চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ দুই ॥
আল্লাহর নামের প্রতি ঈমান ঃ আল্লাহ্র নাম গুণাবলীর একত্বের প্রতি ঈমান আনা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ্র একত্বকে আক্বীদার কিতাবসমূহে সাধারণত ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর অন্যতম ভাগ হচ্ছে ‘তাওহীদুল আস্মা ওয়াস্ সিফাত’ অর্থাৎ আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্ব। তাঁর নামসমূহে কোন প্রকার বিকৃতি, তুলনা, সাদৃশ্য, হ্রাসবৃদ্ধি করা সম্পূর্ণরূপে ঈমানের পরিপন্থী। ‘‘আবু বতর জাবের জাযায়িরী, আক্বীদাতুল ম’মিন, কায়রো: দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ৫১’’ মহান আল্লাহ্ বলেন, এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ। তোমরা এ নামসমূহ দ্বারা তাকে ডাকবে। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাদের কৃতকর্মের ফল শ্রীঘই তাদেরকে প্রদান করা হবে। ‘‘আল-কুরআন, ৭: ১৮০’’
আল্লাহর নামে ডাকা ও প্রার্থনা করা ঃ আল্লাহর নামসমূহের উসিলা করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা এবং তাঁর নামসমূহের মাধ্যমে তাঁকে ডাকার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বলুন, আল্লাহ বলে ডাক কিংবা রহমান বলে, যে নামেই ডাকনা কেন, সব সুন্দর নাম তাঁরই। ‘‘আল-কুরআন, ১৭: ১১০’’
মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সুসংবাদ ঃ ঈসা আ. এর মধ্যমে পূর্ববতী জাতির নিকট মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, আর স্মরণ কর, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা আ. বলল, হে বনী ইসরাঈল- আমি তোমাদের নিকট থাকা তাওরাতের সত্যায়নকারী, তোমাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহ্র একজন রাসূল এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন তাঁর নাম আহমদ। ‘‘আল-কুরআন, ৬১ : ৬’’
আল্লাহ্ কর্র্তৃক বান্দার নামকরণ ঃ আল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় বান্দাদের নিজেই নামকরণ করে দিয়েছেন। এটি আল্লাহ্র পছন্দনীয় নাম। যেমন ইয়াহ্ইয়া আ. এর ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন, হে যাকারিয়া, আমি তোমাকে এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহ্ইয়া। ইতঃপূর্বে এ নামে আমি কারো নামকরণ করিনি। ‘‘আল-কুরআন, ১৯ : ৭’’
আল্লাহ্ কর্তৃক নাম শিক্ষা দেয়া ঃ মহান আল্লাহ আদম আ. কে সৃষ্টি করে তাকে সৃষ্টি জগতের সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। নাম শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি জগৎ সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করান এবং যার মাধ্যমে ফিরিশতাকূলের উপর তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে সকলবস্তু সামগ্রীর নাম শিক্ষা দিলেন। ‘‘আল-কুরআন, ২ : ৩১’’
নাম দ্বারাই বস্তুর পরিচয় ঃ একটি বস্তু বা একজন ব্যক্তির পরিচয় তার নামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ব্যক্তির নাম, গোত্র, বংশ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তি স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে টিকে থাকে। অন্যথায় ব্যক্তি সমাজের সাথে একাকার হয়ে যেত। তাকে নির্দিষ্ট করে পরিচিত করার কোন উপায় থাকত না। মহান আল্লাহ্ বলেন, হে বিশ্বমানব, আমি তোমাদেরকে নারী-পুরুষে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন দল-গোত্রে বিভাজিত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। ‘‘আল-কুরআন, ৪৯ : ১২’’
আখিরাতে ব্যক্তি নামেই পরিচিত হবে ঃ ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিচয় সে নামেই হবে যে নামে তাকে পৃথিবীতে ডাকা হত। যদি ভাল নাম হয় তাহলে ভাল নামে, অন্যথায় তার খারাপ নামে তাকে ডাকা হবে।
রাসূলল্লাহ (সা.) বলেন, (মৃত্যুর পর) ফিরিশতারা যখন ওটাকে (কোন রূহ) নিয়ে ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করে, তারা যখনই কোন ফিরিশতাদের দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন ভাল রূহের ক্ষেত্রে বলা হয়- কে এই ভাল রূহ? ফিরিশতা তার উত্তম নামের মাধ্যমে বলেন, অমুকের পুত্র অমুক, যে নামে তাকে পৃথিবীতে ডাকা হত। ...অতঃপর ওটাকে (অন্য কোন রূহ) নিয়ে ঊর্ধ্ব জগতে আরোহণ করে, তারা যখনই কোন ফিরিশতাদের দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন খারাপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ফিরিশতারা তার নিকৃষ্ট নামের মাধ্যমে বলেন- অমুকের পুত্র অমুক, যে নামে পৃথিবীতে মানুষ তাকে ডাকত। ‘‘আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, খ. ৪ পৃ. ২৮৭; মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, সহীহুল জামি‘আস-সগীর, হাদীস নং- ১৬৭৬’’
আল্লাহর নামের বরকত ঃ প্রত্যেক কাজ আল্লাহ্র নামে শুরু করা মুসলিম জীবনাচরণের অন্যতম অনুষঙ্গ। এমনকি আল্লাহর নামে শুরু না করা কাজ হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী বরকত-শূন্য বিবেচিত হবে। ‘‘আহমাদ, আল-মুসনাদ, প্রাগুক্ত, খ. ১৪ পৃ. ৩২৯’’ আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ ব্যতীত জবাইকৃত পশু মুসলিমের জন্য খাওয়া হালাল নয়। আল্লাহ বলেন, যার উপর (জবাইয়ের সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়নি তা তোমরা খাবে না। ‘‘আল-কুরআন, ৬: ১২১’’ তাই ইসলামে নামের গুরুত্ব অপরিসীম।
নামকরণের শরয়ী বিধান ঃ ইসলামে সন্তানে নামকরণ পিতামাতার আবশ্যকীয় কর্তব্য হিসাবে গণ্য। সকল মাযহাবে এটিকে পিতামাতার উপর সন্তানের অধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘‘আবু বকর জাবির জাযায়িরী, মিনহাজুল মুসলিম, কায়রো : মাকতাবাতুর রিহাব, ২০০৭, পৃ. ৭৭’’ ইমাম ইবনু ‘আরাফা আল-মালিকী [৭১৬-৮০৩ হি.] (রহ.) উল্লেখ করেছেন, মূলনীতির দাবি হচ্ছে নামকরণ করা ওয়াজিব। ‘‘সম্পাদনা পরিষদ কর্তৃক সম্পাদিত, ইসলামী ফিক্হ বিশ্বকোষ, ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, ২০১৩,খ. ২, পৃ.১৪’’ এক্ষেত্রে মাতার তুলনায় পিতা অগ্রগণ্য। নামকরণে পিতা-মাতার মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে পিতা অগ্রাধিকার পাবেন। ‘‘ড. আবদুল্লাহ নাসিহ আ‘লওয়ান, তারবিয়াতুল আওলাদ, কায়রো : দারুস সালাম, ২০০৯, খ. ১, পৃ ৬৯’’। আল্লাহ তাআ‘লা বলেন, তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। ‘‘আল-কুরআন, ৩৩ :৬৯’’। এছাড়া সুন্দর নামে ব্যক্তিকে ডাকা ইসলামে মুস্তাহাব। যে নাম ব্যক্তির পছন্দ এবং প্রিয় সে নামেই ডাকা উচিত। ‘‘আবু আব্দুল্লাহ মুস্তাফা আদ্ওবী, ফিক্হুল আখলাক, কায়রো : দারু ইব্নে রজব, ২০০২, খ. ২, পৃ. ২৩৬’’ খারাপ বা নিকৃষ্ট নামে কাউকে নামাঙ্কিত করা বা কাউকে ডাকা ইসলামে নিষিদ্ধ। এটাকে ইসলামে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন, তোমার একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, কেউ ঈমান আনলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ, যারা এরূপ কাজ থেকে তাওবা করে না তারা জালিম। ‘‘আল-কুরআন, ৪৯ : ১১’’
নামকরণের সময় ঃ রাসূল (সা.) জন্মগ্রহণ করার সপ্তম দিনে নামকরণ করার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক সন্তানই তার আকীকার সাথে দায়বদ্ধ থাকে, তার পক্ষ থেকে জন্মের সপ্তম দিনে (পশু) জবেহ করা হবে, তার নামকরণ করা হবে এবং তার মাথা মুন্ডন করা হবে। ‘‘আবদুর রহমান আহমদ বিন শুয়াইব আন-নাসায়ী, আস-সূনান, দেওবন্দ : মাকতাবা আশরাফিয়া, তা. বি., অধ্যায় : আল আকীকা, পরিচ্ছেদ : মাতা’ ইয়াউ‘ক্কা, খ. ২, পৃ. ১৬৭’’। তবে রাসূল (সা.) নিজে তাঁর সন্তানের জন্মের দিনই তার পিতা ইবরাহীমের নামানুসানে নামকরণ করেছেন। ‘‘আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ আল কুশাইরী, আস-সহীহ্, অধ্যায় : আল ফাদাইল, পরিচ্ছেদ : রাহমাতুহু (সা.) আস্ সিবইয়ানা ওয়াল ই‘য়ালা ওয়া তাওয়াদুয়ুহু ওয়া ফাদলু যালিকা, বৈরুত : দারুল ফিক্র, ২০০৩ পৃ. ১১৫৭, হাদীস নং ৫৯১৯’’ তাছাড়া সাহাবীদের মধ্যে আবু মূসা আল- আশাআ’রী (রা.) তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণের দিনই তার নাম রাখেন ইবরাহীম এবং রাসূল (সা.)-এর নিকট নিয়ে আসেন। তিনি তার জন্য দু‘আ করেন। ‘‘বুখারী, আস-সহীহ্, প্রাগুক্ত, অধ্যায় : আল-আকীকা, পরিচ্ছেদ : তাসমিয়াতুল মাউলুদ গাদাতান ইউলাদু লিমানলাম ইয়াউক্কা আ‘নহু ওয়া তাহনীকুহু, খ. ২., পৃ. ৮২১, হাদীস নং ৫২৫৫’’।
এ সকল হাদীসের আলোকে সকল মাযহাবেই জন্মের পরপরই নাম রাখাকে বৈধ গণ্য করা হয়েছে। তবে ঈমাম শাফিয়ী ও ঈমাম মালিক (রহ.) জন্মের ৭ম দিনে নামকরণকে মুস্তাহাব গণ্য করেছেন। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) এর মতে, জন্মগ্রহণের পর ৩ দিন বা ৭ দিন পর্যন্ত নামকরণ বিলম্বিত করা এর আগে পরে করা বৈধ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।