ ভূসম্পত্তি এজন্য বাতিল করেছিলেন যে, এগুলো উমাইয়্যা শাসকবর্গ স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রদান করেছিলেন।“আবূ উবাইদ আল-কসেম ইবনে সাল্লাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৬”

উল্লেখ্য যে, সরকারীভাবে যে ভূমি জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে এর দ্বারা কোনরূপ সামন্তবাদী বা জায়গীরদারী প্রথা চালু করা যাবে না। যার পক্ষে যে পরিমাণ ভূমি চাষাবাদ, উৎপাদন করা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব তাকে ঐ পরিমাণ ভূমিই দেয়া হবে। সরকারী মালিকানা ছাড়া ক্রয়কৃত ভূমির মালিকগণ যদি বেশীরভাগ আবাদী ভূমি হস্তগত করে বসে এবং গরীব কৃষকের যদি ভূমির প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে দেখা দেয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারবে ঃ ১. মালিকানাবিহীন, পতিত ও অনাবাদি কৃষি ভূমি কৃষকদের মধ্যে বিনা টাকায় বণ্টন করে দেয়া। ২. ভূমির মালিকদের নিকট কৃষিকার্যের উপযুক্ত অতিরিক্ত ভূমি থাকলে এসব ভূমি তাদের দখলমুক্ত করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া। “মাওলানা হিফজুর রহমান, ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অনু ঃ মওলানা আবদুল আউয়াল, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০০, পৃ. ১৯২”
মহানবী স.-এর ইন্তিকালের পর প্রথম পর্যায়ে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়ে এই দুই রাষ্ট্রের বিশাল অংশ দখল করে নেয়। ইসলামী রাষ্ট্রের দখলকৃত এই বিশাল ভূমির কেউ মালিক ছিল না। হয় ঐ জমির মালিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে, না হয় তা আসলেই কারো মালিকানাভুক্ত ছিল না বরং পারস্য ও রোমানা সাম্রাজ্যের সরকার প্রদত্ত জমি জায়গা ছিল এবং তা-ই ইসলামী রাষ্ট্রের হাতে এসেছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফাগণ এই সব জায়গা আবাদ ও ভোগ দখল করার জন্য এমন লোকদের মধ্যে বণ্টন করলেন যারা সেগুলো আবাদ ও ফসল ফলাতে সক্ষম বলে বিবেচিত হয়েছিলেন।“মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, ইসলামের অর্থনীতি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫-৫৬”
সরকারীভাবে যে জমি জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে, তার দ্বারা কোনরূপ সামন্তবাদ বা জায়গিরদারী প্রথা রচনা করা যাবে না। যার পক্ষে যত পরিমাণ জমি ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার মধ্যে সামলানো, চাষাবাদ ও ফসল ফলানো সম্ভব হবে বলে বিবেচিত হবে, তাকে ততো পরিমাণ জমিই দেয়া হবে। অধিক পরিমাণ জমি কাউকেই দেয়া যাবে না। বিলাল ইব্নুল হারিস রা.-কে মহানবী স. প্রচুর জমি নিজে আবাদ করার জন্য দিয়েছিলেন। উমর রা. খলীফা নিযুক্ত হবার পর তাঁকে ডেকে বললেন ঃ মহানবী স. আপনাকে অনেক জমি দিয়েছেন। তার পরিমাণ এত বেশি যে, আপনি তা চাষাবাদ করতে পারছেন না। অতঃপর বললেন, আপনি বিবেচনা করে দেখুন, যে পরিমাণ জমি আপনি নিজে চাষাবাদ করতে সক্ষম হবেন সে পরিমাণই আপনি নিজের নিকট রাখুন। আর যা সামলাতে পারবেন না কিংবা যে পরিমাণ জমি দেখ ভাল করা আপনার সাধ্যাতীত, তা আমাদের (রাষ্ট্রের) নিকট ফেরত দিন, আমরা তা অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করবো। বিলাল রা. জমি ফেরত দিতে রাজী না হওয়া সত্বেও তাঁর সাধ্যাতীত পরিমাণ জমি উমর রা. ফেরত নিলেন এবং মুসলমানদের মধ্যে তা পুনর্বণ্টন করলেন।“ইমাম আবূ ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪”
তৃতীয় শ্রেণির বিধান : যে ভূমির কোন মালিক নেই এবং কোন গ্রাম ও শহরের প্রয়োজনেও আসে না, কিন্তু আবাদযোগ্য ও কৃষি উপযোগী, এ ধরনের ভূমি সম্পর্কে শরীয়তের বিধান হচ্ছে যে, এ ভূমি বায়তুলমালের সম্পদের অন্তভূৃকৎ হবে। অর্থাৎ বায়তুলমালই এর মালিকানা স্বত্ব লাভ করবে। আর ‘বায়তুলমালের’ সম্পদের উপর যাদের হক ও অধিকার রয়েছে; তাদের জন্য এ ভূমির উৎপন্ন ফসল এবং আয়লব্ধ অর্থ ব্যয় হবে। এ ভূমির উপর রাষ্ট্রের মুসলিম শাসনকর্তার বহুবিধ ও বিভিন্ন প্রকার এখতিয়ার রয়েছে। “মুফতী মুহম্মদ শফী, অনু: কারামত আলী নিযামী, ইসলামের ভূমিব্যবস্থা, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৫, পৃ. ৫”
বায়তুলমালের ভূমির শ্রেণি বিভাগ : বায়তুলমালের ভূমির মধ্যে কয়েক প্রকার ভূমি অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। যেমন-
১. দেশ বিজয়ের সময় যে ভূমি কারো মালিকানাভূক্ত ছিল না, বিজয়ের পর তা বায়তুলমালের অন্তর্ভূক্ত হবে।“মুহাম্মদ আমীন, রাদ্দুল মুখতার আলাদ-দুররিল মুখতার, বৈরূত, তা.বি, খ.৩, পৃ. ৩৬৬”
২. যে ভূমিতে প্রথমত কোন লোকের মালিকানা স্বত্ব ছিল বটে কিন্তু মালিকের লা-ওয়ারিস অবস্থায় মৃত্যু হবার ফলে এ ভূমি বায়তুলমালের অন্তর্ভূক্ত হবে। ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় এ ধরনের ভূমিকে ‘আরাযীয়ে মামলাকাত’ বা আরাযীয়ে হুয’ বা আরাযীয়ে সুলতানিয়া’ নামে অভিহিত করা হয়।“প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৩”
৩. বিজিত দেশসমূহের মালিকানা স্বত্বভূক্ত যে সকল ভূমি গণিমতপ্রাপ্ত লোকের মধ্যে বণ্টন করা হয়, তার আমদানী বা আয়লব্ধ অর্থের এক পঞ্চমাংশ বায়তুলমালের জন্য নেয়া হয়। এ সব ভূমিও বায়তুলমালের অন্তর্ভূক্ত হবে। “আবূ উবাইদ আল-কসেম ইবনে সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫”
৪. যখন কোন দেশ যুদ্ধ-বিগ্রহ দ্বারা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে জয় করা হয়, তখন সে দেশের সমগ্র মালিকানা স্বত্বভূক্ত জমি মূল মালিকদের হাতে না রেখে এবং মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন না করে সমগ্র জমি বায়তুলমালের অন্তর্ভূক্ত করার এখতিয়ার ইমাম বা শাসকদের রয়েছে। এমতাবস্থায় এসব ভূমি বায়তুলমারের সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। “মুহাম্মদ আমীন, রাদ্দুল মুখতার আলাদ-দুররিল মুখতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৩-৫৪”
৫. যুদ্ধ-বিগ্রহ দ্বারা প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে দেশ বিজয় করা অবস্থায় মালিকানা স্বত্বভূক্ত জমি থেকে বিশেষ বিশেষ জমি বায়তুলমালের অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। যেমন- উমর রা. ইরাক বিজয়ের পর সেখানকার ভূমি থেকে শাহানশাহ কিসরার এবং তার সংশ্লিষ্ট লোকদের ভূমি, আর যারা ঘরবাড়ি ও জায়গা জমি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের জায়গা জমি এবং যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে যারা মারা গিয়েছে, তাদের ভূমি এমনিভাবে বিশেষ বিশেষ আরও বহু জায়গাজমি বায়তুলমালের মধ্যে শামিল করে নিয়েছিলেন। এসব জমি থেকেই লোকদেরকে জায়গীর দেয়া হতো।“আবূ উবাইদ আল-কসেম ইব্ন সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮”
বায়তুলমালের ভূ-সম্পদের অধিকারী : বায়তুলমালের সম্পদ ব্যবহার ভোগাধিকার লাভের লোক তারাই যাদের কোন না কোন পর্যায়ে এ সম্পদে অধিকার রয়েছে। যেমন- ফকীর, মিসকীন, ইয়াতীম, বিদেশী পথিক, রুগ্ন, বিকল, ঋণগ্রস্থ ইত্যাদি। এছাড়া সাধারণ কল্যাণমূলক কাজেও বায়তুলমালের অর্থ ব্যয় করা যাবে। যেমন-নদীর উপর পুল-সেতু নির্মাণ, সীমান্ত পাহারা, মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।“মুহাম্মদ আমীন, রাদ্দুল মুখতার আলাদ-দুররিল মুখতার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৬”
উপসংহার ঃ মালিকানাবিহীন সম্পত্তি বণ্টনের মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমির সদ্ব্যবহার করার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। দেশের অসহায় ও দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষে মালিকবিহীন ভূমি বণ্টন করে রাষ্ট্র তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেই একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলামী দৃষ্টিকোণ


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ