চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলাম বিশ্ব মানবতার জন্য মহান আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত। ইসলামে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দিকসহ সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। মানবজাতি যে ভূমির উপর বসবাস করে সে ভূমির ব্যাপারেও ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, ভোগদখলসহ মালিক বিহীন ভূমির ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান। অত্র প্রবন্ধ মালিক বিহীন ভূমির উন্নয়ন ও বণ্টন নীতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
মহান আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, এটা পানির ন্যায় তরলও নয় এবং রুটি ও কাদার ন্যায় চাপ সহযোগে নিচেও নেমে যায় না। আবার এই ভূমিকে এত শক্তও করা হয়নি যাতে উদ্ভিদরাজির অঙ্কুরোদগমে বাঁধা হয়ে দাড়ায়। এরূপ হলে তাতে বৃক্ষ ও শস্য বপন করা যেত না, কুপ ও খাল খনন করা যেত না; সুউচ্চ অট্টালিকার ভিত্তি স্থাপন করা যেত না। মহান আল্লাহর সব সৃষ্টিই সুপরিকল্পিত ও সুষম। তিনি বলেন ঃ “আর পৃথিবী, তাকে আমি বিস্তৃত করেছি এবং আমি তাতে প্রত্যেক বস্তু উদগত করেছি সুপরিমিতভাবে এবং তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি তোমাদের জন্য, আর তোমরা যাদের জীবিকাদাতা নও, তাদের জন্যও।”“আল-কুরআন, ১৫ : ১৯-২০”
মালিকানা বিহীন ভূমির উন্নয়ন ও বণ্টন নীতি পর্যালোচনা ঃ কোন দেশ বিজিত হবার পর সে দেশের ভূমি প্রথমত দু’ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে থাকে : “ইমাম আলাউদ্দীন আবূ বাকর ইবনে মাসউদ আল-কাসানী আল-হানাফী, বাদাইউস সানাঈ ফী তারতীবিশ শারাঈ, বৈরূত : তা.বি., ১৯৮২, খ.৬, পৃ.১৯২”।
১. মালিক বিহীন ভূমি : ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় এ ধরনের ভূমিকে ‘আরযে মোবাহা’ বলা হয়। অর্থাৎ সে ভূমির উপর বিশেষ কোন ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব থাকে না।
২. মালিকানা স্বত্ব সম্বলিত ভূমি : যে ভূমির উপর লোকদের মালিকানা স্বত্ব থাকে এবং মালিকেরাই তা নিজ ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখে।
মালিক বিহীন ভূমির প্রকারভেদ ঃ যে ভূমির কোন মালিক থাকে না তা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত- ১. ঐ সকল ভূমি যা গ্রাম ও শহরবাসীদের সাধারণ ও যৌথ প্রয়োজনের খাতিরে ব্যবহৃত হয়; যেমন- মহল্লার অলিগলি, সড়ক, পথঘাট, খেলার মাঠ, চারণভূমি, কবরস্থান, ঈদগাহ ইত্যাদি। ২. দ্বিতীয় শ্রেণিতে ঐ সকল ভূমি অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকে, যা পতিত অবস্থায় থাকে, বিশেষ কোন লোক যার মালিক থাকে না; যেমন- বন-জঙ্গল, মরুভূমি, অনাবাদী পাহাড়ী জমি ইত্যাদি। এসব জমি কার্যত কোন আবাদ বা ফসল যোগ্য নয়, তেমনি এর দ্বারা কোন উপকারও হয় না। শরীয়তের পরিভাষায় এ ধরনের ভূমিকে ‘আরযে মাওয়াত’ বা মৃত ভূমি বলা হয়। ৩. তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে ঐ সকল ভূমি অন্তর্ভূক্ত যা কোন গ্রাম ও শহরের প্রয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, কিন্তু কৃষি উপযোগী এবং এ থেকে বহু উপকার গ্রহণ করা যেতে পারে। শরীয়তের পরিভাষায় এ ধরনের ভূমিকে ‘আরযে বায়তুলমাল’ বলা হয়।“প্রাগুক্ত, পৃ.১৯৪”
প্রথম শ্রেণির বিধান : যে সব মালিক বিহীন ভূমির সাথে শহর, গ্রাম ও মহল্লাবাসীদের সাধারণ স্বার্থ ও প্রয়োজন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সেসব ভূমিবিষয়ে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, এ সব ভূমি কোন ব্যক্তির মালিকানায় বা দখল ও ব্যবহারে থাকতে পারবে না। ব্যক্তির মালিকানা ও দখল সম্পূর্ণ অবৈধ। এমনকি মুসলিম শাসকরাও এর মালিক হতে পারবে না এবং কাউকে মালিক বানাতেও পারবে না। সাধারণ প্রয়োজন পূরণের খাতিরে ‘ওয়াকফের’ ন্যায় সর্বদা সংরক্ষিত থাকবে।“প্রাগুক্ত”
এমনিভাবে ধাতব পদার্থের খনি যেমন- লবণ খনি, ভূমির তেল ও পেট্রোল খনি, যা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনের মধ্যে শামিল রয়েছে-এগুলো শহরের নিকটে হোক বা দূরে হোক, কখনও কোন ব্যক্তি বিশেষের মালিকানায় ও জায়গীরদারীতে পরিণত হতে পারবে না।“প্রাগুক্ত” কোন মুসলিম শাসক যেমন নিজে মালিক হয়ে ব্যবহারিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না, তেমনি অন্য কোন লোকের মালিকানায়ও দিতে পারবে না। বরং সাধারণ মানুষের খাতিরে সরকারী ব্যবস্থাপনায় সুরক্ষিত রাখতে হবে। কারণ মহানবী স. ইয়ামান প্রদেশের ‘মারিব’ নামক স্থানের ভূমি আবইয়ায ইবনে হাম্মাল আল-মাযিনী রা.-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে দান করেছিলেন। কিন্তু পরে যখন মহানবী স. অবগত হলেন যে, এ জমিতে লবণের খনি রয়েছে এবং সাধারণ মানুষের প্রয়োজন এর সাথে সংশ্লিষ্ট, তখন তিনি তার থেকে এ জমি ফেরত নিয়েছিলেন। “আবূ উবাইদ আল-কসেম ইবনে সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল, ইসলামাবাদ: ইদারাহ তাহকিকাতে ইসলামী, ১৪০৭/১৯৮৬, পৃ. ২৭৬”
দ্বিতীয় শ্রেণির বিধান : যে সব পতিত ও অনাবাদী ভূমির সাথে গ্রাম বা শহরবাসীর প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট থাকে না এবং কার্যত এ ভূমি আবাদযোগ্যও নয়, এ ধরনের ভূমি সম্পর্কে শরীয়তের বিধান হচ্ছে মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যে লোক এ ভূমিকে আবাদযোগ্য ও কৃষি উপযোগী করবে সে লোকই এ ভূমির মালিক হবে, আবাদকারী মুসলিম অথবা অমুসলিম উভয়ই হতে পারে। মহানবী স. মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মালিকানাবিহীন অনাবাদী জমি আবাদ করার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন : “যে ব্যক্তি এমন কোন জমি আবাদ করে যার মালিক নেই, তাহলে সে ব্যক্তিই (ঐ জমির) অধিক হকদার।”“ইমাম বুখারী, সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায় : আল-হারাম ওয়ান মুযারাআ, অনুচ্ছেদ: মান আহইয়া আরদান মাওয়াতান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩” লোকেরা তখন সাধ্যানুসারে জমি আবাদ করার ও মালিক হবার জন্য চেষ্টা করতে লেগে গেল। এভাবে বহু লোকের মধ্যে মালিকানাবিহীন জমি বণ্টন করা হলো।
উমর রা.-এর খিলাফতকালে তাঁর কাছে এক ব্যক্তি দজলা নদীর তীরে অবস্থিত এ ধরনের একটি জমি লাভের জন্য আবেদন করলে তিনি ইরাকের গভর্নর আবূ মূসা আল-আশ‘আরী রা. কে লিখে পাঠিয়েছিলেন ঃ “যদি তা জিয্য়ার ‘জিয্য়া’-শব্দটির বহুবচন জিযা; জাযা’ শব্দ হতে উৎপন্ন। অর্থ কর, মাথা পিছু ধার্য কর, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকদের উপর ধার্য কর। আল্লামা যামাখ্শারীর মতে, যিম্মীগণ এই কর প্রদান করে নাগরিক হিসাবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটি অংশ হতে অব্যাহতি লাভ করে বলে এর নাম জিয্য়া। মুহাম্মদ ইবনে উমার আয-যামাখশারী, আল-কাশ্শাফ আন হাকাইকিক তানযীল ওয়া’উয়ূনিল আকাবীল, বৈরুত : দারুল ফিক্র, তা.বি., খ. ২, পৃ. ২৬২” জমি না হয় এবং এমন জমিও না হয় যেখানে জিয্য়ার জমির জন্য পানি প্রবাহিত হয়, তবে কেবল সেই জমিই সরকারী পর্যায়ে জনগণের মধ্যে বণ্টন করতে পারো।” “আবূ উবাইদ আল-কাসেম ইবনে সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১৪” এতে প্রমাণিত হয় যে, কেবল মালিকানাবিহীন জমিই সরকারী পর্যায়ে বণ্টন করা যেতে পারে। আর এরূপ জমির পূর্ণ বণ্টন সরকারী পর্যায়েই হতে পারে। “প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪৮”। ইমাম আবূ ইউসুফ র. লিখেছেন, “যে সকল জমি আবাদী নয়, যার কোন মালিক নেই তা বণ্টন না করে অব্যবহৃত ফেলে রাখা রাষ্ট্রের পক্ষে কিছুতেই উচিত হতে পারে না। উমর ইবনে আবদুল আযীয রা.-এর একটি আদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর গর্ভনরদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন, “তোমাদের হাতে যে সব সরকারী জমি রয়েছে তা অর্ধেক ফসলের বিনিময়ে পারস্পরিক চাষের নিয়ম অনুযায়ী জনগণকে চাষ করতে দাও। এতেও যদি চাষাবাদ না হয়, তাহলে এক-তৃতীয়াংশের বিনিময়ে (তিন ভাগের এক ভাগ সরকার পাবে এবং দু’ভাগ পাবে চাষী) তা চাষ করতে দাও। আর এই শর্তে যদি কেউ জমি চাষ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে দশ ভাগের এক ভাগ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে চাষ করতে দিতে পার। এতেও যদি জমি চাষ না হয় তাহলে কোন রূপ বিনিময় না নিয়ে এমনিতেই চাষ করতে দাও। এভাবেও কেউ চাষ করতে না চাইলে তার চাষাবাদ করার জন্য বায়তুলমাল “‘বায়তুলমাল’-বায়তুলমাল অর্থ ধনাগার, কোষাগার, মাল বা দৌলতের ঘর। ইসলামী পরিভাষায় মুসলিম রাষ্ট্রের ট্রেজারী বা কোষাগারকে বায়তুলমাল বলা হয়। মহানবী স.-এর যুগ থেকেই কোন না কোন রূপে বায়তুলমালের অস্তিত্ব ছিল। আবূ বকর রা.-এর খিলাফতকালেও অনুরূপ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। উমর রা.-এর খিলাফতের যুগেই পরিপূর্ণরূপে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বায়তুলমাল অস্তিত্ব লাভ করে। ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় রাজস্ব বায়তুলমালের সম্পত্তি নয়। সামগ্রিকভাবে মুসলিম উম্মাহর আওতাভূক্ত অর্থই বায়তুলমালের সম্পত্তি বলে পরিগণিত হয়ে থাকে। ইমাম অথবা তাঁর প্রতিনিধি উক্ত সম্পত্তিকে মুসলিম উম্মাহর যে কোন কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতে পারেন। দ্র.মু. মাজহারুল হক “বায়তু’লমাল”, ইসলামী বিশ্বকোষ, খ. ১৫, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৪, পৃ. ৫৯৪-৬০৭” হতে অর্থ ব্যয় কর এবং কোন জমিই তোমরা অব্যবহৃত রাখবে না।” “ইমাম আবূ উবাইদ আল-কাসিম ইবনে সাল্লাম, কিতাবুল আমওয়াল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৩”।
অনাবাদী জমি আবাদ করা অথবা ভূমিহীন কৃষক বা মুহাজিরদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে সরকারের পক্ষ হতে কাউকে ভূমি দান করা ইসলামে বৈধ। একে আরবী পরিভাষায় ‘ইকতা’ “‘ইকতা’-ইকতা ইসলামী ফিক্হ এর একটি পরিভাষা। সরকার কর্তৃক কোন মালিকানাবিহীন ভূমি চাষাবাদের জন্য কাউকে প্রদান করা হলে এমতাবস্থায় যাকে সেই ভূমি প্রদান করা হয়, সে যতদিন পর্যন্ত তার খারাজ বা ‘উশর দিতে থাকবে ততদিন মালিকের ন্যায়ই উক্ত ভূমির ব্যবহার করার অধিকার থাকবে। দ্র. “ইক্তা”, সায়্যিদ নাযীর নিযামী/ আবদুল জলীল, ইসলামী বিশ্বকোষ, খ. ৩, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭, পৃ. ২৯৪” বলে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।