চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
এমনকি বংশ-গোত্র, পারিবারিক জীবন-মান ও আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে মেয়েদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য হয়ে থাকে। একারণে কোনো এক নীতি বা কোনো ধরাবাঁধা কথা এ ব্যাপারে বলা যায় না। কাজেই ছেলে-মেয়ের বিবাহের জন্য কোনো বয়সসীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া এবং ঐ নির্ধারিত বয়স সীমার পূর্বে বিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন জারি করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। তাছাড়া বিয়ে বলতে যদি স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন ও এতদুদ্দেশ্যে ঘর বাঁধা বোঝায়, তাহলে তা তো ছেলেমেয়েদের পূর্ন বয়স্ক বালেগ-বারেগা অর্থাৎ সাবালক হওয়ার পূর্বে সম্ভব হয় না। তবে বিবাহ বলতে যদি শুধু আক্দ ও ইজাব-কবুল বোঝায় তাহলে তা যে কোনো বয়সেই হতে পারে। এমনকি দোলনায় শোয়া বা দুগ্ধপোষ্য শিশুরও হতে পারে তা পিতা বা বৈধ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে। ইসলামী শরীয়তে এ বিবাহ নিষিদ্ধ নয় এবং এতে অশোভনও কিছু নেই।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মুস্তফা আস্-সিবায়ী লিখেন: চারটি মাযহাবসহ অন্যান্য মাযহানের ইজতিহাদী রায় হচ্ছে, ‘বালেগ’ (সাবালক) হয়নি- এমন ছোট ছেলে-মেয়ের বিয়ে শুদ্ধ ও বৈধ’’। ‘‘আস্ সিবায়ী, ড. মুস্তফা, আল্-মারআতু বাইনাল ফিকহি ওয়াল কানুনি, তা. বি., পৃ. ৫৭।’’ আল-কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা এবং নবী স.-এর যুগে তাঁর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলীর ভিত্তিতে উপরিউক্ত কথার যৌক্তিকতা ও প্রমাণিকতা অনস্বীকার্য। রসূলুল্লাহ স.-এর প্রসিদ্ধ একটি হাদীস থেকে শিশুদের মুকাল্লাফ- শরীয়তের বিধিবিধান পালনে বাধ্য-বাধকতার বয়স সীমা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইবাদত করার উপযুক্ত বয়স প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ স. বলেন- ‘‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে পদার্পণ করতেই সালাত আদায়ের আদেশ দাও। দশ বছর বয়সে পদার্পণ করে সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’’ ‘‘ আবু দাউস, ইমাম, সুলায়মান ইবনে আল-আশ, আস-সুনান অধ্যায়: আস-সালাত, অনুচ্ছেদ : মাতা ইউমারুল গুলাযু বিস-সালাত, আল-কুতুবুস সিত্তাহ, রিয়াদ: দারুস সালাম, ২০০০, পৃ. ১২৫৯ দারুল ফিক্র তা, বি, খ. ১, পৃ. ১৩৩, হাদীস নং ৪৯৫।’’
এ হাদীসের বক্তব্য থেকে শরীয়তের দৃষ্টিতে শিশুর নিম্নতম বয়স সাত বছর এবং দশ বছর বলে বোঝা যায়। অর্থাৎ, শিশু শরীয়ত পালনের জন্য মুকাল্লাফ বা দায়িত্বশীল হবে দশ বছর বয়সে। ফিক্হবিদগণের দৃষ্টিতে মেয়ে শিশু বালিগা বা সাবালকে উপনীত হবে- যখন তার হায়েয (মাসিক ঋতুস্রাব) হওয়া শুরু হবে। আর এর নিম্নতম বয়স সীমা বলা হয়েছে কমপক্ষে ‘নয়’ বছর। নয় বছরের পূর্বে যদি কোনো বালিকার ঋতুস্রাব হয় তাহলে তা হায়েয বলে গণ্য হবে না। ‘‘সম্পাদনা পরিষদ, আলমগীরী, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তা. বি. খ. ১, পৃ. ৩৬।’’ এ ব্যাখ্যা থেকেও মেয়ে শিশুর মুকাল্লাফ হওয়া বা প্রাপ্ত বয়স্ক বা সাবালত্বের নিম্নতম বয়স ‘নয়’ বছর। শরীয়তের দৃষ্টিতে ছেলে শিশুর সাবালকত্বে পদার্পণের নিদর্শন হচ্ছে দাড়ি-গোঁফ গজানো এবং স্বপ্নদোষ হওয়া। উপরিউক্ত নিদর্শন দেখা গেলে ছেলে-মেয়ে শিশুত্ব থেকে শরীয়তের মুকাল্লাফ হয়ে থাকে অর্থাৎ সাবালকত্ব লাভ হয় এবং শরীয়তের বাধ্যবাধকতা আরোপ হয়। তখন আর যে শিশু শরীয়তের বাধ্যবাধকতার আওতামুক্ত থাকে না। ‘‘মুমেন, নূরুল, মুসলিম আইন, একাদশ অধ্যায়, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪, পৃ. ১৪২-১৪৩।’’
সাবালত্বের সীমা নির্ধারণের আলোচনায় ইমাম আবুল হাসান আল-আশআরী ৭টি মতের উল্লেখ করেছেন- ১. শিশুর বুদ্ধির পরিপক্কতা না হওয়া পর্যন্ত সাবালক হয় না। বুদ্ধির উন্মোষের প্রমাণ হচ্ছে মানুষ ও পশুর মধ্যে ক্ষতি ও উপকারের বিষয়ে পার্থক্য বোঝা। তা ছাড়া বিদ্যা অর্জনে সামর্থ্যবান হওয়া। ২. মনীষী মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব আল-জাযায়েরী বলেন, শিশুর সাবলকত্ব হচ্ছে বুদ্ধির এমন পরিপক্কতা যার দ্বারা যে নিজেকে পাগল যা করে তা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম। ৩. বাগদাদের তৎকালীন পন্ডিতগণ বলেন, সুস্থ ও মুকাল্লাফ হওয়া এবং পাগলের পার্থক্য বোঝার সক্ষমতা শলীয়তে শিশুর সাবালকত্বের নিদর্শন। ৪. আল্লামা চুমামা ইবনে আশরাস আন নুমাইরির মতে, মানব শিশু সাবালকত্ব লাভ করে তখন যখন যে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ, সে আল্লাহ, রসূল, কিতাব প্রভৃতি বিষয়ে বুঝতে সক্ষম হয়- তখন সাবালক হিসেবে পরিগণিত হয়। ৫. অধিকাংশ মুতাকাল্লিমীন (যুক্তিবিদ)-এর মতে, মানব শিশুর মধ্যে বুদ্ধির পরিপূর্ণতাই হচ্ছে সাবালকতের প্রমাণ। ৬. অধিকাংশ ফিকহবিদ-এর মতে, দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে স্বাভাবিক থাকা অবস্থায় তার স্বপ্নদোষ হওয়া শিশুর সাবালকত্বের নির্দশন অথবা তার বয়স ১৫ বছর হওয়া। তবে কোনো কোনো ফিকহবিদ শিশুর সাবলকত্বের বয়স সীমা ১৭ বছর মনে করেন। ৭. কিছু সংখ্যক পন্ডিতের মতে, তার বুদ্ধি অধিকাংশ প্রতিবন্ধকতা দূর না হওয়া পর্যন্ত বয়স ত্রিশ বছর এবং স্বপ্নদোষ হলেও শিশুত্ব হারাবে না। অর্থাৎ, সাবালকত্ব লাভ করবে না। ‘‘ইবনে ইসমাঈল, আবুল হাসান আলী (মূল), মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন ‘আবদুল হামীদ সম্পাদিত, মাকালাতুল ইসরামিয়্যীন ওয়া ইখতিলাফুল মুসাল্লীন, ২৩৫ আর্টিকেল, মাকতাবাতু আন নাহদাতু আল-মিসরিয়্যাহ, আল-কাহেরা: ১৯৬৯, খ. ২, পৃ. ১৭৫।’’
ইসলামী শরীয়তবেত্তাদের মধ্যে যেমন ইবনে শোবরুমা ও আল্-বাত্তী অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর বিবাহের ব্যাপারে আপত্তি করে বলেন, ছোট বয়সের ছেলে-মেয়ের কোনো রকম বিবাহ প্রদান আদৌ বৈধ নয়। আর তাদের অভিভাবকগণ তাদের পক্ষ থেকে উকীল হয়ে যে সব বিবাহ সম্পন্ন করে থাকেন, তা সম্পূর্ণ বাতিল; তাকে বিবাহ বলে ধরাই যায় না। ‘‘আব্দুর রহীম, মওলানা মুহাম্মদ, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ১৯৯৩, পৃ. ১৩৯।’’ প্রকৃতপক্ষে শরীয়তে বিবাহের আদেশ এবং এ সম্পর্কিত যাবতীয় বিধান, উপদেশ এ কথারই সমর্থক। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেয়ায় বাস্তবে কোনো কল্যাণ নেই। বরং আছে অনেক জটিলতা, তিক্ত সমস্যা ও বিপর্যয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।